এখন স্কুল বন্ধ। স্কুল বন্ধ মানে কিন্তু লেখাপড়া বন্ধ নেই। কেউ পাঠ্যবই নিয়ে নিজ মনে নিজে উদ্যোগী হয়ে পড়ছে। আবার কেউ বই ফেলে নিজমনে খেলছে। প্রত্যন্ত গ্রামে তাই হচ্ছে। কিন্তু শহরে বেশির ভাগ স্কুলে অনলাইনে লেখাপড়া হচ্ছে। জুমক্লাস এখন শিশু-কিশোরদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করছে। জুম ক্লাসের জন্য ক্লাসরুমের জায়গায় একটা মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ হলেই চলে। স্কুল টিচাররা তাতে ক্লাস নিচ্ছেন আর শিক্ষার্থীরা মোবাইলে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে লেখাপড়া বুঝে নিচ্ছেন। ক্লাসনোট, হোমওয়ার্ক, নোটিশ, অনলাইন পরীক্ষার রুটিন, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, সবকিছুই একটা সেলফোনের মাধ্যমেই খুব সহজেই দেয়া নেয়া চলে। এতে করে খুব সহজেই ছোট বয়স থেকেই শিশু কিশোররা প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হচ্ছে। প্রযুক্তির ব্যবহার শিখছে। সহজেই ছাত্র-শিক্ষকের যোগাযোগ ঘটছে। আগে বিশাল ক্লাসরুমে একজন শিক্ষকের সাথে চল্লিশ পঞ্চাশজন ছাত্র-ছাত্রীর যোগাযোগ যেখানে ছিল কষ্টকর। আজ জুম ক্লাসের মাধ্যমে অনায়াসে ছাত্র-ছাত্রীরা সেখানে যে কোন বিষয়ে যে কোন শিক্ষকের সাথে লেখাপড়া বিষয়ে তার প্রশ্ন ও উত্তর তৈরি করে নিতে পারছে। স্কুলকেন্দ্রিক জুম ক্লাসের বাইরেও শিক্ষার্থীরা যে কোন বিষয়ের সমস্যা সমাধান করতে চাইলে অসংখ্য টিউব চ্যানেলের সাহায্য নিতে পারছে। টিউব চ্যানেলগুলোতে বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি, বিজ্ঞান, কী নেই? সব আছে সমাধানসহ। সমাধানগুলোও আছে বিভিন্ন রকম পদ্ধতিতে। ফলে একজন শিক্ষার্থী চাইলে একইরকম অঙ্ক বিভিন্নভাবেই শিখতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষার্থীর মননশীলতা। এভাবে একটা সেলফোন একজন শিক্ষার্থীর সামগ্রিক শিক্ষার কাজ করে।

তবে মুশকিল হচ্ছে, আমাদের যারা স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থী তাদের কাছে টিউব চ্যানেলের অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় বিজ্ঞাপন ও আজেবাজে বিষয়গুলোও না চাইতেই চলে আসে। যা কিনা শিক্ষার্থীদের মননশীলতার জন্য মারাত্মক ক্ষতি সাধন করতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে সজাগ থাকতে হবে। ছোটবেলা থেকেই তাকে মনের দিক থেকে এসব ক্ষেত্রে কঠোর কঠিন মনোভাব এভাবে তৈরি করতে হবে যে, যে জিনিস খেয়ে আমি অসুস্থ হবো, আমার ধ্বংস নিশ্চিত সেসব খাবার যতো লোভনীয়ই হোক না কেন তা খাওয়াতো দূরে থাক, আমরা সেটার কাছেও যাবো না। বিষ বিষাক্ত, খেলেই মৃত্যু, সেটা যত চকচকে মোড়কে লোভনীয়ভাবেই তাকিয়ে থাকুক না কেন, আমরা তার ধারে কাছেও যাবো না, আমাদের ধারে কাছেও সেসব ভিড়তে দেব না। সেলফোনের এসব বিষাক্ত জিনিস হচ্ছে, গেম, ফেসবুক, নাটক, সিনেমা, টিকটকসহ অসংখ্য অ্যাপস। আমরা এসব কুৎসিত জঘন্য ঘৃণ্য জিনিস দেখা শোনা ও খেলা থেকে বিরত থাকব। এ বিষয়ে আমি ছোটবেলা থেকেই কঠিন মনোবল তৈরি করবো। কারণ গেম খেলা আমাদের মনকে সাময়িক মজা দিলেও কয়েকদিনের মধ্যেই এই গেম খেলার কারণে আমাদের মন মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, স্মৃতিশক্তি নষ্ট করে দেয়, ঘুম হয় না, ঘুমের ভেতর গেমের বিষয় আশয় স্বপ্নের মধ্য দিয়ে দেখা দিয়ে মনকে বিচলিত করে দেয়। ঘুম নষ্ট করে, মনকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলে। ছোটবেলা থেকেই এ ভয় নিয়ে বড় হয়, ফলে বড় কোন সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পায়, বড় জায়গায় যেতে ভয় পায়, বড় বড় লক্ষ্য তৈরি করতে পারে না। ফলে মেধা নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়াও ইউটিউব, ফেসবুক, টিকটক, নাটক, সিনেমায় আসক্তি ছোট বয়স থেকেই মনের ভেতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই নেতিবাচক প্রভাবগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানুষ সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করা ও সন্দেহবাতিক করে তোলা। ফলে মন সবসময় সবকিছুতেই নেতিবাচক সন্দেহ তৈরির ফলে, আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারি না। আমরা হাসতে ভুলে যাই, আমরা খুশি হতে পারি না, নিজেদের ভালো চিন্তাগুলোর ওপরও আস্থা হারিয়ে ফেলি। অধিক পরিমাণে মোবাইলে আসক্তি ইন্দ্রিয়শক্তি নষ্ট করে দেয়। বিভিন্ন ধরনের ফুল ফলের ঘ্রাণ নিতে পারে না, কারণ ঘ্রাণেন্দ্রিয় নষ্ট হয়ে যায়। ফলমূল, মাছ-মাংসসহ, বিভিন্ন রকমের খাবারের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়, কারণ স্বাদ নেয়ার শক্তি কমে যায়। নিজের ছোট বড় আনন্দ, নিজ পরিবারের পারিবারিক আনন্দ উৎসব, সুন্দর, দেখার উপভোগ করার উপলব্ধি নষ্ট হয়ে যায়। তাই ছোটবেলা থেকেই সেলফোনের অতিরিক্ত ও অযাচিত ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিজেকেই নিজের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমার প্রয়োজনে মোবাইল। মোবালের প্রয়োজনে আমি না। অর্থাৎ মোবাইল যেন আমাকে গ্রাস করতে না পারে।

