সাদা বা কালো মেঘে ঢাকা ছিল আকাশ। ছিল সাদাকালো মেঘের ঘনঘটা, বৃষ্টি বাদলের সুর। এখন সেই মেঘ আগের মতো নেই। তবে মাস্কের মতো শরতের মুখে মেঘ ভেসে ওঠে। কখনো দেখি মেঘের ফাঁকে নীলের দারুণ দৃষ্টি। এই দৃষ্টি সৃষ্টি করে মনের মুগ্ধতা! শুধু চেয়েই থাকি। এই দেখা যেন শেষ হয় না! তখনই বুঝি শরৎ চুপে চুপে এসেছে। বলতে বাধ্য হই-
শরৎ আসে চুপে চুপে
মেঘলা নীলের বেশে
শিউলী কিংবা কাশ ও কুশের
সবুজ বাংলাদেশে।
শরৎ বড়ই বৈচিত্র্যময়। এই রোদ এই বৃষ্টিতে রোদের দখল বেশি। আকাশময় সাদা মেঘপুঞ্জ ঘোরে-ওড়ে। এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়। তখনই বৃষ্টির সাহায্য চায়। বৃষ্টি শান্তি দিতে নেমে পড়ে। তখন বৃষ্টির ফোঁটাগুলো হয় বড়ই বিচিত্র রকমের। চিকন চিকন সেমাইয়ের মতো। দাদুর চুলের মতো চিকন। চঞ্চল মন নেচে ওঠে শরতের স্পর্শে। আর এই চঞ্চলতার কারণে শ্রেষ্ঠ কবিরাও থেমে থাকতে পারেননি। যেমন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-
শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।
ভাদ্র ও আশ্বিন মাস মিলে শরৎ। ষড়ঋতুর তৃতীয় ঋতু। শরৎকে ইংরেজিতে ‘অটাম’ বললেও উত্তর আমেরিকায় একে ‘ফল’ হিসেবে ডাকা হয়। পৃথিবীর চারটি প্রধান ঋতুর একটি হচ্ছে শরৎ। উত্তর গোলার্ধে সেপ্টেম্বর মাসে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মার্চ মাসে শরৎকাল দেখা যায়।
শরতের স্তব্ধতা ঘুমপাড়ানি গানের মতো। নীরব, শান্ত ও মধুর। তখন নদীতে হাওরে ছোট ছোট নৌকা ভাসে। আগে ছিল পালতোলা নৌকা। এখন সেখানে এসেছে ছোট ইঞ্জিনের ছোট নৌকা।
নীল আকাশ নেমে যায় নদী বা হাওরের দিগন্তে। শাপলা, কলমি আর জলজ ফুলের হাসি আকাশে মিশে যায়! নদীর পাড়ের কাশফুলও যেন আকাশে হেলান দেয়! এমন একটি নান্দনিক দৃশ্য দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকে মন। নদী কিংবা জলাধারে ফোটে কাশ, পাহাড়ে কুশ, ঘরের আঙিনায় শিউলী বা শেফালী, খাল-বিল-ঝিল-পুকুর-ডোবায় শাপলা-শালুক পদ্ম আর অসংখ্য জলজ ফুল ফোটে।
শরৎকে বলা হয় শুভ্রতার প্রতীক! সাদা কাশফুল, শিউলী, স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, আলোছায়ার খেলা- এসব মিলেই শরৎ। জলহারা শুভ্র মেঘের দল যখন নীল, নির্জন, নির্মল আকাশে পদসঞ্চার করে তখন আমরা বুঝতে পারি শরতের সৌন্দর্য। শরৎ সত্যিই মধুর।
