বল দখলের লড়াইয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন মাঠের বাম প্রান্তে, উঠতে যাবেন ঠিক সে সময়ই বাজলো রেফারির লম্বা হুইসেল। শুনে হাঁটু গেড়েই মাথা নিচু করে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। এর আগেও অনেকবার ফাইনাল শেষে মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল তাকে; কিন্তু সেগুলোর সাথে ১১ জুলাইয়ের মারাকানা স্টেডিয়ামের ঘটনাকে মেলানো যাবে না। কারণ এদিন যে লিওনেল মেসির হাতে ধরা দিয়েছে বহু কাক্সিক্ষত শিরোপা। যে শিরোপার জন্য তাকে কত কথাই না শুনতে হয়েছে! মাথা নিচু করে থাকার সময় মেসি কী ভেবেছিলেন সেটি জানার উপায় নেই, হয়তো কাঁধ থেকে অনেক দিনের একটি বোঝা নেমে যাওয়ায় একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন; কিন্তু সেটা আর তিনি পারলেন কই, হুইসেল শুনেই সতীর্থ খেলোয়াড়েরা দৌড়ে গেল তার দিকে। তাকে ঘিরে চললো নাচ, এরপর সবাই মিলে হাতে তুলে আকাশে ছোড়া আর লুফে নেয়ার খেলা চললো কিছুক্ষণ।

আর্জেন্টিনা এর আগে সর্বশেষ কোন ট্রফি জিতেছিলো ১৯৯৩ সালের কোপা আমেরিকা কাপে। এরপর দীর্ঘ ২৮ বছর কেটেছে শিরোপা খরায়। প্রথম দিকে ম্যারাডোনার শূন্যস্থান কেউ পূরণ করতে পারেনি বলে সান্ত¡না খুঁজে পেত আর্জেন্টাইন সমর্থকরা; কিন্তু লিওনেল মেসি দলে আসায় সেই সুযোগও বন্ধ হয়ে গেল। মেসির মতো বিশ^সেরা, তর্ক সাপেক্ষে সর্বকালের সেরা ফুটবলার থাকতেও দলটি কেন কাপ জিততে পারছে না সেই আলোচনা শুরু হয়ে গেল।
আক্রমণ চললো ব্যক্তিগতভাবে মেসির দিকেও। কারণ পেলে, ম্যারাডোনা, জিদানসহ প্রায় সব কিংবদন্তী ফুটবলারই দেশের জার্সি গায়ে কাপ জিতেছেন। মেসি ক্লাবের হয়ে সবগুলো শিরোপা একাধিক বার জিতলেও জাতীয় দলের হয়ে কেন জিততে পারছেন না- সেই দোষে তাকে কাঠগড়ায় তোলা হলো। এরপর গত ১০ বছর ধরে বিশ^ ফুটবলে সেরার খেতাব নিয়ে মেসির যার সাথে লড়াই চলছে, সেই ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ২০১৬ সালে পর্তুগালকে ইউরো জেতানোর পর এই আলোচনা আরো বেড়ে গেল। নিজেকে সেরা প্রমাণ করতে হলে আর্জেন্টিনাকে কাপ এনে দিতে হবে- এমন একটা ধারণা ফুটবল বিশ্বে জোরালো জায়গা করে নিলো।

দুঃখ ঘোচাতে কিংবা সমর্থকদের ভালোবাসার এই দায় মেটাতে যে মেসি চেষ্টার কমতি রেখেছিলেন তা কিন্তু নয়। এবারের কোপায় দল হিসেবে আর্জেন্টিনা ততটা ভালো ছিলো না। তাই সমর্থকদের আশাও ছিলো কম। সেমিফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে রক্তাক্ত পা নিয়ে মেসির খেলা যারা দেখেছে, তার বুঝতে পারবে- তিনি কতটা মরিয়া ছিলেন শিরোপার জন্য।

এর আগে ২০১৪ সালের বিশ^কাপে বলতে গেলে মেসি প্রায় একাই ফাইনালে তুলেছিলেন দলকে। নিজে হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের খেলোয়াড়। সেবার ফাইনালে স্ট্রাইকার গঞ্জালো হিগুইন একাধিক সহজ গোলের সুযোগ মিস না করলে মেসির হাতে এই মারাকানা স্টেডিয়ামে উঠতে পারতো বিশ^কাপ ট্রফি। এবারের কোপা আমেরিকার ফাইনালে অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে আলতো চিপে যেভাবে গোল করেছিলেন, ২০১৪ বিশ^কাপের ফাইনালেও একই ধরণের সুযোগ পেয়েছিলেন হিগুইন; কিন্তু কাজে লাগাতে পারেননি। আরো একাধিক সুযোগ পেয়েছিলেন সেবার তিনি। এছাড়া ২০১৫ ও ২০১৬; এই টানা দুটি কোপা আমেরিকার ফাইনালে আর্জেন্টিনা হেরেছিলো টাইব্রেকারে। ২০১৬ সালে তো হতাশ হয়ে অবসরের ঘোষণাও দিয়েছিলেন মেসি। এর আগে ২০০৭ সালের কোপার ফাইনালেও তারা হেরে শিরোপা বঞ্চিত হয়েছিলো।

