আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই তো কবি বলেনÑ ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। উপযুক্ত পরিচর্যা দিয়ে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে হবে। বর্তমানকে যদি আমরা মূল্য দেই তাহলেই আমরা অর্জন করতে পারবো সুন্দর ভবিষ্যৎ। তাই তো ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ যথার্থই বলেন, ‘‘শিশুরাই জাতির পিতা।’’ শিশুদের সম্পর্কে বলতে যেয়ে চিন্তাবিদ Anon বলেন, “He who holds the souls of the children, holds the nation. আজকের বালক আজকের তরুণ বড় হয়ে জাতীয় জীবনে বৃহত্তম ভূমিকা পালন করবে। এজন্য আমাদের উচিত প্রতিটি শিক্ষার্থীকে বাল্যকাল থেকে সুকুমার প্রতীভাকে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করা এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করা। নয়তো একটি সম্ভাবনাময় সমাজ ধ্বংস হবে।

শিশুরা খেলাধুলা করবে এটা ঠিক হলেও অনেকে মনে করেন শিশুরা যদি খেলাধুলা বাদ দিয়ে গঠনমূলক কাজে মনোনিবেশ করে তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে ভালোভাবে। কিন্তু অনেকে শিশুর খেলাধুলা শৈশবকালীন বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ ব্যাপারে বলতে যেয়ে মনোবিজ্ঞানী Bruner বলেন, “আমরা জানি যে খেলা শিশুর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া অনেকে একত্রিত হওয়ার প্রধান উপায় হচ্ছে খেলা। নিয়মমাফিক খেলা করার মাধ্যমে শিশুর সাংস্কৃতিক বিধিনিষেধের বাধা অতিক্রম করে কচি মনের কামনা বাসনা পূর্ণ করে।’’

শিশুদের ব্যক্তিসত্তার বিকাশ সম্পর্কে বলতে যেয়ে মনোবিজ্ঞানী টমাস ও অন্যান্যরা তিন শ্রেণীর শিশুর কথা বলেন। যারা (১) সহজ শিশু (Easy children) (২) সমস্যা সৃষ্টিকারী শিশু (difficult children) (৩) ধীরস্থির শিশু (Slow-to warm-up children)। সহজ শিশুরা শারীরিক ও মানসিক উভয় আচরণে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে। সমস্যা সৃষ্টিকারী শিশুরা দেরিতে আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাদের শারীরিক শৃঙ্খলা সুনিয়ন্ত্রিত নয়। ধীরস্থির শিশুরা দ্রুতগতিতে আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
শৈশবকালে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিপত্তি গুরুতর আকার ধারণ করে। শিশুদের হীনম্মন্যতা দেখা দেয় তাদের পড়াশুনা ও খেলাধুলায় হাত, পা, ব্যবহারের মাধ্যমে ও বেমানান আচরণের মাধ্যমে। অধিকাংশ পঙ্গু শিশুদের ক্ষেত্রে সকলের সাথে মেলামেশা করতে পারে না বলে অনেক সময় কাল্পনিক অক্ষমতার পরিচয় দিয়ে থাকে। একটি শিশু দুর্ঘটনায় পড়লে মানসিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। তারা সতর্কতা অবলম্বন করে থাকে পরবর্তীতে খেলার ক্ষেত্রে। ফলে ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও পড়াশুনায় সামাজিকীকরণ লোপ পায়। সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র, খর্বাকৃতি এবং নাদুসনুদুস মোটা শরীরের ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রে সময় বেশি দরকার হয়। ফলে তারা পিছিয়ে পড়ে। মেয়েরা ছেলেদের মত এবং ছেলেরা মেয়েদের মত হলে হাসি তামাশার পাত্র হতে পারে। ফলে সামাজিক অভিযোজন ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়। সেটা শিশুরা খেলাধুলায় নিপুণতা অর্জনে অনেক সময় ব্যর্থ হয়। অসুস্থ শিশু যারা দীর্ঘদিন রোগে ভোগে তাদের পড়াশুনা ও শারীরিক ও মানসিক বিকাশ অন্যান্য সুস্থ ছেলে-মেয়েদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে। অনেক সময় তাদের পিতা-মাতা অর্থনৈতিক ও মানসিক দিক দিয়ে হতাশার ভিতর পতিত হন। শিশুদের মধ্যে যাদের চেহারা ও বাচনভঙ্গি ভালো তারা দলনেতা নির্বাচিত হন। কিন্তু খর্বাকার রোগা শিশু এটা থেকে বঞ্চিত হয়।

