গভীর অরণ্যের ভেতরে কাঠ-খড় দিয়ে তৈরী এক কুঠী, যার চারদিকে আজব সব লতাপাতা আর গাছপালা দিয়ে ঘেরা। বনের যতো পাখপাখালী, খরগোশ আর কাঠবেড়ালীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল এই কুঠরী।
এক পূর্ণিমা রাতে আকাশের সীমানা থেকে মাটিতে খসে পড়লো ছোট এক শিশু তারা। সেদিন ছিল ওর জন্মদিন।
মহা উৎসব চলছিল সেদিন আকাশ পারের তারার রাজ্যে। নানান রকমের রঙ্গিন আতশবাজী ও ফুলঝুরীতে ভরে গিয়েছিল পুরো মেঘালয়।
নাচে গানে মশগুল ছিল সবাই।
এমনি সময় আপন মনে খেলতে খেলতে আকাশের সিঁড়ি দিয়ে পা ফসকে শিশু তারাটি পড়ে গেল নীচে। আর পড়তে পড়তে একেবারে পৃথিবীর সেই গভীর অরণ্যের খড় বিচুলীর উপর।
হঠাৎ যেন আলোকিত হয়ে গেল চারদিক। অদ্ভূত এক চঞ্চলতায় যেন মৃদু কম্পন লাগলো পুরো বনময়। বনের কুঠরীর দাওয়ায় বসেছিল দাইমা।
এমনিতেই আধারাত জেগে থাকে সে।
অপলক চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। রাতের আকাশ…হীরক কুচির মতো মিটিমিটি তারারা যেন ডাকে ওকে। কবে আর কখন যেন ঐ আকাশের সাথে একটা সম্পর্ক ছিল দাইমার।
কিরকম একটা শব্দ আর আলোর ঝলকানিতে বুকের ভেতরটায় কেমন যেন করে ওঠে।
দাওয়া থেকে নেমে এসে খড়ের গাদার সামনে এসে দাঁড়ালো দাইমা।
আর একটু হলেই বোধ হয় চোখটা ঝলসে যেতো।
থ’ হয়ে গেল দাইমা।
এ যেন অবিশ্বাস্য।
দেখলো ছোট্ট একটি আলোর শিশু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
চারদিক আলোয় আলোয় ভরা।
দাইমা দেখলো একটা আবছা আলোর সিঁড়ি আকাশের দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে। আর ওদিকে দু’হাত তুলে কাঁদছে আলোর শিশুটি।
আকাশে চোখ পাতলো দাইমা। দু’হাত তুলে বলতে চাইলো সেই মিশে যাওয়া আলোর সিঁড়িকে, ‘নেমে এসো নেমে এসো তুমি। একি করছো তুমি? নিয়ে যাও…নিয়ে যাও তুলে এই তারার শিশুটিকে, দোহাই তোমার… দোহাই তোমার…।’
কিন্তু মিলিয়ে গেল সেই ছায়া।
তারপর?
তারপর রাত হারিয়ে গেল একসময়। সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়লো বন বনান্তে…। সেই ছোট শিশু তারাটিকে বুকে তুলে নিল দাইমা। এই বুড়ো মানুষটাকে জনারণ্যের সবাই ডাকে দাইমা। ঐ অঞ্চলের সবার জন্যেই এই দাইমার মনটা কাঁদে। তার মমতার হাত প্রসারিত হয় সবার জন্যে। সেই দাইমা আকাশ থেকে খসে পড়া ঐ শিশু তারার নাম রাখলো বন্যা। সবাই জানলো বন্যা শুধুই দাইমার।
সেই গভীর অরণ্যের খড়-কাঠের কুঠরীতে একটু একটু করে বড় হতে লাগলো বন্যা। চারদিক আলো করে বড় হতে লাগলো বনের সব পশু-পাখিদের সাথে। ওদের বন্ধু হয়ে। দাইমার বয়সও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। আচ্ছন্ন করে রাখে তাকে বন্যার চিন্তা।
তারপর…!
