আধুনিক প্রযুক্তির বিশেষ আবিষ্কার ইন্টারনেট, ই-মেইল ও মোবাইল। সময়ের দৌঁড়ে মোবাইল আজ অতি প্রয়োজনীয় বহুল ব্যবহৃত যন্ত্র। যা বিশ বছর আগেও ছিল দুর্লভ। খেটে খাওয়া দিনমজুর থেকে শুরু করে আজ সবার হাতে হাতে মোবাইল সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। ভাবনার আকাশে মাঝে মাঝেই ভেসে ওঠে সেই সব স্মৃতি যখন চিঠির প্রচলন ছিল, টেলিভিশনের প্রোগ্রাম ছিল বাঁধাধরা। পত্রিকা-ম্যাগাজিন ছিল জগৎ জানার মাধ্যম। বাবা-মার আদর ভরা শাসন ছিল, ছিল দাদা-দাদীর মমতার আঁচল। প্রকৃতির রূপচ্ছটায় দেখা মিলত নাম না জানা ফুলের সাথে খেলা হতো নানা রং এর প্রজাপতির সাথে। পরিচয় হতো নদীর সাথে মাছের সাথে। সাঁতার কাটা, ফুটবল, ক্রিকেট, হাডুডু সবধরনের খেলায় আনন্দে ভরে উঠত শৈশব-কৈশোর এর রঙিন দিনমান। এ সময়েই মানুষ অন্তহীণ স্বপ্নের আকাশ বোনে আনন্দমনে। নতুন মাত্রায় নতুন শব্দে বেজে উঠে প্রাণের বীণা।

সময়ের হাত ধরে চলে কাজের গতি। এগিয়ে যাচ্ছে প্রজন্মের ধারা। সর্বত্র সহজলভ্য হয়ে উঠেছে মোবাইল। যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম একটি মাধ্যম আজ মোবাইল। বিশেষত বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে এর আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য। এর ভালো দিক অবশ্যই রয়েছে। বিশ^কে এক মুঠোয় এনে দিয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক খবর, বিভিন্ন তথ্য, ছবি, ভিডিও, মেসেজিং, তাৎক্ষণিক চলমান ঘটনা ছাড়াও নানাকাজে সহযোগী হয়ে উঠেছে মোবাইল। জীবনকে নতুন করে ভাবনার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। সমুদ্রের তলদেশ থেকে ভূমণ্ডলের চিত্র-বিচিত্রতার রসদ এখন হাতের মুঠোয়। সাহিত্য সংস্কৃতি লালনে শিশু-কিশোর থেকে সবধরনের মানুষের মনের বিকাশে ভূমিকা রাখছে মোবাইল। সহজেই স্বরচিত কবিতা, গল্প, গানের মাধ্যম হয়ে উঠছে। হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের ফিরে পাওয়ার আনন্দের সাথে যোগ হচ্ছে ভালোবাসাময় অভিনন্দনের।

প্রশ্ন উঠে মনে আমরা আসলে কতটা বড় হতে চাই। কোনোকিছু জানার বা শেখার মধ্যেই বড় হবার আনন্দ। আনন্দ জীবনের নতুন নতুন পাঠ রপ্ত করায়। জগৎ জানার নির্মল আনন্দই পারে একজন মানুষকে মনের পৃথিবীর বাদশাহ করার। নাহলে মন কখনও নতুনকে পারে না গ্রহণ করতে। পৃথিবীর ইতিহাসে আজ যারাই বড় হয়েছেন বিখ্যাত হয়েছেন তারা সকলেই প্রযুক্তির ব্যবহারে সময়ের সাথে কৌশলে এগিয়ে গেছেন। নতুনকে স্বাগত জানাতে মন সদা প্রস্তুত থাকে। একারণেই পথ চলার আনন্দ যোগ হয় জীবনে। কারণ যেখানে শেষ সেখান থেকেই শুরু নতুন পথের। এভাবেই পৃথিবী এগিয়ে চলছে নতুন-পুরাতনের পথ পেড়িয়ে।

আনন্দিত জীবনের নতুন নতুন বিষয় কখনও কখনও চিন্তা ও অস্থিরতা হিসেবে দেখা দেয়। মোবাইলের ব্যবহার অনেকাংশে সেইরূপে বর্তমানে আবির্ভূত। বয়সের সীমারেখা অতিক্রম করে যাচ্ছে মোবাইল আসক্তি। পাশাপাশি বসে থাকা মানুষজনও আজ অপিরিচিত। কেউ কাউকে দেখছে না, শুনছে না। চোখের সামনেই কোনো দুর্ঘটনায় সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছে। সহমর্মিতা কমে যাচ্ছে। অনর্থক কথা বলা, মেসেজ করা, গেমস খেলা বা নানা ধরনের এডাল্ট দৃশ্য দেখার প্রবণতায় লিপ্ত হচ্ছে তরুণ-তরুণীরা। কখনও কখনও হেড ফোন কানে দিয়ে কথা বলা বা গান শোনায় ঘটে যাচ্ছে দুর্ঘটনা। বেপরোয়া মনোভাবের দেখা মিলছে এদের মধ্যে। মন যখন সুন্দরের প্রতি আকর্ষিত হবে না তখন সৃষ্টির রহস্যের দরজাগুলোও খুলবে না। সৃষ্টির রহস্য অনুসন্ধানের ইচ্ছে মনকে স্বচ্ছ রাখে, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসায় ঋদ্ধ হয়।

