ঘড়ির কাঁটা ১.০০টা ছুঁই ছুঁই করছে। হঠাৎ ইউভানের ঘুম ভেঙে গেল। এ সময় ঘুম ভেঙে যাওয়া সবার জন্যই বিরক্তিকর। ইউভানেরও তাই মনে হচ্ছে। মাথাটা প্রচণ্ড ব্যথা করছে। হঠাৎ চোখ পড়লো কাচের বোউল অ্যাকুয়ারিয়ামটার দিকে। বিছানার পাশে ওয়ারড্রোবের উপরে রাখা কাচের গোলাকার বোউলটা। তিনটা গোল্ডেন কালারের গাপ্পি মাছ রয়েছে। সেদিন অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় কিনে এনেছিলো। আজ একটি দেখা যাচ্ছে মরে ভেসে আছে। ইউভান খেয়াল করলো বাকি দুটো মাছ, বন্ধু শোকে যেনো ছটফট করছে। সে উঠে গিয়ে মরা মাছটাকে বের করে জানালা দিয়ে বাইরে বের করে ফেলে দিলো আর ওমনি একটা হুলো-বিড়াল মাছটাকে মুখে নিয়ে জঙ্গলের দিকে দৌড় দিলো। মনে হয় তার ছানারা খাবারের জন্য অপেক্ষা করছে। ইউভান বেসিনে হাত ধুয়ে নিলো। ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে কয়েক ঢোক গিললো। ২৫ বছরের তাগড়া যুবক ইউভান। প্রচণ্ড গরম আজ। সে ঘেমে ভিজে চুপসে আছে। ফ্যানের রেগুলেটর বাড়িয়ে দিয়ে টি-শার্ট খুলে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো। তোয়ালে দিয়ে গা মুছে ভাবতে থাকে কি হচ্ছে এসব? মনটা কেনো ভালো নেই তার? দেশের স্বনামধন্য রোবোটিকস ইঞ্জিনিয়ার সে। কোথায় যেনো একটা ঘাটতি রয়ে গেছে। অতৃপ্ত সে। আর এখন এই নিঃসঙ্গ রাতে কষ্টটা নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আধুনিক রোবোটিকস বিজ্ঞানে তার অবদান বলে শেষ করা যাবে না। এঞ্জেলবার্ন থেকে ইউভান; রোবোটিকস বিজ্ঞানের বিশাল এক পথচলা। প্রথম প্রজন্ম থেকে আজ পঞ্চম প্রজন্মে রোবোটিকস। রোবটসমূহ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতা, নিপুণতা, সঠিক ম্যানুপুলেশন সব দিকে এগিয়ে। তবুও বিজ্ঞানের অন্যান্য যন্ত্রপাতির তুলনায় রোবোটিকস প্রযুক্তি এখনো তুলনামূলকভাবে মান্ধাতা আমলের বলা যায়। হিউম্যানয়েড হওয়ার পরও এটা খুব সহজে বুঝা যায়, এর আচরণ ও কার্যকলাপ দেখে। যেনো খেলনা পুতুল! আরেকটু ডেভেলপ হলে কেমন হতো? এসব এলোমেলো ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো সে। সারারাত কি সব উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখে রাত পার করলো। বেশি দুশ্চিন্তা করলে মনে হয় এমন হয়।

দুই.