তারপর সেই থেকে পূর্ণিমার চাঁদের মতো একটু একটু করে বেড়ে উঠতে লাগলো বন্যা। কিন্তু ও জানতে পারে না ওর জন্মদিনে পূর্ণিমায় কি যেন এক অস্থিরতা বিরাজ করে ঐ আকাশ পারের তারার রাজ্যে।
সারা রাত ধরে কি মা তারার অশ্রু ঝরতে থাকে, সবার অলক্ষে? ছোট্ট বন্যা সেটা জানতে পারে না। জানবার কথাও নয় ওর। কিন্তু কেমন যেন একটা অস্থিরতা বিরাজ করতে থাকে ওর মধ্যে। কেন এমন হয় ও জানে না।
কিন্তু দাইমা জানে। সব অনুভব করে। ঠিক মনে করতে পারে না। বয়সের ভারে ন্যূজ্ব দেহ…ঝাঁপসা চোখ। শনের মতো সাদা চুল…।
তারপরও বন্যাকে পাওয়ার পর থেকে কি যেন মনে করতে চেষ্টা করে দাইমা। কবে যেন ঐ আকাশ পারের তারার রাজ্যের সাথে কি একটা সম্পর্ক ছিল ওর।
কোন একটা ভুলের জন্যে রাণীমা বিতাড়িত করেছিল ওকে এই পৃথিবীতে।
কিন্তু কেন?
দু’হাতে মাথা চুলকাতে থাকে দাইমা।
নাহ্ কিছুতেই যেন মনে করতে পারে না।
আর সেই তারার রাজ্যের ছোট রাজকুমারী এসে পড়লো ওর কোলে…? এই গভীর অরণ্যে কি করে ওকে রক্ষা করবে সে? কি করে করবে ওর লালন পালন আর ভরণ-পোষন? কিন্তু সময় কারো জন্যে অপেক্ষা করে না। প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে নিয়ন্ত্রণ করে সবকিছু।
বন্যার দুরন্তপনার সঙ্গী ছিল বনের পশুপাখিরা। ওকে ঘিরেই থাকতো সবাই। ভোরের পাখিরা বন্যার ঘুম ভাঙাতো গান গেয়ে গেয়ে। ফল-ফুল পেড়ে এনে দিতো ওকে। দিতো ঝর্ণার পানি।
বন্যা একদিন দেখলো দাওয়ায় মন খারাপ করে বসে আছে দাইমা। দেখে ওরও মন খারাপ হলো।
একটু চিন্তিত হলো বন্যা। একদিন বলল-
: তুমি কেন মন খারাপ করে বসে থাকো দাইমা।
সচকিত হয়ে একটু হাসবার মতো মুখ করলো দাইমা।
বলল-
: এ আবার কি কথা? মন খারাপ করে বসে থাকব কেন?
বন্যা বলল-
: সত্যি মন খারাপ হয়নি তোমায়?
দাইমা এবার জোর দিয়ে হেসেই বলল-
: নারে, না। মন খারাপ হতে যাবে কেন শুধু শুধু। যা তো, যা তুই খেলতে যা।
চলে গেল বন্যা। কিন্তু আসলেই বন্যাকে নিয়ে সব সময়ে একটা দুঃশ্চিন্তা থাকে দাইমার।
সেদিনও ছিল পূর্ণিমা।
খেলাধুলা শেষে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল বন্যা। হঠাৎ একটা অদ্ভুত শব্দ শুনে চমকে দাঁড়ালো সে। ঝোপের আড়াল থেকে দেখলো আকাশ থেকে মস্ত বড় একটা বরফ, সাদা বল এসে নামলো পাহাড়ের পাদদেশে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, ধোঁয়ায় ভরে গেল চারদিক। বন্যা এবং সঙ্গীরা দেখলো সবাই, অবাক হয়ে দেখলো অদ্ভুত ধরনের হাত-পা-ওয়ালা কিছু। অনেকটা মানুষ আকৃতির কিছু জীব বেরিয়ে এলো সেই বল থেকে।
ওরা একে একে জড়ো হোল জঙ্গলে। বরফের মতো অদ্ভুত সাদা পোষাক।
হাতে রূপার কাঠি। চারদিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে এগুলো সবাই। কি যেন খুঁজতে লাগলো চারদিকে।
বন্যা ও সবাই ভয় পেয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ভেতরে এসে ঢুকলো।
দাইমা জিজ্ঞেস করলো-
: এ্যাই কি হয়েছে, তোরা সবাই অমন করে দৌঁড়াচ্ছিস কেন? বল না কি হয়েছে?