একটি সংসারে নতুন আলো নিয়ে হাজির হয় একটি শিশু। অনেক বেশি উৎসাহ আনন্দে ভালোবাসায় শিশুটিকে গ্রহণ করি সবাই। আমাদের সব আশা-আকাঙ্খার জায়গা তৈরি হতে থাকে শিশুটিকে ঘিরে। হামাগুড়ি দিয়েই শিশুটি হাতে পেয়ে যায় মোবাইল। ছোটদের মেধা থাকে পরিষ্কার, খুব অল্প সময়েই নতুনকে গ্রহণ করে সহজেই। মায়েরাও বাচ্চাটা কান্না করবে না ভেবে ছেড়ে দেয়, খেলুক কিছুক্ষণ। এই যে কিছুক্ষণ এটাই ধীরে ধীরে শিশুটির মন মস্তিষ্ককে গ্রাস করতে থাকে। আসক্ত হয়ে পড়ে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠা শিশুটি। মোবাইলবিহীন বাচ্চাটিকে কোনো কথা শোনানো যায় না। খাওয়ানোও কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। ফলে বাধ্য হয়ে বাবা-মা মোবাইলকে মেনে নিয়ে চলে। কিন্তু এটা একসময় আর খেয়াল থাকে না যে বাচ্চাটা কী দেখছে। সৃষ্টির সুন্দরকে না দেখে অসুন্দর চিত্র এসে বাচ্চার মনোজগতকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। সোনালী যে দিনগুলো অপেক্ষমান সত্যিকারের মানুষ হবার জন্য, সেখানে একটি শিশুর বিকাশে প্রযুক্তির ব্যবহারের উপকারী দিক বিশ্লেষণের সময় এখনই।

সময়ের সাথে বেড়ে উঠা বাচ্চাদের বয়স অনুযায়ী অনেক ধরনের খেলাধুলা থাকে যা তাকে পরিণত বিকাশে সহযোগিতা করে। এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চারা সবক্ষেত্রেই অনুকরণপ্রিয়। বড়দের তারা যা করতে দেখে তাই তারা করতে ভালোবাসে। এবং তখন সেই কাজটিও তাদের কাছে সঠিক বলে মনে হয়। একদিন ট্রেনে চড়ে রাজশাহী থেকে ঢাকায় ফিরার পথে একটি আট কি নয় বছরের বাচ্চার হাতে বই দেখে পাশেই বসা একজন ভদ্রলোক প্রশ্ন করল ছেলেটিকে। বাবু তুমি কি বই পড়ছ? ছেলেটি উত্তরে বলল একটি গল্পের বই। ভদ্রলোক আবার বললেন তুমি কি সবসময়ই বই পড়? ছেলেটি উত্তরে বলল জ¦ী। লোকটি ভীষণ অবাক হয়ে পাশেই বসে থাকা বাচ্চাটির মার কাছে এ বিষয়ে কৌতুহল প্রকাশ করল। তখন বাচ্চাটির মা বলল, আমি কাজের ফাঁকে সবসময়ই বই কাছে রাখি। এবং ছেলের সাথে তা গল্প করি। সেই থেকে আমার ছেলের মধ্যেও বই পড়ার ইচ্ছে প্রবেশ করেছে। ছেলেটির মা আরও বলল বাচ্চারা তাই করে যা তার মা-বাবাকে করতে দেখে। লোকটি মুগ্ধতা নিয়ে পরিবারটিকে দেখতে লাগল। সবক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রযোজ্য না হলেও বেশির ভাগই বাবা-মার ছায়া থাকে বাচ্চাদের মধ্যে। তাই বাচ্চাদের মোবাইল আসক্তি থেকে দূরে রাখতে হলে আগে নিজেদেরকে সংশোধনের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনীয় কাজের বাইরে বাচ্চাদেরকে মোবাইল হতে দূরে রেখে তাদের জন্য খেলার পরিবেশ দিতে হবে। শুধু তাই না বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের খেলার সাথী হতে হবে আমাদের। শিক্ষামূলক নানাধরনের গল্প তাদের মনে আনন্দ এনে দিবে। সৃষ্টিজগতের রহস্য অনুসন্ধান এবং বয়সের ব্যবধানে দায়িত্বানুভূতিই পারে জীবনগঠনে ভূমিকা রাখতে।