কাশফুল দেখে সবাই পাগল হয়। এখন ফেসবুকের যুগ। কেউ কেউ বেশি আবেগী হয়ে কাশের কাছে মনের আনন্দে ছবি তোলে। তবে খুব বেশি আনন্দ পায় শিশু-কিশোররা। তারা কাশফুল ছিঁড়ে তার রেণু আকাশে উড়ায়। সেই উড়ানোর তালে আকাশের দিকেও লাফ দেয়। যেন আকাশ ছুঁয়ে বড় হতে চায় তারা। শুধু কী কাশ দেখে আনন্দ করে! শিউলী দেখেও খুশিতে মেতে ওঠে। দল বেঁধে নামে শিউলী কুড়াতে। আর পাল্লা দিয়ে চলে মালা গাঁথার প্রতিযোগিতা। তাই তো! শিউলী ফুল নিয়ে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম গেয়েছেন-
‘শিউলী ফুলের মালা দোলে
শারদ রাতের বুকে ঐ…’
এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসব দৃশ্য দেখা যায়। দেখা যায় মালা গাঁথা। কিন্তু শহর বা গঞ্জ ঘেঁষা প্রায় গ্রামের শিশুরা মোবাইল নিয়ে গেম কার্টুনে ব্যস্ত। শিউলীর মালা দিয়ে ঘর সাজানো যায়। শিউলীর মালা খোঁপায়ও পরে কেউ কেউ। প্রাচীনকালে এর বোঁটার রং পায়েস বা মিষ্টান্নে ব্যবহার হতো।
শুভ কাজে কাশফুলের পাতা বা ফুল ব্যবহার হয়। মূল ব্যবহার হয় ঔষধি হিসাবে। কাশমূল বেটে চন্দনের মতো নিয়মিত গায়ে মাখলে গায়ের দুর্গন্ধ দূর হয়। শরীরের রঙ হয়ে ওঠে দিন দিন শুভ্র। এ ছাড়াও শরীরে ব্যথানাশক ফোড়ার চিকিৎসায় কাশের মূল ব্যবহৃত হয়।
কাশফুলের বৈজ্ঞানিক নাম Saccharum spontaneum. এরা ঘাসজাতীয় জলজ উদ্ভিদ। চিরল পাতার দু’ধারে খুবই ধার। পালকের মতো নরম এর সাদা ফুল।
শরৎকালের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছাতিম ফুল। সাদা রঙের থোকা থোকা ছাতিম ফুল ঝুলে থাকে গাছ থেকে। সৌরভ বিশিষ্ট সবুজ! ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই ফুলের আদি নিবাস। ছাতিমের মূলাবর্তে সাতটি করে পাতা থাকে বলে সংস্কৃতে এই গাছের নাম সপ্তপর্ণা। অ্যাপোসাইনেসি বর্গের এই গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Alstonia scholaris.
আমাদের খুবই পরিচিত জবা। সারা বছর ফুটলেও এটি মূলত শরৎকালের ফুল। মালভেসি গোত্রের এই ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম Hibiscus rosa-sinensis. ইংরেজি নাম China rose. পাঁচ পাপড়িযুক্ত গন্ধবিহীন জবাফুল বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। এ কারণে মালয়েশিয়ার জাতীয় ফুল জবা।
পান্থপাদপও শরতের ফুল! অনেকটা হাতপাখার মতো। গাছের পাতাগুলো পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে থাকে। এই গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Ravenala madagascariensis. এর পাতাগুলো পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে থাকে বলে পথিক সহজেই দিক নির্ণয় করতে পারে। এই কারণেই এর নাম হয়েছে পান্থপাদপ। ছোট জাতের এই ফুল তিনটি অসম পাপড়ি যুক্ত হয়ে একটি গোলাপি রঙের ফুল গঠন করে। এটির আদি নিবাস মাদাগাস্কারে।