পরদিন মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে ইউভানের মা ডেকেই চলছেন…
‘কিরে এতো ঘুমালে হবে? অফিসে কখন যাবি বাবা? সেই কখন থেকে নাস্তা নিয়ে বসে আছি।’
‘হুম যাই মা, ফ্রেশ হয়ে আসছি’- বাধ্য ছেলের মতো ইউভানের উত্তর। ইউভানের বাবা নেই। যখন সে ইন্টারমিডিয়েড পড়তো তখন এক রোড এক্সিডেন্টে ইউভানের বাবার মৃত্যু হয়। দেশের নামকরা রসায়নবিদ ছিলেন ড. উপল চৌধুরী। শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য মুহূর্তে অদৃশ্য হওয়ার রাসায়নিক পদার্থ ঘঐঝ-৩১২৫ আবিষ্কার করে সেবার হইচই ফেলে দিয়েছিলেন বিজ্ঞান মহলে। এই ঘঐঝ-৩১২৫ দেশের ঈওউ অফিসাররা ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনে নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করতেন। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যক্তি এই যোগটিকে তাদের খারাপ কাজে ব্যবহার করলে তিনি এর ফর্মুলা স্থায়ী ভাবে নষ্ট করে দেন। এ তো গেলো তার দক্ষতার কথা। কিন্তু এক রোড-এক্সিডেন্টে পৃথিবী হারিয়ে ফেললো এই লিজেন্ডকে। কিন্তু ইউভানের মা নীলা চৌধুরী থেমে থাকেন নি। শত কষ্ট সহ্য করেও ছেলেকে বানিয়েছেন দেশের নামকরা পদার্থবিদ ও রোবোটিকস ইঞ্জিনিয়ার। আসলে একজন মা কিন্তু সন্তানের সবচেয়ে বড় কারিগর, মানুষ গড়ার কারিগর। মায়ের কি তুলনা হয় পৃথিবীতে? ইউভান ও তার মা। তাদের একটা ছোট্ট কিন্তু সুন্দর বাড়ি। খুব সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত তারা। কোনো অহঙ্কার নেই তাদের। দেশের নামকরা রোবোটিক হাউস ‘বঙ রোবোটিকস’ এ একজন পেশাদারি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছে ইউভান। বেতন ভালোই পায়। এ দিয়ে ভালোভাবে চলে যায় মা ও ছেলের। ইউভান রুটিতে মাখন লাগাতে লাগাতে বললো, ‘আম্মু রোজ একটাই চিন্তা আমার। কিভাবে রোবটকে আরও উন্নত করা যায়। ভাবতে পারছো ২০২৫ সালে এসেও রোবটগুলো একদম খেলনা পুতুলের মতো। হিউম্যানয়েড বলতে কি শুধু মানুষের আচরণ নকল করা আর বেশি কিছু নয়?’
‘হুম তা হঠাৎ এমন কেন মনে হচ্ছে তোর? হুবহু কি মানুষ এর একটা কপি তৈরি হবে নাকি. আর কি দরকার খোদার উপর খোদকারী করতে?’ জুস গ্লাসে ঢালতে ঢালতে মিসেস নীলা চৌধুরীর জবাব- ‘মা আমি সেটা বলিনি। আমি বলতে চাচ্ছি রোবটগুলো আরও উন্নত করা। এর ইলেকট্রন প্রবাহ নিরবচ্ছিন্ন করা যাতে এগুলো সার্ভিস ভালো দেয়।’
‘তা কি ভাবলি ইউভান, নতুন কিছু?’
‘ভাবনা তো একটা আছে। আমার নতুন আবিষ্কার।’
‘নতুন আবিষ্কার? কি সেটা। মায়ের চোখে বিস্ময়। ইউভান মুচকি হেসে উত্তর দিলো- ‘মা রোবো-ক্যাপ। মানে রোবোটিক ক্যাপসুল। আমরা মানুষ যেমন খাবার খাই, ঔষধ হিসেবে এন্টি-বায়োটিক ক্যাপসুল খাই ঠিক সে রকম। এই ক্যাপসুলটি মূলত ইলেকট্রন আধানযুক্ত এক ধরনের চিপস। কিন্তু এটা সফল করতে পারমাণবিক বা আণবিক যে তত্ত্ব রয়েছে সেটা খোঁজা। আর এই ক্যাপসুলটি বিশেষ ধাতব ওঈ বা ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট দ্বারা পরিচালিত হবে। এক্ষেত্রে রাদারফোর্ড ও নীলস বোর এর পরমাণু মডেল কাজে লাগতে পারে।’
‘হুম দেখ শেষমেশ কি হয়? চেষ্টা করতে দোষ কি? ইউভান ঘড়ির দিকে তাকালো। ৯.২০ বাজে। ১০.০০টার মধ্যে অফিসে উপস্থিত হতে হবে তাকে। জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে মায়ের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে নিচে নামলো সে। ড্রাইভার গাড়িতে বসে আছে। ইউভান মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। মা তাকিয়ে রইলেন ছেলের নীল রঙের কারটার দিকে। মনে হয় এটা যেনো ইউভান নয় স্বয়ং উপল চৌধুরী। মায়ের চোখের কোণে অশ্রু।’

তিন.

