সুন্দর ও অসুন্দর নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। আছে ভুল বোঝাবুঝিও। যদি চিন্তা করি, তাহলে বুঝতে পারবো; কিছু জিনিসকে আমরা সহসাই সুন্দর বলি। আবার কিছু জিনিসকে আমরা অসুন্দর বলি। যেমন, ফুলকে আমরা সুন্দর বলি। চাঁদকেও বলি সুন্দর। আকাশ! সেটিও সুন্দর। সমুদ্র সুন্দর। অনেক সময় আমরা বনকেও সুন্দর বলি। আবার, পাখি সুন্দর। নদী সুন্দর। মাঠ সুন্দর। এমনিভাবে প্রকৃতির কত কিছুইতেই আমরা সুন্দর খুঁজে পাই। কিন্তু অসুন্দরটা কী? সেটি কি আমরা সহজে খুঁজে পাই, যেমন করে সুন্দর খুঁজে পাই? না, পাই না। অসুন্দর খুঁজে পেতে হলে আমাদের চিন্তা করতে হয়। চিন্তা করে করেও আমরা চটজলদি বলতে পারি না যে, এটা অসুন্দর, ওটা অসুন্দর। কেউ হয়তো বলবে, পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে অসুন্দর কাক। কেননা কাক দেখতে ভীষণ কালো। যা কালো তা-ই অসুন্দর।

আসলে কালো কাক কি সত্যিই অসুন্দর? চিন্তা করলে তা মনে হবে না। কাক কালো বটে, তবে কাককে অসুন্দর বলা যায় না। গভীরভাবে একদৃষ্টে অনেকক্ষণ ধরে দেখতে থাকলে কালো কাককেও সুন্দর-ই মনে হতে থাকবে। মনে ধরতে থাকবে। কাকও সুন্দর। কাকের রঙটা শুধু কালো; কোনোভাবেই কাক কিন্তু অসুন্দর নয়। কালো রঙের ভেতরও এক ধরনের সুন্দর লুকিয়ে থাকে। কোকিলের গায়ের রঙও কালো। গাছের ডালে বসে কোকিল যখন কুহু কুহু ডাকে তখন কোকিলকেও ভালো লাগে। জ্যৈষ্ঠ মাসে আম-কাঁঠালের সময় কোকিল মনের আনন্দে গান গায়, তখন উঁকি দিয়ে কোকিলকে দেখি; কিন্তু কোকিলকে আমাদের অসুন্দর মনে হয় না। আমরা যে বইপুস্তক পড়ি; সেই বইপুস্তকের লেখাগুলোও কালো রঙের হয়ে থাকে। কালো বলে এই অক্ষরগুলোকেও আমাদের অসুন্দর মনে হয় না। আসলে, কালো অসুন্দর নয়; কালো একটি রঙের নাম। কালো রঙের ভেতর যদি সুন্দর না থাকবে, তাহলে কেনো আমরা কোনো অনুষ্ঠানকে বলি জমকালো অনুষ্ঠান! পৃথিবীর বড় বড় ব্যয়বহুল গম্ভীর অনুষ্ঠানকে জমকালো বলেই উল্লেখ করা হয়।

খেয়াল করলে দেখা যায়, ফলের মধ্যে সবচেয়ে কালো জাম। জাম কি আমাদের কাছে অসুন্দর মনে হয়? হয় না। অনেকগুলো জামের মধ্যে যে জামগুলো বেশি কালো, সেগুলোই আমরা বেছে বেছে নিই সবথেকে আগে। জাম কালো না হলে খেতে ইচ্ছে করে না। গভীর কালো জামকে আমরা সুন্দর বলি। তাহলে কালো যদি সুন্দর হয়, তবে অসুন্দর কী? কেউ হয়তো বলবে, অমাবস্যার নিকষ গাঢ় ঘন কালো অন্ধকার রাতই অসুন্দর। এমন অন্ধকার রাতে কেমন যেন গা ছম ছম করে। ভয় ভয় লাগে। এই ভয়ই অসুন্দর। কথাটা সত্য। কেননা ভয় একটা সাংঘাতিক ব্যাপার। যখন ভয় লাগে তখন আর কোনো কিছুকেই সুন্দর মনে হতে চায় না। ভয়ের এমন প্রভাব যে, ভয় সুন্দরকেও অসুন্দর করে তোলে। সেজন্যই বলা যায়, এই ভয়ই একমাত্র অসুন্দর। এছাড়া অসুন্দর বলতে আর কিছু নেই। সবই সুন্দর। অতএব অসুন্দর সেটাই যেটার উপর ভয় ভর করে। সে কারণে ভয় সুন্দরের মধ্যেও থাকতে পারে। যে সুন্দরের মধ্যে ভয় থাকে সেই সুন্দরই অসুন্দর হয়ে ওঠে। ভয় অন্ধকারেও থাকতে পারে; আলোতেও থাকতে পারে। রাতেও থাকতে পারে; দিনদুপুরেও থাকতে পারে। কালোতেও থাকতে পারে, ধলোতেও থাকতে পারে। কাজেই যা ভয় তা-ই অসুন্দর। এছাড়া পৃথিবীতে অসুন্দর বলে কোনো কিছু নেই।

