আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক। আগামী দিন আমরা কেমন নাগরিক প্রত্যাশা করি, কেমন হবে আমাদের মানুষদের আচার-আচরণ তার উপর ভিত্তি করে আজকের শিশুদের গড়তে হবে। ভ্রƒণকাল থেকেই শিশুর উপর পরিবেশের প্রভাব পড়তে শুরু করে। আর্লি শৈশব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় মা-বাবা বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের আদর-স্নেহ-মমতা শিশুর বিকাশকে সুষ্ঠুধারায় ত্বরান্বিত করে। শিশুটিও মায়া-মমতায় অন্যকে জড়াতে চায়। ধীরে ধীরে গৃহ ছেড়ে আঙিনায় আসে। এখানে সে প্রতিবেশী দ্বারা প্রভাবিত হয়। প্রতিবেশী যদি খারাপ হয় তাহলে তা শিশুকে প্রভাবিত করে এবং সেও একই রকম আচরণ করে। তারপর বিদ্যালয়-কলেজ-ভার্সিটির পরিবেশে সে হয়ে ওঠে অনন্য কোনো ব্যক্তি, না হয় দুষ্টু কোনো ব্যক্তি। এ ছাড়া পারিবারিক আর্থিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ব্যাপারগুলোও মানবসন্তানকে বেড়ে ওঠার পথে প্রভাবিত করে। এই কারণেই আমরা প্রতিটি ব্যক্তি ভিন্ন আচরণ করি, ভিন্ন ভিন্ন চিন্তার চেতনার ধারক ও বাহক হই।

এখন তাহলে প্রশ্ন হলো আমি এমন এক পরিবেশে থাকি সেখানে চোর, ডাকাত, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ পিছিয়ে পড়া চিন্তার নিরক্ষর মানুষের বেশি আনাগোনা। আমি আমার সন্তানকে কিভাবে সুস্থ চিন্তার মানুষ বানাবো!
পরিবার থেকেই এর থেকে পরিত্রাণের পদক্ষেপ নিতে হবে। সন্তানকে সময় দেয়া, তাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, তার ছোট ছোট ইচ্ছাগুলো পূরণ করে দেয়া, উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে শিশুটিকে অংশগ্রহণ করতে দেয়া, ভালো-মন্দের তফাত করতে শেখানো এবং তার কাজের স্বীকৃতি দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধ্যের বাইরে কোনো আবদার পূরণ না করে বরং তাকেই বুঝতে দেয়া যে আমার মোটরবাইক কেনার সামর্থ্য নেই। কিনতে হলে অন্যায় দুর্নীতি করতে হবে। তা করা কি উচিত? তাহলে সে নিজেই নিজের সাথে বোঝাপড়া করে নিজের ভিউ নির্ধারণ করবে। সংসারে বাবা মায়ের কত আয়, সে আয় দিয়ে পরিবারের চলা, আত্মীয়-স্বজন দেখাশোনা করার পর আর বাকি থাকে কিনা এর সাথে সন্তানকে শৈশব থেকেই সম্পৃক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে সন্তানের ভেতর রেশনালিটি তৈরি হয়। তার দ্বারা ভুল করা কখনোই সম্ভব হবে না।

বন্ধু-বান্ধব ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। সে ক্ষেত্রে কে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হবে তা নির্বাচনে বাবা-মাকেই সাহায্য করতে হবে। বন্ধুদের সাথে চা দোকানে আড্ডা নিরুৎসাহিত করে বরং বলুন বাড়িতে নিয়ে এসো। এখানেই আড্ডা দাও। আপনি না হয় একটু নাস্তা বানিয়ে তাদের আপ্যায়ন করবেন। এতে আপনার প্রতি তার বিশ্বাস শ্রদ্ধা বেড়ে যাবে। আপনার কাছে সে ভরসা খুঁজে পাবে। কখনো আপনাকে সে তথ্য লুকাবে না। সন্তানদেরও উচিত বাবা-মায়ের কষ্ট অনুভব করা। বাবার উপার্জন সম্পর্কে তার ধারণা এবং সম্মান থাকা উচিত।