বন্যা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল-
: দাইমা, তুমিও লুকিয়ে পড়।
: লুকিয়ে পড়ব?
: কেন?
: বন্যা এবার একটু অস্থির হয়ে পড়লো।
বলল-
: তুমি জানো দাইমা, কি সাংঘাতিক ব্যাপার! তুমি ভাবতে পারবে না বনে কী হয়েছে।
দাইমা বলল-
: কী হয়েছে ? বলবি তো খুলে!
বন্যা সামনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল-
: ঐ যে দেখ।
নভোচারীরা ঘুরে এসে বলটার চারদিকে হাঁটাহাটি করতে লাগলো। আর কথা বলতে লাগলো নিজেদের মধ্যে। বলটার ভেতর থেকে যেন রঙিন আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। বন্যা দাইমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল-
: দেখেছো দাইমা!
: হু…।
দাইমা একটু গম্ভীর হয়ে গেল। চিন্তিতও হলো। কিছু যেন বুঝতে পারলো।
বন্যা জিজ্ঞেস করলো-
: তুমি কি বলতে পারো দাইমা ওরা কারা?
দাইমা একটু চুপ করে থেকে বলল-
: এখনো ঠিক পারছি না। তবে পারব।
বন্যা যেন একটু চঞ্চল হয়ে উঠলো।
বলল-
: পারবে? কি করে এতো জোর দিয়ে বলছো পারবে?
দাইমা দীর্ঘ নিঃশ্বাস চেপে ফেললো বুকের ভেতর।
বলল-
: সে তুই বুঝবি না।
দাইমার কথায় হতাশ হয়ে ওখান থেকে সরে গেল বন্যা।
আকাশচারীরা তখন ঐ বড় বলটার পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।
একজন বলল-
প্রতি পূর্ণিমায় আমরা আসি এই পৃথিবীতে। আসি তারার রাজ্যের রাজকুমারীর খোঁজে।
আরেকজন বলল-
: কিন্তু আশ্চর্য! এতোগুলো বছর পার হয়ে গেল। আজ পর্যন্ত কোন খবরই পেলামই না।
প্রথম জন বলল-
: ওদিকে রাণীমা…।
সত্যি রাণীমার জন্যে দুঃখ হয়।
আজ এতো বছরে কন্যা শোকে তিলে তিলে সব নীল দ্যুতি হারিয়ে কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়েছেন।
আরেকজন বলল-
: জানি না শেষ পর্যন্ত কী হবে?
: কিন্তু এমনটি হলো কী করে? কী করে আকাশ পারের তারকাকন্যা মাটির পৃথিবীতে হারিয়ে গেল?
অন্য একজন বলল-
: হারিয়ে যাবে কোথায়? কোন না কোন দিন কোথাও না কোথাও তারা রাজকুমারীকে পাওয়া যাবেই।
আকাশচারীরা আবার বনের ভেতরে চলে গেল, তারা-রাজকুমারীকে খুঁজতে।
ঝর্ণার কাছে সবার সাথে বসে আছে বন্যা। সখীরা হাসি গল্পে মেতে আছে। কিন্তু বন্যার মনটা খারাপ। খেয়াল করলো সবাই। সখী টুনি বলল-
: দেখেছো বন্যা, আজ পূর্ণিমার রাতে চারদিকে কেমন আলোর প্লাবন।
বীণা বলল-
: সত্যি। আমার ইচ্ছে হচ্ছে সারা বনময় ঘুরে বেড়াই। শুধুই নেচে বেড়াই।
টুলি বন্যার হাতে একটু টান দিয়ে বলল-
: এসো না এই জোছনা রাতে আমরা নেচে গেয়ে ভরিয়ে দেই এই বন বনান্তর।
বীণা বলল-
: সত্যি এতো ভালো লাগছে আজ।
এতোক্ষণ পর মুখ খুললো বন্যা। বন্যা বলল-
: না তোমরা নাচ গান কর। আমি দেখি।
নিজের মনে ভাবে বন্যা। আকাশ দেখে। মেঘেদের ভেসে যাওয়া দেখে। কেমন যেন লাগে ওর। কতো ধরণের ভাবনা ওর আসে।
প্রতি পূর্ণিমার রাতে জোছনার প্লাবনে সারা পৃথিবীটা যেন ডুবে থাকে…। তখন আকাশ যেন আমায় ডাকে। ডাকে জ্বলজ্বলে ঝাঁকঝাঁক তারাগুলোও। ওরা যেন মিটমিট করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন ডাকে আমাকে। যেন কিছু একটা বলতে চায়। কেন এমন হয় আমার?