শিশুদের শারীরিক বিপত্তির মত মানসিক বিপত্তিও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। দৈহিক দিক দিয়ে মেয়েরা ছেলেদের থেকে দুর্বলতার আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে, ফলে তারা লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে। এক একজন শিশু এক একটি বিষয়ের প্রতি আগ্রহ প্রদর্শন করে থাকে। একজন যার প্রতি আগ্রহ দেখায় অন্য জন তার প্রতি আগ্রহ নাও দেখাতে পারে। নৈতিক দিক দিয়ে একটি শিশু আদর্শের মাধ্যমে পরিবার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। আবার শাস্তির ভয়ে তার ভিতর আক্রমণাত্মক মনোভাবের সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীরা আদর্শগত ধারণার সাথে গরমিল হলে মানসিক অশান্তি তার মনের ভিতর বাসা বাঁধে। শিশুরা খেলাধুলার ক্ষেত্রে স্বীকৃতি অর্জনের ব্যর্থ হলে নিয়মনীতি শেখা থেকে বঞ্চিত হয়। শিক্ষার্থীদের যাদের একই বয়স উপেক্ষার পাত্র হলে হীনম্মন্যতায় ভোগে। ফলে শিশু মনে পড়ে তার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব। ভুল উচ্চারণ, তোতলামি, যেমন খারাপ তেমন রাগ, ঈর্ষা, চেঁচামেচি প্রভৃতিও খারাপ। এ ধরনের শিশুদের কেউ দেখতে পারে না।

শিশুদের সার্বিক বিকাশে আমাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পায়ে হাঁটা অথবা সাইকেলে বিদ্যালয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে উক্ত বিপত্তির ক্ষেত্রে কিছুটা যে উন্নয়ন করে তা বলা যায়। শিক্ষার্থীদের হেঁটে বা সাইকেলে বিদ্যালয়ে যাতায়াতে উৎসাহিত করার জন্য আমাদেরকে জানতে হবে শারীরিক পরিশ্রম ব্যায়াম এবং হেঁটে যাওয়ার ক্ষেত্রে কী কী সুবিধা আছে। যা শারীরিক ও মানসিকভাবে শিক্ষাথীদের উপকারে আসে। শিক্ষার্থীরা যদি জানে যে হেঁটে বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপকারিতা তাহলে সে ঐ ধরনের কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে না। হেঁটে বা সাইকেলে বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপকারিতার কথা বলা যাক।
প্রতিদিন হাঁটলে শরীরের শক্তি পুনরুজ্জীবন ঘটে। বিশ মিনিট আউটডোরে হাঁটা ২০ মিনিট ইনডোরে হাঁটার চেয়ে ভালো। এক কাপ কপি পানের চেয়ে দশ মিনিট হাঁটা ভালো। হাঁটলে মন মেজাজ উন্নত হয়। আত্মোন্নয়ন ঘটে। অবসাদ দূর করে। হতাশা এবং উদ্বিগ্নতা হ্রাস করে। হাঁটা দৈনিক কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। দৈনন্দিন কার্যাবলিতে গতি আনে। ওজন নিয়ন্ত্রণ করে। ৩০ মিনিট মধ্য গতিতে হাঁটা ১৫০ ক্যালেরিকে বার্ন আপ করে। প্রতিদিন হাঁটলে শরীরের জড়তা দূর হয়। হার্ট, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার রোগ নিরাময় হয়ে থাকে। এবং এই সমস্ত রোগের ঝুঁকি কম হয়। সিঁড়ি থেকে ওঠানামা পায়ে চালিত কল যেমন সাইকেল চালনায় অভ্যাস করা ভালো, মানসিক নির্মলতা বৃদ্ধি এবং ব্রেনের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে এবং Brainstorming  কাজ করার জন্য হাঁটা উপকারী। রাতে সুনিদ্রা আনয়ন করে, হাঁটা বাইরে রৌদ্র উজ্জ্বল উত্তপ্ত আবহাওয়ায় উপযুক্ততা আনয়ন করে। হাঁটা আহারে রুচি আনে, ক্লান্তিবোধ হয় এবং জীবনীশক্তি বৃদ্ধি করে।