সবচেয়ে বড় সমস্যা বয়ঃসন্ধিকাল। এ সময় বহুমুখী চাহিদা তৈরি হয়। বাবা-মাকে অবশ্যই সন্তানের সাথে ফ্রেন্ডলি হতে হবে। যাতে বাবা-মা হতে কোনো ভয় উৎপন্ন না হয়। সে যাই করুক আপনার চোখে হয়তো ভুল কিন্তু তার বেড়ে ওঠার পথে ওই পথ তাকে অতিক্রম করতেই হবে। সে ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই সন্তানের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। আপনি দেখলেন আপনার সন্তান বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে লুকিয়ে কথা বলছে, চ্যাট করছে। মেইল করছে। সহজ ভাবে নিন। বন্ধুর মতো পাশে বসুন। জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করুন। আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন। আপনিও এই বয়স পাড়ি দিয়ে এসেছেন। বলুন এই বয়সে সব কিছুই ভালো লাগে। লাগতেই হবে। কিন্তু পরিশীলিত আচরণ করতে না পারলে কেউ মানুষ হয়ে ওঠে না। তাদের সম্পর্ককে সহজ ভাবে নিয়ে তাকে পড়াশোনা করার ব্যাপারে উৎসাহিত করুন। মারধর, বকাঝকা এই বয়সের শিশুদের জেদি করে তোলে, আত্মহত্যা করতেও তারা পিছুপা হয় না। এই সময় তাকে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন- লাইব্রেরি, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ব্যস্ত রাখুন। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কিভাবে এগিয়ে নেয়া যায় তা নিয়ে ভাবতে বলুন কিংবা সে ভেবে থাকলে তাকে উৎসাহিত করুন। পাঠ্যপুস্তকে তাকে সীমাবদ্ধ না করে বরং উন্মুক্ত পরিবেশে ছেড়ে দিন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দিন আপনি সাথেই থাকুন। এ সময় মানবশিশু পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার পথে দৌড়তে থাকে। সে দৌড়ে আপনিই তার অন্যতম সারথি।

শৈশবে ধরুন আপনার সন্তান তার কোনো বন্ধুর জ্যামিতি বক্স নিয়ে এসেছে। আপনার চোখ যেন তা না এড়ায়। শান্ত ভাবে তার থেকে তথ্য নিন বক্সটি ধার এনেছে নাকি না বলে নিয়ে এসেছে? ধার এনে থাকলে তা ফেরত দেয়ার ব্যাপারে আপনিই সতর্ক থাকুন। না বলে নিয়ে এলে তাকে বকাঝকা বা মারপিট-উপহাস না করে বরং বন্ধুর মতো বলুন বক্সটি যেন কাজ শেষ করে দিয়ে আসে। আপনি একটি বক্স তাকে সাথে নিয়েই কিনে দিন। কৈশোরে শিশুরা চায় সব কিছুই নিজের দখলে নিতে সেক্ষেত্রে তার কাজের প্রশংসা করুন। এতে আত্মবিশ্বাস বাড়বে। উপহাস করলে দিন দিন আপনার প্রতি ঘৃণা জন্ম নেবে।

আপনি বাবা মা হলেও সে কিন্তু আলাদা একটা সত্তা। তার পছন্দ আপনার মতো নাও হতে পারে। আপনার জিন তার ভেতর থাকলেও তার নিজস্ব সত্তা তাকে আপনার থেকে পৃথক করে রেখেছে। এখানেই মানুষের মৌলিকত্ব। চাষির ছেলে চাষি, মাঝির ছেলে মাঝি, মাস্টারের ছেলে মাস্টার কিংবা ব্যাংক অফিসারের ছেলে ব্যাংক অফিসার হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে আপনার পরিবেশ তার রক্তে মাংসে মিশে যাওয়ার জন্য অটোমেটিক পারিবারিক মৌলিক আচরণ তার ভেতর থাকেই। তারপরও প্রতিবেশের কারণে সে ভিন্ন কেউ হবে এটাই স্বাভাবিক।