যে অমাবস্যার নিকষ গাঢ় ঘন কালো অন্ধকার রাত; যে রাতে গা ছম ছম করে, ভয় ভয় করে; এমন নিকষ অন্ধকার রাতকেও চোর-ডাকাতরা সুন্দর রাত বলে থাকে। তাহলে ভয় ব্যতীত অসুন্দর আর কিছুই নেই। আমাদের সমাজে কালো রঙের মেয়েদেরকে অসুন্দর বলা হয়ে থাকে। মনে রাখা দরকার, কালো রঙ আর অসুন্দর এক জিনিস নয়। তবুও কালো রঙের মেয়েদেরকে অসুন্দর বলা হয়। এটি মেয়েদের প্রতি একপ্রকার অত্যাচার। কোনো মানুষই নিজের গায়ের রঙ নিজেরা ঠিক করে নেয় না। কারো গায়ের রঙ কালো। সেজন্য সে নিজে দায়ী নয়, অভিযুক্ত নয়, দোষীও নয়। অথচ আমরা কালো রঙের মেয়েদের অবজ্ঞা করি। মানুষ তার নিজের শরীরের কোনো কিছুই যেহেতুু নিজে তৈরি করতে পারে না, সেহেতু মানব শরীরের অসঙ্গতি নির্দেশ করে মানুষকে তিরস্কারও করা যায় না। ছোট করা যায় না। তারপরও কালোদের আমরা ছোট করে দেখি। এটা আমাদের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে করে থাকি। মানুষ মন্দ হলে সেই মন্দ মানুষকে তিরস্কার করা যেতে পারে। কেননা ইচ্ছে করলে মানুষটি নিজে ভালো মানুষ হিসেবে তৈরি হতে পারতো। কিন্তু একটি মানুষ ইচ্ছে করলেই তার গায়ের রঙ বদলাতে পারে না। কাজেই সুন্দর মানুষ, অসুন্দর মানুষ রঙের ওপর নির্ভর করে না।

রঙ সৃষ্টি করা হয়েছে সৃষ্টিতে বৈচিত্র্য আনবার জন্য। সেজন্য একই রকম রঙ হয় না। একই রকম মানুষও হয় না। একই রকম ফুল হয় না। একই রকম পাখি হয় না। একই রকম জামাকাপড় হয় না। একই রকম ঘরবাড়ি হয় না। যে বাড়িটি আমার কাছে সুন্দর লাগে না, সে বাড়িটিকে আরেক জন সুন্দর বলে। যে জামাটি অসুন্দর বলে আমি কিনি না, সে জামাটিই অন্যজন সুন্দর বলে কিনে নিয়ে যায়। এই বৈচিত্র্য না থাকলে হয়তো পৃথিবী এত সুন্দর সুশৃঙ্খল হতো না। সুন্দরে বৈচিত্র্য আছে বলেই ব্যবসা বাণিজ্যও নানান রকমের হয়ে থাকে এবং প্রত্যেকটি মানুষকে প্রত্যেকটি মানুষের প্রয়োজন পড়ে।
যে মেয়েটির গায়ের রঙ কালো বলে বিয়ে হলো না; সে মেয়েটি অসুন্দর নয়। এ মেয়েটিও অন্য কারো কাছে সুন্দর। সুন্দর জিনিসটা মনের সাথে সম্পৃক্ত। যা মনে ধরে তাই সুন্দর। যা দেখলে মনের মধ্যে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়, সেটাই সুন্দর। যে জিনিসের জন্য মন আগ্রহী হয়ে ওঠে সেই জিনিসই সুন্দর। যা দেখলে মনের ভেতর সুখানুভূতি সৃষ্টি হয়, তাই সুন্দর। আর যা দর্শনে মন তিক্তবিরক্ত, শঙ্কিত, সন্ত্রস্ত হয় সেটাই অসুন্দর।

Share.

মন্তব্য করুন