‘বঙ রোবোটিকস’ এর বিলাসবহুল অফিস। পাশে কয়েকটা বড়সড় কারখানা এগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে রোবট তৈরি হয়। বিশ্বের বহু দেশে রফতানি হয় এসব রোবট। নানা আকৃতির, নানা বৈশিষ্ট্যের রোবট তৈরি করে বাংলাদেশের এই বিখ্যাত বহুজাতিক কোম্পানিটি। ২০২৫ সালে এসে বাংলাদেশ প্রযুক্তির শীর্ষ থাকা দেশগুলোর একটি। একজন লোক বঙ-৪ মডেলের একটি রোবট নিয়ে এসেছে। মনে হয় সমস্যা হয়েছে। তাই সার্ভিসিং করাতে এনেছে। ইউভান কাস্টমার কেয়ার ম্যানেজার রিফায়াতকে এর সমস্যার কথা জিজ্ঞাসা করে একে কারখানায় পাঠাতে বলে এমডি স্যারের রুমে প্রবেশ করলো।
‘মে আই কামিং স্যার?’ ইউভানের হাস্যোজ্জ্বল চাহনি। এমডি স্যার মুচকি হেসে বললেন,
‘অফকোর্স ইয়াংম্যান?! হুম বসো, খুব চিন্তিত মনে হয়?’
‘ধন্যবাদ স্যার!’ ইউভান চেয়ারে বসলো।
‘কি খাবে বলো? জুস অর কফি!’ এমডি স্যার নড়েচড়ে বসলেন। ইউভান মুচকি হেসে বললো, ‘জুসটাই ভালো। হেলদি আর ঠাণ্ডা তাই না স্যার?’ স্যার এবার হেসেই ফেললেন। অফিস পিয়ন রোবট ইলিয়ানা এসে জুস আর স্যান্ডউইচ দিয়ে গেলো। খেতে খেতে প্রায় এক ঘণ্টা আলাপ করে ইউভ্যান কারখানা ভিজিটে গেলো। কারখানায় ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট বদরুলসহ পাঁচজন তরুণ বিজ্ঞানীর সাথে তার প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করলো। মিশন একটাই আর তা হলো রোবো-ক্যাপ।

চার.

বাসায় এসেই গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেলো ইউভান। মায়ের সাথে বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করতে করতে দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যা নামলো। মা নাস্তা ও চা নিয়ে ইউভানের পাশে বসলেন। ইউভান ল্যাপটপে তার গবেষণার ডেমো চেকে করছে। আর কিছুক্ষণ পরপর মাকে জিজ্ঞেস করে, সে সফল হবে তো? মা আশ্বাস দেন। আসলে ইউভান জিতে গেলে মা-ই যেনো জিতে যান। আসলে প্রত্যেক সন্তানের ভিতরেই একজন মা আর একজন বাবা দ্বিতীয় সত্তা হিসেবে থাকেন। কিন্তু বেশির ভাগ সন্তান সেটা বুঝতে পারে না। পারলেও অনেক দেরি হয়ে যায়। ইউভান বিভিন্ন পদার্থবিদের তত্ত্ব ও বিজ্ঞান জার্নালগুলো ঘাঁটছে। ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিজম, আণবিক পদার্থ বিজ্ঞান, পারমাণবিক শক্তি, ন্যানোচিপস, পরমাণুতত্ত্ব সব ঘেঁটে ঘেঁটে হয়রান। গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস থেকে রাদার ফোর্ড, ম্যাক্সওয়েল, নীলস বোর কেউ বাদ যায়নি। এবার সে বোরের পরমাণু মডেল খেয়াল করলো। বোরের মতে, পদার্থের পরমাণুতে ইলেকট্রন প্রথমে সর্বনিম্ন শক্তির অরবিটালে প্রবেশ করে এবং ক্রমান্বয়ে উচ্চশক্তির অরবিটালে প্রবেশ করে। অর্থাৎ হ+১ এর যোগফল কম বা বেশি। কম হলে ইলেকট্রন আগে প্রবেশ করে তারপর বেশির দিকে যায়। এখানে হ হলো প্রধান শক্তিস্তর এবং ১ হলো উপশক্তিস্তর। এদের যোগফল হ+১ ঠিক করবে ইলেকট্রন-প্রবাহ। যেমন ৩ফ অরবিটালের জন্য হ=৩ এবং ১=২ হলে হ+১ এর মান হবে ৩+২=৫ আবার ৪ং অরবিটালের জন্য হ=৪, ১=০ হলে হ+১ এর মান হবে ৪+০=৪ এখানে ৫>৪ (৩ফ>৪ং) অর্থাৎ ৩ফ এর থেকে ৪ং কম শক্তি সম্পন্ন। তাই ইলেকট্রন আগে ৪ং অরবিটালে এবং পরে ৩ফ অরবিটালে প্রবেশ করছে। ইউভান ভাবলো, এখানে প্রধান সমস্যা অরবিট বা কক্ষপথ সংক্রান্ত। অরবিটালের এই সমস্যা দূর করলেই ইলেকট্রন প্রবাহ নিরবচ্ছিন্ন হতে পারে কিন্তু অরবিটালের সমস্যা দূর করার প্রযুক্তি সে কোথায় পাবে? এটা কি আদৌ সম্ভব নাকি কল্পনা?