১৯৭৩ সালে মার্টিন কুপার প্রথম মোবাইল ফোন আবিষ্কার করেন। বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৯৬ সাল থেকে। ২০১১ সালে ক্যান্সার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএআরসি তাদের সামগ্রিক গবেষণায় সেলফোনকে ক্যান্সারের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। সেলফোন ব্যবহারে হার্টবিট রক্তচাপ ও কোলেস্টেরেলের মাত্রা বেড়ে যায়, যার ফলে স্ট্রোক, হার্ট এটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। গবেষণায় আরো উঠে এসেছে যে, একটা টয়লেটে যে পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া থাকে একটা সেলফোনে তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি ব্যাকটেরিয়া বহন করে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. প্রাণ গোপালের মতে, মোবাইল ফোন ষোলো বছরের কম বয়সীদের জন্য বিপজ্জনক। মোবাইল ফোনের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি মানুষের কানের সমস্যা প্রচণ্ড বাড়িয়ে দেয়। মোবাইলে কথা বলার সময় তার তাপীয় প্রভাব বিস্তারের ফলে, আমাদের স্নায়ুর ক্ষতিসহ, মাথাব্যথা, জয়েন্টে ব্যথা, ঘুম কমে যাওয়া, ও স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়। মোবাইলে তাকিয়ে থাকার ফলে বিভিন্ন ধরনের চক্ষুরোগ ও মস্তিষ্করোগে অনায়াসে খুব সহজেই আক্রান্ত হয়।

তাই স্কুল বন্ধের এই বন্ধ সময়ে মোবাইলে অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয় সময় ব্যয় না করে ছোটবেলা থেকেই নিজেই নিজেকে পরিচালনা করতে শিখি তাহলে কেমন হয়। যেমন নিজের মত করে একটা রুটিন নিজেই তৈরি করে নিলাম। যেমন বেশি রাত না জাগা, দ্রুত অর্থাৎ রাত দশটা এগারোটার মধ্যে ঘুমাতে যাওয়া এবং ভোরে আজানের সাথে সাথেই উঠে পড়া। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই সময়ের মধ্যে ঘুমাতে যাওয়া ও ঘুম থেকে উঠার মধ্য দিয়ে মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসহ মস্তিষ্কেরও অনেক উপকার হয়, পড়লেখা বুঝা ও মুখস্থ খুব সহজেই হয়। এরপর নিজের বিছানা নিজে গোছানো, নিজের বই-খাতা টেবিল চেয়ার নিজে যত্ন নেয়া, নিজের খাবার প্লেট নিজে ধুয়ে রাখা, নিজের কাপড়চোপড় নিজে ধোয়া। রুটিন অনুযায়ী নিজের প্রতিদিনের কাজ যথাসময়ে যথাযথভাবে করে ফেলা। এর ফলে ভবিষ্যতে যে যেই অবস্থানেই পড়ি না কেন অপরের উপর নির্ভর করে থাকতে হবে না। অবসরে বই পড়া, এক্ষেত্রে বিখ্যাত লোকদের জীবনী, উদ্দীপনামূলক গল্প, কবিতার, পাশাপাশি ভ্রমণকাহিনী পড়া, মানচিত্র দেখা, বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে জানা, গাছপালা দেখা, পাখি দেখা, এসবের নাম, গতি প্রকৃতি জানা। প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে নিজের খারাপ দিক ও অপরের ভালো দিকগুলো মনে করা এবং নিজের খারাপ দিকগুলো ফেলে ভালোর চর্চা করা। সুন্দরভাবে কথা বলতে শেখার চর্চা করা। মনে রাখতে হবে, কথার দ্বারাই সম্পর্ক সুন্দর হয়, কথার দ্বারাই সম্পর্ক ধ্বংস হয়। সুন্দর কথা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্প। অপ্রয়োজনীয় মোবাইলের কথোপকথন থেকে, মোবাইল দেখা থেকে, মোবাইল ব্যবহার থেকে বেরিয়ে গাছপালা, নদী-নালা, পশু-পাখি, আকাশ-বাতাস পাহাড় পর্বত যার সম্মুখে বা যার বাসার কাছে যা সহজেই দেখা যায় তা দেখে শিখতে হবে জানতে হবে এই অফুরন্ত অবসর সময়ে।

Share.

মন্তব্য করুন