গল্পটি শুরু করা যাক তাঁর বক্তৃতা নিয়ে। কেমন বক্তৃতা দিতেন তিনি? কিভাবে দিতেন। কেনো বক্তৃতা নিয়েই শুরু করছি তাঁর গল্প? এসবের জবাবে এককথায় বলতে হয় তাঁর বক্তৃতা ছিলো অসাধারণ! বিস্ময়কর! অবাক করার মতো।
খুব বেশি বলেছি মনে হয়? না কিন্তু। একদম বেশি নয়। বাড়িয়েও নয়। এটিই সত্য। এটিই ছিলো বাস্তব। যারা শুনেছেন তাঁর বক্তৃতা নিশ্চয় তারা সাক্ষ্য দেবেন। তারা বলবেন সৈয়দ আলী আহসানের বক্তব্য মানেই অন্যরকম! অন্যকিছু! অন্য সুন্দরে উন্নিত।
সাধারণ বক্তব্যের সাথে তা তুলনীয় নয়।

তিনি পণ্ডিত! তিনি মনীষী! তিনি কবি। তিনি বিশ্ব সাহিত্য বোদ্ধা। তিনি জানতেন খুব। অনেক বিষয় জানতেন। যা জানতেন ঠিকঠিক জানতেন। ভালোভাবেই জানতেন। এবং যা জানতেন তা বলতেন শৈল্পিক আনন্দে। তাঁর প্রকাশ করার ভাষা ছিলো অসাধারণ! বলার ঢঙ অনন্য। বলার জন্য জানতে হয় আগে। কিন্তু জানলেই বলা যায় এমন হয় না সব সময়। সবাই বলতে পারেন না এটি সত্যি। কিন্তু ভালো বলতে হলে অবশ্যই ভালো জানতেও হবে। জানতে হবে যথাযথ। সৈয়দ আলী আহসান জানতেন। জানতেন আগাগোড়া। উপর ও তল সবই জানতেন। ঠিক বলতেনও তেমন করে। বলতেন তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে। নিজস্ব ভাষায়! নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে। নিজস্ব ভাষা ভঙ্গি ছিলো তাঁর। যেমন বলায়। তেমনই লেখায়। তেমনই উচ্চারণে। এবং তেমনই শব্দ চয়নে।

তিনি অনুষ্ঠানে আসতেন। বসতেন ধীরস্থির ভাবে। শান্তচিত্ত। গভীর আত্মবিশ্বাসের সাথে দাঁড়াতেন ডায়াসে। দাঁড়িয়ে শ্রোতাদের দেখে নিতেন একনজর। তিনি কিছুটা বেঁটেখাটোর কাতারের ছিলেন। মাথাটি গোলগাল। সাদা চুল। সাদা দাড়ি। পাওয়ারি চশমা চোখে। নিজেকে ঠিকঠাক করে শুরু করতেন কথা। শুরু করতেন নির্দিষ্ট বিষয়ে। শুরুর বাক্যইটিই থাকতো অন্যরকম। দর্শক এবং শ্রোতা শুরু থেকেই চুপ। শুধু তাঁর মুখের শব্দ বেজে উঠতো সহসা। তাঁর মুখ থেকে শব্দ যেনো বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঝরতো। কিংবা তসবিহ দানার মতো পড়তো। শব্দের ঝংকার মোহিত হতো শ্রোতা। কান পেতে থাকার অপূর্ব দৃশ্য থাকতো তাঁর বক্তব্যের মুহূর্তে। অনর্গল বলতেন তিনি। বলতেন ছোট ছোট বাক্যে। যেখানে থামার থামতেন। যেখানে শ্বাস নেবার নিতেন। কিন্তু কোথাও থমকাতেন না। আটকাতেন না। অর্ধেক বাক্য বলতেন না। কোনো বাক্য দুবার বলতেন না। একটি প্রবহমানতার ভেতর বক্তব্য এগিয়ে যেতো। মনে হতো বুঝি রেকর্ড করা কোনো বিষয় বেজে যাচ্ছে। শুরু থাকতো। শেষও থাকতো। থাকতো বক্তব্যের মূল কথা। শুরুটা যেমন আকর্ষণীয় ছিলো। শেষটাও আকর্ষণের।

এভাবে বক্তব্য দিতেন তিনি। তাঁর অনেক বক্তৃতা লেখার পর আর্টিকেল হয়েছে। যে বিষয়েই বলতেন লিখে নিলে প্রবন্ধ অথবা নিবন্ধ হয়ে উঠতো।
তাঁর জ্ঞানের বহর নিয়েও গল্প করা যায়। তিনি বহু বিষয়ে জানতেন। কবিতার রহস্য জানতেন তিনি। জানতেন প্রবন্ধ নিবন্ধের ভেতর জগৎ। বিশ্বসাহিত্য ছিলো তাঁর জ্ঞানের আওতায়। বিশ্বের কোন প্রান্তে সাহিত্যে কি হচ্ছে জানতেন তিনি। বিশ্বে বড় কবিদের বিষয়ে জানা ছিলো তাঁর। অনেক কবি ছিলো তাঁর বন্ধু। বিশ্ব উপন্যাসের বিষয়ও জানতেন তিনি। অনেক দেশের অনেক খ্যাতিমান ঔপন্যাসিকও তাঁর বন্ধু ছিলো। কিছু দার্শনিক, পণ্ডিত এবং চিত্রশিল্পীও ছিলো তাঁর বন্ধু। এভাবে তাঁর খ্যাতি ছিলো আন্তর্জাতিক। বাংলাদেশ তাঁকে নিয়ে গৌরব করতে পারে। তিনি বিশ্বসাহিত্য ও শিল্পকলায় নির্ভর করার মতো একজন।

তাঁর লেখালেখির গল্প তো আরও বড়। তিনি কবি। কবিতা লিখেছেন। তিনি গদ্যকার গদ্য লিখেছেন। তাঁর কবিতা যেমন তাঁর নিজস্বতায় চিহ্নিত। তেমনই তাঁর গদ্যও অসাধারণ। বাংলা গদ্যের আলাদা একটি সৌন্দর্য নির্মাণ করেছেন তিনি। তিনি শিল্পকলা নিয়ে বই লিখেছেন। চারুকলায় ক্লাস নিয়েছেন শিল্প বিষয়ে। শিল্পকলা একাডেমির প্রশিক্ষক ছিলেন তিনি।
সাহিত্য ও কবিতার বিভিন্ন দিক ও বিষয় নিয়ে লিখেছেন। লিখেছেন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে। রান্না বিষয়েও বই আছে তাঁর। তিনি আমাদের মহানবী সা.কে নিয়ে লিখেছেন। নবীকে নিয়ে বই আছে তাঁর।
এভাবে নানান বিষয়ে আছে তাঁর বিবেচনা করার মতো রচনা। যাকে আমরা সুখপাঠ্য রচনা বলি। তাঁর লেখা ঝরঝরে। মুগ্ধ হওয়ার মতো। পাঠ করতে ক্লান্তি আসে না।
আরও অনেক গল্প আছে তাঁর। তাঁকে পাঠ করলে জানতে পারবো সব।

Share.

মন্তব্য করুন