প্রথমত আমরা বসত করি পরিবারে। পরিবার থেকে সমাজে এবং সমাজ থেকে রাষ্ট্রে। এভাবেই ছোট থেকে বড় হয় মানুষ। পরিবার থেকে হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের। কেউ কেউ রাষ্ট্র থেকে হয়ে ওঠেন বিশ্বের। অবশ্য এসব হয় মানুষের বিশেষ গুণের কারণে। তাহলে একথা সত্য যে পরিবার থেকেই আমাদের যাত্রা। পরিবারই আমাদের শুরু। আমরা পরিবার থেকেই যৌথ বসবাস শুরু করি। পরিবারই আমাদের প্রথম সমাজ। প্রথম রাষ্ট্র। এবং প্রথম বিশ্ব। একইসাথে পরিবার আমাদের প্রথম বিদ্যালয়। আমাদের শিক্ষা শুরু পরিবার থেকেই। মা বাবার কাছেই শেখার প্রথম আয়োজন হয়। তারপর বড় ভাই বোনও শেখান আমাদের। কি শিখি আমরা? শিখি আদব কায়দা। শিখি নিয়ম কানুন। শিখি কেমন করে কথা বলতে হয়। কেমন করে চলতে হয়। কেমন করে জানতে ও মানতে হয়। আমরা শিষ্টাচার শিখি। এসব আমাদের আদব। আদবের মধ্যে আরও শিখি দেখা হলে সালাম দেয়া। বড়দের সম্মান করা। ছোটদের স্নেহ করা। আর সবার সাথে মিষ্টি করে কথা বলা। উত্তম আচরণ করা। মা বাবাকে শ্রদ্ধা করা। আত্মীয় স্বজনের সাথে ভালো ব্যবহার করা। প্রতিবেশীকে দেখলে সালাম দেয়া। কারো সাথে কটু কথা না বলা। বড়দের সাথে মুখে মুখে তর্ক না করা।

এসব ছাড়াও একটি বড় গুণ শিখতে হয় পরিবার থেকে- সেটি হলো অন্যের দোষ না খোঁজা। এবং অন্যের দোষের কথা বলে না বেড়ানো। অন্যের দোষ খোঁজার অভ্যাস খুব খারাপ অভ্যাস। যার এ অভ্যাস রয়েছে, তাকে এখান থেকে দ্রুত উঠে আসতে হবে!
কারণ অন্যের দোষ খোঁজার অভ্যাস একবার হয়ে গেলে তখন আর কারো ভালো গুণ চোখে পড়ে না। তখন মনে হয় জগতের সবাই অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। সবাই খারাপ কাজে লিপ্ত, এমনই মনে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- অন্যের ভালো কাজও খারাপ মনে হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- কেনো এমন হয়?
এরও কারণ আছে। কারণটি হলো- পৃথিবীতে দোষমুক্ত মানুষ নেই। নির্ভুল কোনো মানুষ পাওয়া যাবে না। যায় না। প্রতিটি মানুষের গুণ আছে। সাথে দোষও। কারো গুণ বেশি। কারো দোষ বেশি। তবে গড়ে মানুষের গুণই বেশি। কিন্তু গুণ যতই থাক দোষ কিছু না কিছু থাকবেই। থাকেই প্রতিটি মানুষের।
এখন যে মানুষের দোষ খোঁজে তার চোখে কারো গুণ পড়ে না। পড়ে শুধু দোষ আর দোষ। বরং কখনো কখনো অন্যের গুণও দোষে পরিণত হয়।

এখানে অবশ্য বলা যায়- পছন্দ অপছন্দের কথা। পছন্দের মানুষ হলে অনেক সময় দোষও গুণ মনে হয়। আবার মানুষ অপছন্দ হলে গুণও দোষে রূপ নেয়। এটি এক অদ্ভুত বিষয়। কিন্তু যদি মানুষের নিরপেক্ষ দৃষ্টি থাকে তবেই শুধু দোষ দোষের আর গুণ গুণের হয়। মজার বিষয় হলো যারা অন্যের দোষ খোঁজে তাদের চোখে নিরপেক্ষতা থাকে না। তাদের বিবেক সুবিচার করে না। করতে পারে না। সুবিচার না হলে অবিচার হয়ে যায়। আর অবিচার হলো জুলুম। আর জুলুম বড় অন্যায়! কারো ওপর জুলুম করা উচিত নয়। জুলুম যে করে সেও জুলুমের শিকার হয়ে যায়।
তাহলে কি করতে হবে আমাদের?