কৈশোরে যদি সে দেখে আপনি তার মাকে অসম্মান করে কথা বলেন তাহলে তার ভেতর বদ্ধ ধারণা হবে মা হলো এমন কেউ যাকে অপমান করা কোনো ব্যাপার না, সে তার দাদী বোন আরো যারা নারী তাকে ঘিরে আছে সবার প্রতি তার একই ধারণা হবে, না হয় মায়ের প্রতি ভালোবাসার কারণে আপনাকে সে ঘৃণা করবে। আপনি যদি সংসারের সকল সদস্যের সাথে সদালাপী, মৃদুভাষী, মিষ্টিভাষী, কৌতুকপ্রিয় হন আপনার সন্তানও তাই হবে।

সমাজের প্রতিটি সদস্যের সমাজের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য আছে। আপনাকে সামাজিক হতে দেখলে সেও সামাজিক হবে। সমাজের প্রতিটি পেশার লোকই দরকারি এবং প্রতিটি পেশাই সম্মানের। এ শিক্ষা সে আপনার থেকেই নেবে। আপনি মানুষকে মানুষের মতো সম্মান না করে যদি পেশা বিচার করে সম্মান করেন আপনার সন্তানও দাম্ভিক অহঙ্কারী হবে। এ প্র্যাকটিস বুমেরাং হয়ে আপনার কাছেই ফিরবে। কারণ আপনি মাস্টার সে ডাক্তার হতে পারে। পরে আপনাকেই সে আর পাত্তা দেবে না। কারণ সে মূল্যবোধ তৈরিতে আপনি ব্যর্থ হয়েছেন।

এবার আসুন, পড়াশোনার ব্যাপারে আমরা তাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? আপনার সন্তান যে স্তরেই পড়–ক প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক কিংবা উচ্চশিক্ষা প্রতিটি স্তরের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। দেশের আর্থ-সামাজিক চাহিদা অনুযায়ী সে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারিত হয়। আপনি যদি কেবলই নোট মুখস্থ করিয়ে পরীক্ষায় হুবহু নোট লিখিয়ে এ প্লাস পাওয়ান তাহলে ধরে নিন আপনার ছেলের নিজের কাজ করার সামর্থ্য তৈরি আপনিই করেননি। যেমন ধরুন- শিশুটিকে আপনি বললেন তোমার বাবা সম্পর্কে দশ লাইন লিখো। এবং আগেই আপনি নোট করে দশ লাইন মুখস্থ করালেন। সে তাই লিখলো। আপনি খুশিতে গদগদ। আহা! আমার সন্তান কী সুন্দর করে লিখেছে! নদীর পাড়ে বসে আপনি পুলকিত হলেন। আসলে কি সে ওই লাইনগুলো লিখেছে? না, লিখেনি। এতে তার মেধা ও সময় অপচয় হয়েছে। তার চেয়ে তাকে বলুন দেখি তোমার বাবা সম্পর্কে দশ লাইন লিখো। সে তার বাবাকে কেমন দেখতে চায়, কেমন অনুভব করে আপন মনে লিখবে। এতে তার ভেতর বাবার প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ জাগ্রত হবে। যা তাকে পুলকিত করবে। তার সৃজনীশক্তি বৃদ্ধি পাবে। আবার মনে রাখা উচিত সবাই ফার্স্ট হয় না। হওয়ার প্রয়োজনও নেই। বেসিক বিষয়টি সে কতটা আয়ত্তে আনতে পারলো সেটিই দেখার বিষয়। শিশুর ভেতর মানবিকতা, দেশপ্রেম, মনুষ্যত্ববোধ জাগানোই শিক্ষার মূল লক্ষ্য। আপনি দেখুন সেগুলোর বিকাশ তার ভেতর ঘটছে কি না। ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া কিংবা সব বিষয়ে এ প্লাস পাওয়া মোটেই ভালো ছাত্রের লক্ষণ নয় বরং দেখুন সে প্রাত্যহিক জীবনের সমস্যাগুলো সঠিকভাবে সমাধান করতে পারছে কিনা। পড়াশোনার উদ্দেশ্য যদি হয় চাকরি করা তাহলে সে পড়াশোনা তার ভেতরে ঘুমন্ত সুকুমার বৃত্তিগুলোর বিকাশ ঘটাতে ব্যর্থ হবে। বর্তমান সময়ে আমরা তাই করছি। তাই প্রতিটি পেশাজীবীই টাকা কামানোর ধান্ধায় আছি। আমাদের ভেতর দেশ দেশের মানুষ নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। যদি তাই থাকতো বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ লুট হতো না। সোনালী ব্যাংক হলমার্কস কেলেঙ্কারি হতো না, ক্যাসিনোয় এতো টাকা পাচার হতো না। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়াররা এতো টাকার মালিক হতো না। অন্যান্য অফিশিয়ালরা পার্সোনাল গাড়িতে চড়তে পারতো না। সরকারি চাকরিজীবীরা কোনো মতেই বিলাসবহুল জীবন যাপন করতে পারতো না। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে দেদার উড়িয়ে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে ব্যাংক ব্যবসার বারোটা বাজাতো না। আমাদের মাথায় ছোটবেলা থেকেই গেঁথে দেয়া হয় পাস করে চাকরি কর, টাকা কামাই করো। টাকা কামাইই একমাত্র পড়াশোনার লক্ষ্য! তাই আমরা টাকাই কামাই।