বন্ধুদের সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশ নির্বাচন কর অথবা আশপাশে প্রতিবেশীদের সাথে হাঁটো। একসাথে হাঁটা অথবা গল্প করা তোমার উদ্দেশ্যকে সফল করে তুলতে পারে। তুমি বাস অথবা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার পরিহার কর যদি তোমার Walking Distance মধ্যে হয়ে থাকে স্কুল। ছাত্র-ছাত্রীদের হাঁটা অথবা সাইকেলে বিদ্যালয়ে যাওয়া সহজ। কারণ এই বয়সে তারা জয়ী হতে শেখে। তারা যদি তাদের শরীরের ও মানসিকতার উন্নয়নের উপর জ্ঞান অর্জন করতে পারে তাহলে এর সুফল থেকে নিজকে দূরে রাখতে পারে না। সুতরাং শরীরের ভালো-মন্দের বিষয়গুলো আমরা যদি তাদের ক্লাসের মাধ্যমে এমনকি যদি টেক্সটবুক বোর্ড এ সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করেন তাহলে আর ও ভালোভাবে বিষয়টি আয়ত্ত করতে পারবে।

শিশু, কিশোর তথা শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে নিম্নে বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করা যেতে পারে:
ষ শিক্ষার্থীদের বিষয়টি জানার ক্ষেত্রে উৎসাহ সৃষ্টি করার জন্য রচনা প্রতিযোগিতা আয়োজন করা যেতে পারে। যাতে তারা বিষয়টি নিয়ে আরও চিন্তা-ভাবনার সুযোগ পায়।
ষ শিক্ষার্থীদের যারা প্রতিদিন পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে আসবে তাদের মাসিক রিপোর্টের ভিত্তিতে যারা সবচেয়ে বেশি আসবে তাদের পুরস্কার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীরা বিষয়টির প্রতি আগ্রহ জন্মাবে।
ষ শিক্ষার্থীদের আর্থিক উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে। কারণ তারা যদি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় তাহলে তারা বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে দেখবে। তারা বিদ্যালয় অথবা মহাবিদ্যালয়ে যাতে যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারে।
ষ শিক্ষার্থীদের প্রথম শিক্ষক হলেন পিতা-মাতা। নেপোলিয়ন বলেছিলেন- ‘‘Give me an educated mother, I shall give you a educated nation.’ পিতা-মাতা তার ছেলে মেয়েদের সবচেয়ে কাছের। তারা তাদের যদি পায়ে হেঁটে অথবা সাইকেলে বিদ্যালয় যেতে উৎসাহ জোগায় তাহলে পিতা-মাতাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পুরস্কার প্রদান করতে হবে।
– শিক্ষকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কারিগর। তারা ছাত্র তৈরি করে থাকেন। তারা যদি উৎসাহ জোগায় ছাত্র-ছাত্রীদের তাহলে শিক্ষার্থীরা তাদের উৎসাহে উৎসাহিত হবেন।

– শহরে দেখা যায় এক কিলোমিটার যেতে ঘণ্টা পার হয়ে যায় যানযটের কারণে। ফলে টাইম কিল হয়। শিক্ষার্থীরা যদি পায়ে হেঁটে অথবা সাইকেলে যায় তাহলে এ ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হবে না।
– সমাজে যারা গুরুজন তারা তাদের কাছের ছেলে-মেয়েদের সেইভাবে শিখিয়ে থাকে। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা যেমন পিতা, মাতা, ভাই বোন শিক্ষক, শিক্ষিকাদের কাছ থেকে শেখে, তদ্রƒপ সমাজের গুরুজনদের কাছ থেকেও শিখে থাকে।
তা ছাড়া পত্রপত্রিকা টেলিভিশন রেডিওতে এ ব্যাপারে প্রচার প্রসার করতে হবে যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা সহজে বিষয়টি আয়ত্ত করতে পারে। ব্যাপকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং দৈহিক ও মানসিকভাবে বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোরদের জীবনীশক্তি বৃদ্ধির জন্য যাতে তারা আরও তৎপর হয়। তাই আমরা বলতে পারি শিশু-কিশোরদের হেঁটে সাইকেলে বিদ্যালয়ে যাতায়াতে উৎসাহিত করতে পারলে একটি সুস্থ জাতি গঠিত হবে। জাতি হবে আরও গতিশীল।

Share.

মন্তব্য করুন