জীবনের গল্পে শৈশব একটি অধ্যায় বটে। শৈশব যেমনই কাটুক জীবনের একটি অধ্যায়ে এসে সব মানুষই শৈশবের কথা চিন্তা করেন। শৈশবকে জীবনের সেরা সময় বলে থাকেন এমনকি শৈশবে ফিরে যাওয়ার জন্য আকুতি করেন ব্যর্থচিত্তে। তবে যারা একংবিশ শতাব্দীর শৈশব দেখছেন। অর্থাৎ বর্তমান সময়ে যারা বেড়ে উঠছেন। তাদের অবস্থান এবং চলতি সময় দেখে বৃদ্ধরা এমনকি উঠতি বয়সীরা আকস্মিত এবং বিস্মিত হচ্ছেন, আছেন আতঙ্কে, করছেন শঙ্কা প্রকাশ। কেনো একংবিশ শতাব্দীকে গিলে খাচ্ছে আধুনিকতা। এ আধুনিকতা যন্ত্রে, কসমেটিকসে, খাবারে, এমনকি পরিবেশে। অনেকে বলে এ আধুনিকতা যন্ত্রে প্রবেশ করে শৈশবকে গিলে খাচ্ছে। এ আধুনিকতা মাঠে, পাড়া মহল্লায়, এমনকি পাঠশালায় প্রবেশ করে শৈশব এবং শরীরের অনুভূতিকে গিলে খাচ্ছে। প্রস্তুতি নিচ্ছে আগামী প্রজন্মকে একটি রোবটিং প্রজন্মে রূপ দান করতে। তবে আধুনিক প্রযুক্তি কিছুই করতে পারতো না যদি প্রজন্মের অভিভাবকরা সচেতন থাকতো।

আজ বিভিন্ন পরিবারের শিশু-কিশোরদের খবর নিয়ে জানা যায়, অনেকের ঘুম ভাঙে মোবাইলের ডাকে। গেমস খুঁজতে খুঁজতে অথবা টিভি রিমোটের মাধ্যমে কার্টুন চ্যানেল খুঁজতে খুঁজতে। এ বিষয়টি অনেক অভিভাবক আনন্দচিত্তে উপভোগ করেন, কারণ তাদের কাজে তেমন বিরক্তি তৈরি করে না সন্তান। আবার অনেকে বলেন, বাচ্চারা এতে অনেক আনন্দ পায়। অনেকে বলেন, গেমস কার্টুনে ব্যস্ত না রাখলে বাচ্চাদের কি নিয়ে ব্যস্ত রাখবো? খেলার মাঠ নাই। সবার জন্য উন্মুক্ত পার্কও নাই। পার্ক থাকলেও নাই পরিচ্ছন্নতা আর সুন্দর পরিবেশ।
অভিভাবকের অনেক অভিযোগ ফেলে দেয়ার মতো না। তবে আজ থেকে এক কিংবা দুই দশক পিছনে গেলে মনে করা সহজ যে, সে সময়ের শিশু কিংবা কিশোরদের একটি সংস্কৃতি ছিলো- ভোর বেলায় মক্তবে যাওয়া। ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করা। এখন তা শুধুই স্বপ্ন।

তবে সত্যিই আগামীর প্রজন্ম একটি রোবটিক প্রজন্ম তৈরি হতে যাচ্ছে? এমন প্রশ্ন অনেকেরই। এ বিষয়ে গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হাসান আজিজুল হক বলেন, ‘আমার পরিবারেও শিশু আছে। আমার নাতি। আমরা তাকে অবশ্যই গেমস কার্টুন দেখতে ও খেলতে দিই, তবে আসক্ত হতে দেই না। সময় করে। আমি আমার বাসায় ১২টার পর টেলিভিশন অন করি। বাড়তি সচেতনতা না থাকলে প্রজন্মকে মানুষ করা কঠিন। আমাদের সময়ের বা তার পরের প্রজন্মের শৈশবও ছিলো সবুজে ঘেরা, নদী-নালা, খাল-বিল আর সুন্দর পরিবেশ ছিলো আমাদের বন্ধু। সে জন্য বলি, আমাদের শৈশব অনেক সুন্দরভাবে কেটেছে। এখনকার বাচ্চারাও হয়তো ইন্টারনেট কার্টুন কিংবা গেমস খেলার মাধ্যমে নিজেদের শৈশবের আনন্দ উপভোগ করে। তবে ইন্টারনেটে আসক্ত হওয়া শুভকর না। এ থেকে অভিভাবকদের সতর্ক হতে হবে।’

হাসান আজিজুল হকের মতো একই কথা বলেন, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। তিনি কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন, ‘খবরের কাগজে, টেলিভিশনে নানা খবর দেখি। খুব কষ্ট হয়। এখনকার প্রজন্ম খোলা আকাশ পাচ্ছে না। মাঠও পাচ্ছে না। করোনা এসে তো আরও বড় ধকল দিয়ে গেলো। তবে এভাবে এগিয়ে যেতে হবে। অভিভাবকদের সচেতনতায় এ প্রজন্মও একটি ভালো প্রজন্ম তৈরি হবে আশা করি।’
গল্পকার হাসনাত আবদুল হাই বলেন, ‘আমার ঘরে কোনো শিশু নাই। তবে খবরের কাগজের নানা খবর আমাকে প্রায়ই শঙ্কায় ফেলে। আমি খবর পাই। বর্তমান সময়ের শিশু-কিশোররা গেমস, কার্টুনে নিজেদের ব্যস্ত রেখে আনন্দ পায়। আনন্দ পাক আমরাও চাই, কিন্তু এ আনন্দ যদি আসক্তিতে পরিণত হয় তবেই এটি খারাপ। অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের উপযুক্ত সময় দেয়া। যতটুকু সম্ভব পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া। শুধু গেমস কার্টুন দিয়ে শৈশব কাটানোর পক্ষে আমি না।’

বর্তমান প্রজন্ম, শিশু-কিশোর নিয়ে অনেকটা ভাবনায় আছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাট্যকার মামুনুর রশীদ। প্রজন্মের গেমস ইন্টারনেট আসক্তির কথা শুনতেই গম্ভীর হয়ে পড়েন। অনেকটা চিন্তিত স্বরে বলেন, ‘এ প্রজন্মর গেমস, ইন্টারনেট আসক্তি বিষয়টি খুব আতঙ্কের। জানি না এ থেকে নিস্তার সম্ভব কি না। তবে অভিভাবকরা যদি সচেতন হন তবে অনেকাংশে সম্ভব হবে। বাচ্চাদের উপযুক্ত সময় এবং প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া। মাঠে বা পার্কে নিয়ে সবুজের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা অনেকটা জরুরি হয়ে গেছে। শুধু গেমস, ইন্টারনেট ও কার্টুন দিয়ে শৈশব কাটানো শিশুদের পক্ষে ভয়ঙ্কর বলে মনে করি।’

Share.

মন্তব্য করুন