বিশ্বজুড়ে  মহামারী নোভেল করোনা (কোভিড-১৯) ছড়িয়ে পড়ার কারণে বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশে লকডাউন ঘোষণা করে প্রত্যেকটি দেশ। স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে নিরাপদ থাকতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ করে দেয়া হয়। স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ যাবতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। দীর্ঘ ১৪ মাসব্যাপী এই ছুটি যেনো শেষ হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের। পড়ালেখা থেকে সিটকে পড়েছে অনেক শিক্ষার্থী। আবার অনেক শিক্ষার্থীর অলস মস্তিষ্কে বাসা বেঁধেছে নানান ধরনের অনলাইন গেম। আসক্ত হয়ে পড়েছে গুরুতরভাবে। সুহানের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম নয়। সুহান এবার জেএসসি পরীক্ষার্থী। শিক্ষার্থী হিসেবে বেশ মেধাবী ও মনোযোগী। কিন্তু দীর্ঘ এই স্কুল ছুটির কারণে বাসায় থেকে থেকে সুহান যেনো অন্য এক জগতে পা বাড়িয়েছে। লকডাউন আর স্কুল বন্ধ থাকার কারণে সুহানের মা সুহানকে বাড়ির বাইরে যেতে দেন না। সারাদিন ঘরে বসে থাকতেই কড়াকড়ি নির্দেশ সুহানের মার। সুহানের বাবা একজন প্রবাসী। সৌদি আরবের একটি অ্যাগ্রোফার্মের সুপারভাইজার। মাসিক বেতন ১৪০০ থেকে ১৮০০ রিয়াল।

পরিবারে একমাত্র ছেলে সুহান। স্কুল বন্ধের আগে সুহান পাড়ার ছেলেদেরকে নিয়ে বিকেলে প্রায়ই ক্রিকেট, ফুটবলসহ নানা ধরনের খেলাধুলা করত। ঘরে ফুটবল, ক্রিকেট ব্যাট-বলসহ সব ধরনের খেলনা ঘরে আছে। কিন্তু এই লকডাউনে কোথাও যাওয়া যাবে না। উঠোন আর কাঠবাগানের মাঠ ছাড়া কোথাও বের হতে পারে না সুহান। সুহানের মা সুহানকে উঠোন আর কাঠবাগানে খেলাধুলা করতে বললেও সে তাতে রাজি না। সারাদিন ঘরে বসে থাকে আর ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

সুহান একদিন তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা বাবাকে বলো যে, আমার জন্য একটি স্মার্টফোন পাঠাতে। মা বলল, তোমার তো ল্যাপটপ আছে তারপরও কেনো স্মার্টফোন? সুহান বায়না ধরল, তাকে স্মার্ট ফোন না দিলে সে পড়াশোনা করবে না। এমনকি কোনো কথাবার্তাও শুনবে না। সুহানের মা বিষয়টি সুহানের বাবাকে জানালে সুহানের বাবা ভালো মানের একটি স্মার্টফোন পাঠিয়ে দেয়। সুহান ফোন পেয়ে খুবই খুশি।

কিছুদিন পর সুহান অনলাইনে পাবজি, ফ্রি-ফায়ারসহ নানান ধরনের খেলা মোবাইলে ইনস্টল করে এবং খেলতে থাকে। এমনিভাবে কয়েক মাস কেটে যায়। একদিন সুহানের স্কুল থেকে ফোন আসে। সুহানের মা জানতে পারে জুম অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইন ক্লাস নেয়া হবে। সুহান যেনো নিয়মিত ক্লাস করে। সুহানের মা সুহানকে বিষয়টি জানায়। সুহান বলে ঠিক আছে আমার তো মোবাইল আছেই। আমি ক্লাস করতে পারবো। আর এদিকে সুহান ক্লাসের নামে বসে বসে পাবজি আর ফ্রি-ফায়ার খেলছে হররোজ। সুহানের মা ততটা খোঁজ খবর না নেয়াতে সুহান আরো বেশি সুযোগ পেয়ে বসল। ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, সুহান নিয়মিত নাওয়া-খাওয়াও ভুলতে বসেছে। সারাদিন শুধু অনলাইন গেম আর ভিডিও চ্যাটিং।

একদিন সুহান তার মাকে বলে, মা এক সপ্তাহ যাবৎ আমার প্রচ- মাথা ব্যথা করছে। চোখেও যেনো ঝাপসা দেখছি। এ কথা শুনে সুহানের মা সুহানকে ডাক্তার দেখায়। ডাক্তার বলেছে, আপনার ছেলের ঘুম কম হয় বিধায় মাথা ব্যথায় ভুগছে। তবে ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি ঠিক হয়ে যাবে আর নিয়মিত ঘুমোতে হবে। সুহান খেলার প্রতি এতো আসক্ত হয়ে উঠেছে যে, সে কারো কোনো কথাই শুনে না। আরো বেশি করে রাত জেগে জেগে অনলাইন গেম খেলতে থাকে। সুহানের মা বিষয়টি জানার পর সুহানকে প্রচুর রাগ দেখায় কিন্তু সুহান তা আমলে নেয় না। এভাবে চলতে থাকে আরো বেশ কিছুদিন। সুহানের মা ভয়ে সুহানের বাবাকেও বিষয়টি জানায়নি। সুহানের অনেক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে- যেমন, সে কোনো কথাবার্তা শুনছে না, দিনে দিনে রোগাটে হয়ে যাচ্ছে, বদমেজাজি আর উগ্র হয়ে উঠছে। গেম খেলার এমবির টাকা না পেলে সে মাকে টাকা দেয়ার জন্য জোর জবরদস্তি করছে।

ঘরে খাবারদাবার খাবে না বলে হুমকি দিচ্ছে। সুহানের মা নিরুপায় হয়ে বাধ্য হচ্ছে টাকা দিতে। এই ১৪ মাসে পূর্বের সুহান আর এখনকার সুহানের মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখা দিয়েছে। সুহানের মা নীরবে চোখের জল ফেলছে। অতি আদরে এবং মোবাইল কিনে দেয়ার কারণে আজ তার এমতাবস্থা। এভাবেই চলছে সুহানের দিনকাল। ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে সুহান। সুহানের নিজেরও জানা নেই সে কোন দিকে এগোচ্ছে। কি তার ভবিষ্যৎ। তার মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে কিভাবে গেমগুলোর প্রতিটা পর্ব শেষ করা যায়। কিভাবে সবার থেকে লেভেল কমপ্লিট করে এগিয়ে থাকা যায়। দিনের পর দিন পার হচ্ছে এভাবেই। এরকম নাম না জানা সুহানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশায় ভুগছে অভিভাবক, দেশ ও জাতি। বই ছেড়ে স্মার্টফোন ধরার কুফল যেনো জ্যামিতিক আকারে বেশ পরিধি ধারণ করছে। সুহানদের মতো শিক্ষার্থীরা সিটকে পড়ছে ধ্বংসের মুখে।

Share.

মন্তব্য করুন