এর মধ্যে বন্যাকে ডাকতে ডাকতে দাইমা এগিয়ে এলো।
: বন্যা, বন্যা তুই এখানে? সেই কখন থেকে খুঁজছি আমি তোকে, চল।
দাইমার সাথে কুঠরীর ভেতরে এসে বসলো বন্যা। বসলো জানালার ধারে।
তারপর আকাশে চোখ পেতে জিজ্ঞেস করলো-
: আচ্ছা দাইমা, প্রতি পূর্ণিমার রাতে আমার কী হয় বলো তো?
: কী হয়?
অন্যমনস্ক ভাবে বন্যা জবাব দিল-
: তা তো জানি না! কিন্তু কিছু একটা হয়।
কেমন চিন্তায় পড়ে গেল দাইমা।
: বন্যা…।
: কিন্তু কিছু একটা হয়।
ঐ আকাশটা, ঐ পূর্ণিমার চাঁদ, ঐ ঝিলিমিলি তারা…ওরা সবাই যেন আমাকে টানতে থাকে।
: ওরে চুপ কর।
ঘাবড়ে গেল যেন দাইমা।
বন্যা বলল-
: কেন? কেন এরকম হয় দাইমা। দাইমা বল না কেন এমন হয়?
বন্যার সুতীব্র কণ্ঠের আর্তনাদ পুরো বন বনান্তে ছড়িয়ে পড়লো খান-খান হয়ে। কেঁপে কেঁপে উঠলো প্রতিটি গাছগাছালি। হু-হু করে তীব্র গতিতে বইতে লাগলো বাতাস। কিন্তু কোন জবাব দিতে পারলো না দাইমা। দু’হাতে কান চেপে ধরে বসে থাকলো। সূর্য ওঠার আগেই বরফ সাদা পোষাকের আকাশচারীরা চলে গেল নিজ নিজ স্থানে। সকাল হলে কেউ আর ওদের খুঁজে পেলো না। দাইমা দেখলো তখনো ঘুমুচ্ছে বন্যা। চোখ মুখ ছাপিয়ে বালিশে ছড়িয়ে আছে একরাশ সোনালী চুল। বাইরে থেকে ওকে ডাকছে ওর বন্ধুরা। কাঠবেড়ালী খরগোশ আর পাখপাখালীর ঝাঁক।
ভীষণ ভাবে চিন্তায় বিষণœœ দাইমা। আগামী পূর্ণিমাতে বন্যার ১৬ বছর হবে। এতোটা বছর সন্তান স্নেহে বন্যাকে বুকের মাঝখানটিতে রেখে লালন করেছে দাইমা। মানুষ করেছে, এই মাটির পৃথিবীতে উৎপাদিত প্রাকৃতিক আর নৈসর্গিক সবরকম জিনিসের নির্যাস দিয়ে। শিখিয়েছে প্রকৃতি ও প্রকৃতির সন্তানদের অখণ্ড ভালোবাসা কি করে দিতে হয়।
কোন এক সময়ের আকাশ পারের বাসিন্দা ছিল দাইমা। কবে আর কেমন করে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল এই মাটির পৃথিবীতে, আজ আর কিছুই মনে পড়ে না ওর। হয়তো কোন ভুলের শাস্তি ছিল এটা!
কোন কারণে রাজমাতা বিরূপ হয়েছিলেন হয়তো তার প্রতি!