বর্তমান সময়ে করোনা পরিস্থিতি বাধ্যতামূলকভাবে সবার হাতে মোবাইল ব্যবহার সহজ করে দিয়েছে। যুব সম্প্রদায় মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন আজ। স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয় বন্ধের মধ্য দিয়ে অনলাইন ক্লাসের প্রয়োজনীয়তা স্বাভাবিকভাবেই মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারে বাধ্য করছে। আন্তর্জাতিকভাবেও অন্যান্য দেশের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম মোবাইল ইন্টারনেট। বিশ^মহামারীর এ সময়ে যদিও প্রয়োজনেই ব্যবহৃত হচ্ছে মোবাইল তবুও প্রশ্ন জাগে মনে, সত্যিকারে আমাদের বাচ্চারা কতটুকু শিখছে? কতটুকু জানছে? কতটুকুইবা প্রয়োগ করছে? পরীক্ষার নামে বাচ্চারা বাসায় বসে পরীক্ষা দিচ্ছে। তারা কি সততা ধরে রাখতে পারছে? নাকি পড়া ফাঁকি দেয়া, দেখে দেখে পরীক্ষা দেয়া রপ্ত করছে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে কী অপেক্ষা করছে? আমাদের সন্তানরা কীভাবে তৈরি হচ্ছে। কিভাবে তাদের স্বপ্নরা আকাশ দেখছে। তাদের চিন্তার বলয়ে ভবিষৎ কে কেমনরূপে আঁকছে।

জীবনের সাফল্যের জন্য মানুষকে অনবরত চলতে হয় পথ। বড় হবার জন্য বড় স্বপ্ন থাকা চাই। সুন্দর একটি স্বপ্নই জীবনকে গুছিয়ে দিতে পারে। প্রতিটি সময়কে খুব গুরুত্বের সাথে নিয়ে এগুতে হয়, যাতে নতুন সময় কাজের হয়ে উঠে। আজকের দিন যদি প্রতিদিনের হয়ে উঠে তাহলেই জীবন হবে আনন্দের। এসবই ভাবনার সময় এসেছে। মোবাইলের ব্যবহার কতটা ক্ষতি করছে তা উপলব্ধির সময় এখনই। সময় চলে গেলে তাকে আর ফিরে পাওয়া সম্ভব না। পারিবারিক গঠনমূলক পরিকল্পনাই পারে এহেন পরিস্থিতিতে সন্তানদের সঠিক দিক নির্দেশনার।

কোমলমতি শিশুরা চায় আনন্দ নিয়ে বড় হতে, চায় প্রতিদিনের নতুনত্বের সাথে পরিচিত হতে। মোবাইলে বাচ্চাদের জন্য যেসব গেমস, মুভি, কার্টুন তৈরি হচ্ছে তাতে তারা শুধু শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তিবোধে আক্রান্ত হচ্ছে। তাই তারা নতুন কিছু সৃষ্টি করা হতে পিছিয়ে পড়ছে। এবং মোবাইলের যে আলোর রিফ্লেক্স তা চোখের সমস্যা তৈরি করছে। এখন ছোট ছোট অনেক বাচ্চাদের চোখেই চশমা দেখতে পাওয়া যায়। ইদানিং আরো একটি নতুন বিষয়ের দেখা মেলে মোবাইলে। নাম তার টিকটক ও লাইকি। এটা শুধু এক ধরনের খেলা নয় এটি টাকা উপার্জনেরও একটি মাধ্যম। ফলে সব বয়সের বাচ্চারা এতে চরমভাবে আসক্ত হয়ে নিজেদের সংস্কৃতি থেকে নিজস্ব জগৎ হতে দূরে সরে যাচ্ছে। পিছিয়ে পড়ছে জ্ঞানের আলো হতে। যুগ ও সময় ধরে এগুতে প্রয়োজন পরিকল্পিত জীবন। জীবনকে জীবনের পক্ষে জাগিয়ে রাখার আনন্দ নিতে হবে। কারণ পৃথিবী সুন্দর। মানুষই সেই সুন্দর লালন করে, চর্চা করে এবং জীবনকে সাজাতে এর প্রচার প্রসার ঘটায়। বিশ^জগতের সর্বত্র সুন্দর ছড়িয়ে আছে শুধু প্রয়োজন তা খুঁজে নেয়া। মানুষকে ভালোবাসার আনন্দের মতো সুখ কিছুতেই নেই। একটি সুস্থ ও সুন্দর পরিকল্পনাই পারে সামনের দিনগুলোকে সাজাতে। একজন মানুষ হবার আনন্দ দিতে। মোবাইলের মাধ্যমে বাচ্চারা যখন সহজেই গুগুল সার্চ করে অনেক খবর ও তথ্য পেয়ে যায় তাই প্রয়োজনীয় কাজের বাইরে বাচ্চাদের হাতে মোবাইল না থাকার বিষয়ে অধিক যত্নশীল হতে হবে বাবা-মাসহ সবাইকে। সোনালী দিনের স্বপ্নময় জীবনের তাগিদে প্রযুক্তির বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এভাবেই আনন্দচিত্তে সম্মুখে এগিয়ে যাবে প্রজন্ম।

Share.

মন্তব্য করুন