শিশুবেলা থেকেই পড়ার অভ্যাস গড়ে দিতে হবে। জোর করে নয়। আপনিও পড়–ন। আপনাকে দেখে দেখে সেও পড়বে। ছোটবেলা থেকেই তাকে তার বয়স উপযোগী বই সরবরাহ করুন। ধীরে ধীরে অভ্যাস গড়ে উঠবে। শিশুর ব্যর্থতার জন্য তার বাবা মা দায়ী। মনে করুন, কোনো অনুষ্ঠানে আপনার বন্ধুর মেয়ে গান করলো। সবাই খুব হাততালি দিলো। বাসায় এসে আপনার মন খারাপ। আপনার সন্তান গান গাইতে পারে না। তাকে আপনি উপহাস করলেন। তাতে তার মন ছোট হবে। তার ভেতর ক্ষোভ, ক্রোধ জন্ম নেবে। সে আপনার সাথে আক্রমণাত্মক আচরণ করবে। খোঁজ নিয়ে দেখুন আপনার বন্ধু বাসায় ঠিক সে রকম পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে যাতে তার সন্তান আনন্দে আনন্দে শিখতে পারে। আপনি তার আশপাশেও নেই। মানব সন্তান নানা স্ট্রাগলের ভেতর দিয়ে বড় হয়। প্রতি মুহূর্তে আপনার রূঢ় আচরণের সাথে তার আশপাশের মানুষের রূঢ় আচরণের সাথে ফাইট করে তাকে বড় হতে হয়। এ পথে কেউ কেউ জয়ী হয়। বাকিরা ব্যর্থ হয়। কারণ মানুষ প্রতি মুহূর্তেই নতুন নতুন পরিস্থিতির শিকার হয়। সে পরিস্থিতি সামাল দিতে শিশু-কিশোর-যুবকদের পারিবারিক সাপোর্ট লাগে। আমরা আমাদের দেশে সেই সাপোর্ট দিতে পারি না। আমরা বাবা-মা ভাই-বোন সবাই শিশুটিকে নানান চাপে রেখে বড়দের মতো আচরণে বাধ্য করি। এক সময় সে বিগড়ে গিয়ে একাই নিজের পথ রচনা করে। সে পথ আপনার ভালো লাগে না বলেই আপনি বলেন সে বখে গিয়েছে।