কে জানে কতো বছর? কতো যুগ কেটে গেছে দাইমার জীবনের, আজ আর সেটা কিছুতেই মনে পড়ে না। কী নাম ছিল তখন ওর? কে জানে।
বহু বছর আগে তারার রাজ্য থেকে যখন সে পৃথিবীর দিকে নিক্ষিপ্ত হলো, এসে পড়লো মহাসমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের ওপর। পৃথিবীতে তখন ঘন দুর্যোগ। সামুদ্রিক ঝড়।
দাইমা সমুদ্রে পড়ে গিয়ে…উথাল পাতাল ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করতে করতে গিয়ে পৌঁছুলো একেবারে পাতালে মাছের রাজ্যে। সবুজ শ্যাওলায় গা মুড়িয়ে নিজেকে লুকাতে চাইলো সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলো না। আরেক ঢেউ এসে আছড়ে ফেললো ভূ-পৃষ্ঠের ওপর জঙ্গলের ধারে। নীল দ্যুতির শরীর ক্ষত বিক্ষত তখন আঘাতে আঘাতে।
সময়ের ব্যবধানে শরীরের ক্ষতও সেরে উঠলো একসময়। কিন্তু সেরে উঠলো না মনের ঘা। কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেল সে। বনের পশুপাখিদের সাথেই চলতে লাগলো জীবনধারণ।
কবে যেন আর কারা যেন ওর নাম দিল দাইমা। সবার জন্যে সেবা আর ভালোবাসা দিয়ে বনের মধ্যে মধ্যমণি হয়ে রইলো এই দাইমা। আর তারই কোলে আশ্রয় পেল বন্যা।
বন্যা জানে দাইমা-ই ওর সব। বনের পশুপাখিগুলো, কয়েক সই আর দাইমাকে ঘিরেই ওর পৃথিবী। মাস পেরিয়ে এলো সেই চৈতালী পূর্ণিমা। সমস্ত মাঠ-ঘাট, নদী, পাহাড় আর বনের দীর্ঘ গাছপালা চুঁইয়ে চুঁইয়ে যেন পড়ছে চাঁদের শীতল নীল আলো। কেমন যেন মোহনীয় চারদিক। ঝর্ণার ধারে সবার সাথে আনন্দে মেতেছিল বন্যা। দাইমা বলেছিল- আজ তোর জন্মদিন। শুধুই আনন্দের দিন আজ।
নিজ হাতে রেঁধে বনের সবাইকে খাইয়েছে দাইমা। পাহাড়, অরণ্য আর সমুদ্রকে বলেছে বন্যার মঙ্গলের জন্যে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে। করেছেও সবাই। কারণ ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা বন্যার প্রতি ছিল ওদের আন্তরিক এবং অফুরন্ত ভালোবাসা।
ওদিকে বয়সের ভারে ন্যূজ্ব দাইমা নদীর ধারে একটা পাথরের ওপর বসে উপভোগ করছিল বন্যার আনন্দময় জন্মদিন। কিন্তু সব বন্ধুদের সাথে হৈচৈ- এতে যেন ঠিক মন দিতে পারছিল না বন্যা। কোথায় আর কেমন করে যেন মনের বীণার একটা তার বার বার ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। অন্যরকম একটা অনুভূতি যেন আজ…।
হঠাৎ…!
হ্যাঁ হঠাৎ-ই মধ্যরাতে অন্যরকম এক আলোর ঝলকানিতে ঝলমল করে উঠলো সারা বনময়। ইলশেগুড়ি বৃষ্টির মতো…বরফকুচির মতো…হীরককুচির মতো শুরু হলো অশ্রান্ত বর্ষণ…। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। লক্ষ কোটি হীরককুচির মতো তারায় তারায় ভরে গেল চারদিক। আর সেই আলোর বন্যায় ভাসতে ভাসতে পৃথিবীতে নেমে এলো মহাকাশের এক অপূর্ব বাহন।
যে যেখানে ছিল, মুহুর্তের মধ্যে লুকিয়ে পড়লো গাছপালা ও পাহাড়ের আড়ালে…। সবাই ভাবলো স্বপ্ন নয়তো? সেই স্বপ্নের বাহন থেকে নেমে এলো স্বয়ং তারার রাণী। যেন জোছনা মাখা তার গায়ের রঙ। হাতে ধরা এক অদ্ভূত কাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে এগুতে লাগলো। সেই কাঠি থেকে বিচ্ছুরিত হতে লাগলো নীল আলোর রশ্মি।
ততোক্ষণে বনময় নেমে এসেছে ঝাঁক ঝাঁক তারা পরী। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ওরা সবাই এসেছে এই পৃথিবীতে হারিয়ে যাওয়া তাদের প্রিয় তারা রাজকুমারীকে নিয়ে যেতে।
আর যেন লুকিয়ে থাকা গেল না। বন্যাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো দাইমা। বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল বন্যা। রাণী মুগ্ধ হয়ে ওকে দেখে। সেই ছোট্ট শিশুটি আজ এতো বড় হয়েছে? একেবারে যেন মাটির পৃথিবীর মানুষের অবয়ব। প্রকৃতির সজীবতায় ভরা লাবন্যময় একটি মুখ, মেঘের স্তুপের মতো পিঠময় সোনালী চুল।
এক সময় দু’হাত বাড়িয়ে দিল তারার রাণী।
বলল-
: এসো। তুমি আমার সন্তান। তুমি তারার রাজ্যের রাজকুমারী। ১৬ বছর আগে এক রাতে তুমি আকাশ থেকে ছিটকে পড়ে গিয়েছিলে এই পৃথিবীতে।
: আর এতো বছর পর তুমি খোঁজ নিতে এসেছো তার! এগিয়ে এসে বলল দাইমা।
: তুমি?