এছাড়া শরৎকালে আরও অনেক ধরনের ফুল দেখা যায়। এদের মধ্যে গগন শিরীষ, হিমঝুরি, বকফুল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
জলজ ফুল মাখনাও শরতেই বেশি দেখা যায়। শরতের মাঝামাঝি থেকেই স্থলপদ্ম ফুটতে শুরু করে। শরতের সকালে সূর্যের প্রথম আলোয় অপরূপ হয়ে ওঠে স্থলপদ্ম। এমন দিনেই নতুন রঙ আর রূপের পসরা সাজিয়ে বসে ধাইরা ফুল। সাধারণত পুরোনো বৃক্ষগুলোতেই পরজীবী এই ফুলের শোভা উপভোগ করা যায়। এ সময় দই গোটার ফুলগুলোও ফুটতে শুরু করে। শরতের শেষভাগে ফোটে চা-ফুল। চা-বাগানের অনুচ্চ টিলাগুলোয় খইয়ের মতো শুভ্রতা ছড়ায় এ ফুল। আর চা-বাগানের ছায়াবৃক্ষের মেডলাগাছেও শরতেই ফুল আসতে শুরু করে। সাদাটে এই ফুল এখন নগর উদ্যানেও দেখা যায়।
ঢোল কলমি সারা বছর কমবেশি ফুটলেও শরৎকালেই বেশি দেখা যায়। পথের ধারে, ঝোপ-জঙ্গলের পাশে সহজেই চোখে পড়ে।
শরতের দুপুরও দারুণ। এই সময়ে গ্রাম গঞ্জে বকুল গাছ দারুণ মায়াবী হয়! তার ছায়ার স্পর্শ যে একবার পেয়েছে সে কখনও ভুলতে পারে না। আহা! বকুলের মগডালের ফাঁকে সাদা নীলের কী ভাব। সেসাথে যদি কোনো চিল বা ঈগল উড়ে তাহলে তো কথাই নেই। এই সময় আলাদা জগৎ তৈরী করে। তাই তো বলতে বাধ্য হই-
শরৎ দাড়ায় বকুল তলায়
ক্লান্ত দুপুর বেলা
মেঘের ফাঁকে উদার নীলে
চিল ঈগলের খেলা।
আবার হাওর অঞ্চলেও আরেক দারুণ পরিবেশ তৈরী হয়। শাপলা, শালুক, জিনারি বা জলজ ফুলের পাশে হাসের খেলা। তখন পাতিহাস এদের নিচে ডুবে ডুবে ছোট শামুক খায়। খেতে খেতে কখনো একসাথে তারা ডুবাডুবি খেলা করে। করে কাতকাত। রাজহাসও আর বসে থাকতে পারে না! তারাও তখন দ্রুত সেখানে যায়। যেয়ে একাকার হয়ে খেলে খেলে দিন পার করে। তখন শাপলা ও জলজ ফুলের সাথে তাদের আসর দেখি। আহা! তখন দেখে দেখে অনায়াসে বলে ফেলি-
পাতিহাস ডুবে খুঁজে
শামুকের জাত
রাজাহাস থেকে থেকে
করে কাত কাত।
সে সাথে গাঁয়ের দুরন্ত কিশোরেরা জলকেলি খেলায় মেতে ওঠে। খেলতে খেলতে হঠাৎ বলে ফেলে, চল- শাপলা তুলতে যাই। আহা! কতো যে শাপলা তুলেছি। সেই কথা মনে হলে এখনো জিহবায় পানি এসে যায়। পানি এসে যায় ভেট- শালুকের কথা মনে হলেও। শুধু কি কিশোর! বড়োরাও তখন ছোট নাউ নিয়ে শাপলা কুড়াতে যায়। তাই তো বলি-
এদেশেতেই জন্ম আমার
গর্ব করে বলি
এই হৃদয়ে ফোটে যখন
শাপলা ফুলের কলি।
শরতের রাতও দারুণ লাগে। অসংখ্য তারার সাথে চাঁদ খেলা করে। কখনো চাঁদ হয় তারাদের মধ্যমণি। এই আনন্দে চাঁদও জোছনা দিতে কখনোই কার্পণ্য করে না! সংক্ষেপে বলতে চাই-
তারার সাথে চাঁদের খেলা
শরৎ রাতের সনে
মেঘের সাথে বায়ুর খেলা
চাঁদের আয়োজনে।

Share.

মন্তব্য করুন