কিশোররা হয় দুরন্ত, উচ্ছল, উদ্যমী। তার সে উচ্ছলতাকে কৌশলে রাইট ট্রেকে রেখে যদি সম্মুখে এগিয়ে যেতে দেয়া হয় তাহলে তার ভেতর আস্থা জন্ম নেয়। হ্যাঁ, আমিও পারি। সে আস্থাই তাকে বিপ্লবী নেতা হিসেবে তৈরি করে। সে আস্থাই তাকে আত্মপ্রত্যয়ী হতে সাহায্য করে। কাজেই বাবা-মায়ের স্বীকৃতিই পারে শিশু-কিশোরদের আত্মিক এবং মানবিক উন্নয়ন সাধন করতে।

রাজনীতি এক চক্রান্ত বর্তমানে আমাদের দেশে। অথচ দেশের জন্য কিছু করতে পারার উত্তম উপায় হলো রাজনীতি। বর্তমান সময়ে রাজনীতিতে ইনভলভ হতে হলে আগে তাকে আমাদের দুশো বছরের ইতিহাস, পৃথিবীর চারশ বছরের ইতিহাস জানতে হবে। বিজ্ঞান পড়লেও তাকে ইতিহাস সচেতন হতে হবে নইলে তার ভেতর রাজনৈতিক ভুল চেতনা প্রোথিত হবে। রাজনীতি করবে অর্থ উপার্জনের জন্য। দেশের উন্নয়নের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য করবে। টিকে থাকতে হলে তাকে বিচক্ষণ এবং প্রজ্ঞাবান হতে হবে। এই বিচক্ষণতা ইতিহাস, সাহিত্য, ভূগোল পৌরনীতি এসব বিষয় থেকেই আসে। রাজনীতিতে সহনশীলতা একটি বড়গুণ। এই গুণের শুরু পরিবার থেকে হয়। এখানেই বাবা-মা ভাই-বোন দাদা-দাদী, নানা-নানী চাচা-ফুফু সবাইকে নিয়ে যদি ত্যাগ স্বীকার করে চলতে শিখে তাহলে সে সর্বস্তরেই পারবে। বর্তমানে ছাত্র নেতারা টাকা উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে রাজনীতি করে। সাথে থাকে মাস্তানি। পুরো দেশে তারা ভাগবাটোয়ারা করে ভোগ করছে। দিনমজুরের ঘাম ঝরানো টাকা থেকে চাঁদা নিচ্ছে। কী সাংঘাতিক মানসিকতা। এরা আবার খুনখারাবির সাথেও জড়াচ্ছে। খুব অল্প দিন আগেও আমাদের ছাত্রদের গৌরবময় ইতিহাস ছিলো। তারা ভাষা আন্দোলন করেছে, মুক্তিযুদ্ধ করেছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনে চৌদ্দ বছর অন্ধকার কারাগারে ছিলেন। চুরি-ডাকাতি-খুন-খারাবির জন্য নয়। একেবারেই দেশের জন্য। দেশের মানুষের জন্য। এখন তাহলে ছাত্ররা এমন কেন হলো!