চমকে উঠলো রাণী।
দাইমা বলল-
: হ্যাঁ আমি। বহু যুগ আগে ছোট্ট একটি ভুলের জন্যে আমাকে পৃথিবীতে নিক্ষেপ করেছিল তোমাদের মহারাণী।
রাণী অবাক হয়ে বলল-
: সেই তুমি! তুমি এখনো আছো?
দাইমা’র কণ্ঠটা এবার একটু কেঁপে উঠলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল-
: হ্যাঁ সেই আমি। এখনো আছি। তা নইলে তোমার হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট রাজকুমারীকে কোলে পিঠে করে এতো বড় করতো কে?
: তুমি? সত্যি তুমি করেছো ওর লালন পালন?
বন্যা বলল-
: এই আমার দাইমা। ও আমার সব কিছু। তোমাকে আমি চিনি না। তোমার সাথে আমি কোথাও যাব না। তুমি যেখান থেকে এসেছো সেখানে চলে যাও।
দাইমার পেছনে গিয়ে লুকালো বন্যা।
রাণী বলল-
: যাকে বহু বছর আগে আমার মা মহারাণী বিতাড়িত করেছিল তারার রাজ্য থেকে সেই তুমি প্রতিপালন করেছো আমার কন্যাকে? বল তোমার জন্যে আমি কি করতে পারি?
দাইমা বন্যাকে বুকের কাছটিতে এনে জড়িয়ে ধরলো। বলল-
: তোমার কাছে আমি কিছ্ইু চাই না রাণী মা শুধু বন্যাকে আমার কাছ থেকে নিও না।
রাণী বলল-
: সে কি করে হয়? তারার দেশে জন্ম ওর। মাটির পৃথিবীতে সে কি করে মানাবে নিজেকে?
দাইমা দৃঢ় কণ্ঠে বলল-
: যেভাবে আমি পেরেছি। সেভাবে বন্যা বেড়ে উঠেছে এই প্রকৃতিতে। আকাশের আবহাওয়ায় ও আর নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবে না। ওকে এখানেই থাকতে দাও রাণী মা। বন্যার দাইমা হিসেবে ওকে আমি তোমার কাছে চেয়ে নিচ্ছি রাণী মা।
এরই মধ্যে বনের সব পশুপাখি এসে ঘিরে ফেলেছে বন্যাকে।
বিস্ময়ে দেখলো রাণী-মা।
আকাশ পারের তারার রাজ্যের এক জীবন থেকে কতো অন্যরকম আর বৈচিত্রময় এই পৃথিবীর জীবনযাত্রা। এখানে প্রকৃতি কন্যার মতো বড় হয়েছে ওদের সেই ছোট্ট রাজকুমারী।
বুকের ভেতরে একটা কষ্ট থাকলেও অন্যরকম এক আনন্দ নিয়ে আবার সেই মেঘের দোলায় উঠে বসলো রাণী-মা। বলল, ভালো থেকো।
ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে গেল সব কিছু। দাইমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো বন্যা। আকাশের দিকে চোখ রেখে দেখলো…কোথাও কিছু নেই। চাঁদের আলোয় বান ডাকা রাত একেবারেই শান্ত।
একবার শুধু মনে হলো আকাশ থেকে ওর দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে অপলক চেয়ে আছে সেই মা-তারাটা।

Share.

মন্তব্য করুন