এটা ঠিক যে, গত ১০ বছর ধরে আর্জেন্টিনা দলটাও ঠিক আগের মতো ভারসাম্যপূর্ণ নয়। দলের মাঝমাঠ ও রক্ষণভাগে কোন তারকা ফুটবলার নেই। ফুটবলে যে কোন দলের আক্রমণের সূচনা হয় মাঝমাঠ থেকে। যে দল মাঝমাঠে বেশি বলের দখল রাখতে পারে, তারা তত আক্রমণ রচনা করতে পারে; কিন্তু মেসির মতো ফরোয়ার্ডকে মাঝমাঠ থেকে বল যোগান দেয়ার মতো সামর্থ অনেক বছর ধরেই আর্জেন্টিনা দলের নেই। হুয়ান সেবাস্তিয়ান ভেরন কিংবা রিকুয়েলমের বিদায়ের পর এই দলটিতে ভালো কোন মিডফিল্ডার আসেনি। যে কারণে মেসিকে গোল করার চেয়ে আক্রমণ রচনা করতেই বেশি সময় ব্যয় করতে হয়েছে। নিজেই মাঝমাঠে নেমে ডি মারিয়া-হিগুইন-আগুয়েরোকে বল যোগান দেয়ার দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। এ কারণেও হয়তো মেসির শিরোপার অপেক্ষা বিলম্বিত হয়েছে। তবুও সমালোচকরা তো আর এতসব যুক্তি মানতে রাজি নন। তারা চান সফলতা। দিন শেষে জয়ীরাই বীর। যে কারণে মেসির মতো সুপারস্টারের হাতে কাপ উঠতে হবে সেটাই ছিলো চাওয়া।

অবশেষে এবার সেই অপূর্ণতা ঘুচলো আর্জেন্টিনার ও লিওনেল মেসির। বহু বছর ধরে এই সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন আর্জেন্টাইন সমর্থকরা। ফুটবল জাদুকরের হাতে একটি আন্তর্জাতিক ট্রফি দেখার স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হলো সবার। সেটা এমনভাবে যে, এর চেয়ে ভালো কী হতে পারতো! ব্রাজিলের মাঠে, সেই বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামে ব্রাজিলেরই বিপক্ষে লিওনেল মেসির দল জিতলো কোপা আমেরিকা কাপের ট্রফি।

কাপ জিততে কে না চায়- কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে মেসির একটি শিরোপা যেন শত হতাশার কাব্য হয়েছিলো এতদিন। এতবার খুব কাছে গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে তাকে! তার ওপরে ক্লাবের হয়ে একের পর এক শিরোপা জিতে চলেছেন, নিজে বিশ^সেরা ফুটবারের ব্যালন ডি’অর পুরস্কার জিতেছেন ৬ বার। তাই তো সমালোচকরা সেই সুযোগটাই নিয়েছিলেন, মেসির শ্রেষ্ঠত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে। মেসির নিজেরও কি আক্ষেপ ছিলো না! না থেকেই পারে না। ক্লাবের হয়ে এত কিছু জিতলেও দেশকে কিছু এনে দেয়ার মজাটাই যে অন্যরকম।

স্পেনের আবহাওয়ায় বড় হয়েছেন। সেই দেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। সেখানেই শিখেছেন ফুটবল। ক্লাব সতীর্থ জাভি, ইনিয়েস্তা, পিকেদের সাথে তারও সুযোগ ছিলো স্পেনের হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলার। সেটি খেললে হয়তো ২০১০ সালেই তার হাতে উঠতে পারতো বিশ^কাপ; কিন্তু মেসি নিজের দেশকে ভালোবাসেন বলেই আকাশী-সাদা জার্সি পরেই খেলেছেন। আর্জেন্টিনার প্রতি ভালোবাসা, হৃদয়ের টান তাকে টেনে নিয়ে গেছে সেই দলের কাছে। অবশেষে সেই প্রিয় মাতৃভূমিকে এনে দিয়েছেন একটি শিরোপা। সেই সাথে টুর্নামেন্টের সেরা ফুটবলার ও সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারও উঠেছে তার হাতে। এতদিন দুঃখী রাজকুমার হয়ে থাকা লিওনেল মেসি এবার সত্যিই বিজয়ী বীর।

কাপের অজুহাতে ডিয়াগো ম্যারাডোনার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে মেসিকে ভাবতে আর তর্ক জুড়ে দেয়ার সুযোগ থাকবে না। তবে আর্জেন্টাইনদের হয়তো আফসোস হয়েছে এই সাফল্য দেখে যেতে পারেননি তাদের ফুটবল রাজা। আরেকটি কাপ জেতার ৭ মাস আগেই যার মৃত্যু হয়েছে।

Share.

মন্তব্য করুন