আপনি অর্থ উপার্জনের মেশিন হয়ে গেলেন। সন্তান যা চায় তাই পায়। সে কখনো আশাহত হতে শিখেনি তাহলে আশাহত হওয়ার বেদনা কখনোই বুঝবে না। অনায়াসে আপনাকে খুন করে ফেলতে পারবে। তার উদাহরণ ছোট মেয়ে ঐশী। যে পিতা-মাতা হত্যার দায়ে এখন জেলে। ঐশী একদিনে এতো নিচে নামেনি। সে পেতে পেতে ডিরেইল হয়েছে। আবার বলবো না পেতে না পেতে ডিরেইল হয়েছে। পায়নি পিতা-মাতার সঠিক ভালোবাসা। পিতা-মাতা সময় দেয়নি। সে ভুল পথে চলেছে। টাকা দিতে পারলেই কেউ ভালো বাবা-মা হয় না। টাকা না দিয়েও সুসন্তান গড়ে তোলা যায়। ভালো বাবা মা হওয়া যায়।
কিশোর-কিশোরীদের আরেকটি বড় সমস্যা তাদের দৈহিক পরিবর্তন। সে সাথে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ। এ সময় তারা ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকে। আমার কী হলো রে! দেখা যায় একা থাকতে ভালোবাসে, নিয়মিত ঘুম খাওয়া কিছুই হচ্ছে না। এ দিকে বাবা-মাও পাত্তা দিচ্ছে না। খোঁজ খবর নিচ্ছে না। পাশে বসে আদর করে জানতে চাচ্ছে না কী হয়েছে- তারা ভীষণ বিপদে পড়ে, কাকে বলবে না বলবে! বর্তমান সময়ে আশ্রয় নেয় আকাশ সংস্কৃতিতে। তার যা দেখার কথা নয় সে তা দেখে, যা করার কথা নয় সে তাই করে। ধীরে ধীরে লেখাপড়ায় পিছিয়ে যায়, ভুল বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ডুবে যায়। বর্তমানে কিশোর অপরাধের পেছনে দায়ী একক পরিবারের একাকিত্ব। আগে ছিলো যৌথ পরিবার দাদী-নানী-চাচী অন্যান্য সবাইকে নিয়ে। কেউ না কেউ তাদেরকে সময় দিতোই। নানান খেলাধুলায় মগ্ন থাকতো ফলে নিজেকে নিয়ে এতো ভাববার সময় ছিলো না থাকলেও লজ্জা শরমে ঢেকে যেতো সব। বর্তমানে একক পরিবারের বিষণœতায় কিশোর-কিশোরী হারাচ্ছে তাদের নৈতিকতা। কেউ নেই কাউন্সেলিং দেয়ার। বাবা-মা দুজনই হয়তো চাকরিজীবী নয়তো ব্যবসায়ী। কাজের লোকের উপর সন্তানকে দিয়ে চলে যায়। ফলে বন্ধুর সন্ধান করে। এ সময় যেহেতু রাগ-অনুরাগের বিকাশ ঘটে সেহেতু তারা বিভিন্ন রিলেশনশিপে জড়িয়ে যায় কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এটি নয় যখন বুঝতে পারে তখনই খুন-গুম ইত্যাদির সাথে তারা জড়িয়ে যায়। কিশোর-কিশোরীদের যত না অপরাধ তার চেয়ে বেশি অপরাধ তাদের বাবা মায়ের।

আমাদের উচিত আমাদের সন্তানদের সময় দেয়া, তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা, তাদেরকে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে দেয়া, মাঠে খেলার সুযোগ করে দেয়া, সামাজিক কাজে উদ্বুদ্ধ করা, কাজের স্বীকৃতি দেয়া। সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শ দেয়া। জীবন জগৎ সম্পর্কে জানতে দেয়া, মানিয়ে চলতে শেখানো, রাগ-অনুরাগ সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করে দিকনির্দেশনা দেয়া। একক পরিবার পরিহার করে যৌথ পরিবারে থাকার চেষ্টা করা, পরিবারের বড়-ছোট সম্মানজনক সম্পর্ক তৈরি করা। সিনিয়র সিটিজেন সাথে রাখা তাদের যত্ন আত্তি করা। বাড়িতে বা বাসায় নরম ভাষায় যোগাযোগ করা, বাসার পরিবেশ আনন্দদায়ক রাখা।

Share.

মন্তব্য করুন