পাঁচ.

পরের দিনের কথা! ‘বঙ রোবোটিকস’ এর অত্যাধুনিক ল্যাবে ইউভান, বদরুলসহ পাঁচজন তরুণ পদার্থবিজ্ঞানী ইউভান তার গবেষণাপত্র সবাইকে বুঝিয়ে দিলো। সবাই একমত। ইউভান বললো, ‘আমরা যদি ইলেকট্রিক্যালি অরবিটগুলো মডিফায়েড করে একরকম পর্যায় আনতে পারি তাহলে এটা সম্ভব। বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ধাতব পাত দিয়ে এই ওঈ তৈরি করতে হবে। তারপর বিশেষ এক ধরনের রোবে ক্যাপ বা রোবোটিক ক্যাপসুলের মধ্যে ওঈ গুলো জুড়ে দিয়ে দিতে হবে। তারপর সেটা রোবোটের ঈচটতে সংযোজন করলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। চলো সবাই আমরা সেই মোতাবেক কাজ করি।” সবাই সে মোতাবেক কাজ শুরু করলো। একদিন, দুই দিন, এক মাস তারপর ছয় মাস অবশেষে তারা সফল হলো। কয়েবার সার্কিট পুড়ে যাওয়ার মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও ঘটলো। ইউভানের টিম এই আবিষ্করের নাম দিলো- ‘বঙ-৭ ঢচ’
‘বঙ ঊীঃবহফবফ চৎড়ভবংংরড়হধষ রোবোটিক ক্যাপসুল চিপস।’ ইউভান ও তার টিমের এই আবিষ্কার গোটা বিশ্বে তোলপার তুললো। এই ক্যাপসুল রোবটদের জন্য ব্যবহারের অনুমতি দিলো ইটঊঞ, গওঞ সহ বিভিন্ন বিজ্ঞান সংস্থা ও দেশ। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন চ্যানেলে ও সংবাদপত্রে এর খবর প্রকাশ হচ্ছে। বাসায় ইউভান মা টিভিতে ছেলের এই কৃতিত্বের খবর শুনছেন। গোটা বিশ্ব ইউভান ও তার টিমকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। কিন্তু ইউভান জানে, এই কৃতিত্ব আসলে তাদের নয়। এই কৃতিত্ব হলো তাদের প্রত্যেকের রত্নগর্ভা মায়েদের, সারা জীবনের রক্ত তিলে তিলে পানি করে সন্তানকে গড়ে তোলা আদর্শ বাবাদের। কিন্তু হায়, তাদের অবস্থান আজ কোথায়? আসলে বাবা-মায়ের অবস্থান সর্বোচ্চ হওয়া উচিত। সব মা-বাবাই ভালো থাকুক। ইউভানের বাবা নেই কিন্তু অন্যদের তো আছে। তারা যেনো তাদের মা-বাবাকে ভালো রাখে। আর ইউভানের মা! এক জনম দুঃখিনী মা। ইউভানরা জিতলে মায়েরাই তো জিতে যায়। মায়েরা বিনিময়ে কিছু চান না। সারাজীবন শুধু দিয়ে যান। ইউভান এবার দৃঢ় হয়। এক্ষুনি তাকে বাসায় যেতে হবে। মাকে খবরটা দিতে। মা যে অধীর আগ্রহে তার পানে চেয়ে আছে। ইউভান নিজের অজান্তেই বলে ওঠে, ‘আমি আসছি মাগো।’

Share.

মন্তব্য করুন