করতে হবে- অন্যের ভালো গুণগুলো দেখতে হবে। ভালো গুণের প্রশংসা করতে হবে। দিতে হবে স্বীকৃতিও। নিজের খারাপ গুণগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। সংশোধন করতে হবে নিজেকে। নিজের দিকে ফিরলেই মানুষ বোঝে কত দোষ নিয়ে ঘুরছে সে। কত দোষ সঙ্গে নিয়ে ফিরছে এবং কত দোষ নিয়ে চলছে সে। কত কত ঘাটতি নিজের। কত দোষ জেগে আছে নিজের ভেতর। কত যে ভুল নিজের কাছে। অন্যের দোষ খোঁজার অবসর কোথায়!
প্রতিটি মানুষের ভেতর যেহেতু দোষ আছে। সেহেতু নিজের দোষ খোঁজাই উত্তম। আর মানুষ যদি নিজের দোষ খোঁজে তো আর কোনো সমস্যাও থাকে না। তখন অন্যের গুণাবলি দেখতে থাকবে চোখ। মনে হবে সবাই ভালো। আমিই শুধু কম গুণী।

নিজের দোষ খোঁজার জন্য সাহস থাকতে হয়! সৎ সাহস লাগে। নিজেকে বুঝতে হয় গভীর থেকে। আবিষ্কার করতে হয় নিরন্তর। জানতে হয় নিজের ওজনটুকু। যারা নিজের ওজন বোঝে না তারা অন্যের ওজনও বোঝে না। নিজের সম্পর্কে ধারণা না থাকলে অন্যের বিষয়েও ধারণা যথার্থ থাকে না।
নিজের সম্পর্কে যথাযথ মূল্যায়ন থাকলে খুব সুবিধা। নিজেকে বুঝলে সহজে অন্যকে বোঝা যায়। এ ধরনের মানুষ হয় স্বপ্নবাজ। এরা এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে। হতে চায় সবার সেরা। সেরা হতে হলে নিজের দোষগুলো পরিহার করতে হয়। নিজের দোষ তাড়াতে হয়। তাড়িয়ে দেয় এরা। কিন্তু দোষ তাড়াতে হলে নিজের দোষ নিজেকেই চিহ্নিত করতে হবে। চিহ্নিত দোষ থেকে ঊর্ধ্বে ওঠার চেষ্টা করতে হয়। এ চেষ্টা হতে হবে আন্তরিক। নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু যদি কেউ অন্যের দোষ খোঁজার জন্য চেয়ে থাকে, সে তো নিজের দিকে ফেরার সময়ই পায় না। পাবে না। না পেলে কি হয়?
হয় নিজের দোষে ডুবে থাকে। অথচ অন্যের দোষের সমালোচনা করার অভ্যাস জেগে ওঠে। যে কাজ নিজে করে, সে কাজই অন্যে করলে দোষ হয়ে যায়। কিন্তু তারটি দোষ নয়! নিজে করলে তা ঠিক। অন্যে করলে বেঠিক।
আবার নিজের একটি মতামত আরেক জনের ওপর চাপিয়ে দেয়ার মানসিকতা কাজ করে। একেকজনের কাজে ধরন একেক রকম। প্রত্যেকেরই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। অন্যের বৈশিষ্ট্যের প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। কোনোভাবেই অন্যের ওপর নিজের মত চাপিয়ে দেয়া ঠিক নয়! এটিও অন্যায়ের মধ্যে পড়ে। নিজেকে অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাবার মানসিকতা লোভী হয়ে ওঠে। যা মোটেই ঠিক নয়।

তবে এ কথা সত্য, যদি কারো দোষ চোখে পড়ে তাহলে আন্তরিক উচ্চারণে ধরিয়ে দেয়া যায়। ধরিয়ে দিতে হবে যার দোষ তাকে। অবশ্যই তা সংশোধনের লক্ষে হতে হবে। কোনোভাবেই টিককারি করা চলবে না। চেতানো যাবে না। অপমান করা যাবে না। লজ্জা দেয়াও যাবে না। এবং একের দোষ অন্যের কাছে বলে বেড়ানো পরিহার করতে হবে। শুধু যার দোষ তাকে বলতে হবে। তার দৃষ্টিতে আনতে হবে। ভদ্রতার সাথে। নম্রতার সাথে বলতে হবে। বলার ভঙ্গিটা হতে হবে আন্তরিক। তবেই দোষী সংশোধন করবে তার দোষ।
এখানেও কথা আছে। যে দোষটি ধরিয়ে দেবে সে দোষ নিজের ভেতর আছে কিনা দেখতে হবে আগে। নিজের ভেতর দোষ রেখে অন্যের দোষ ধরা একেবারেই অনুচিত। এটি লজ্জারও বটে। কখনও কখনও এমন অবস্থায় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তাহলে এটিই সত্য যে আগে নিজে দোষমুক্ত হতে হবে। তারপর সম্ভব হলে অন্যের দোষ সংশোধন করা যেতে পারে।
সব থেকে বড় কথা- দোষ ধরার জন্য অন্যের দিকে নয় নিজের দিকে ফিরতে হবে। নিজের দোষ চিহ্নিত করতে হবে। নিজেকে দোষমুক্ত করতে হবে। তারপর অন্যের কথা। প্রত্যেকে নিজে নিজের দোষ সংশোধন করে নিলে সমাজে আর কোনো সমস্যা থাকে না। দেশেও না। পরিবারেও না। আমরা সবাই নিজেই নিজের দিকে ফিরবো। নিজেকে সংশোধন করবো। এবং নিজেকে করবো উন্নত মানুষ।

Share.

মন্তব্য করুন