বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। কিংবদন্তি শহর। ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতির ধারক ও বাহক চারশত বছরের শহর ঢাকা। এই শহরের নানা জায়গায় অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন নানান স্থাপত্য আমরা দেখতে পাই। শহর ঢাকায় চত্বর যা আছে তা আকারে খুব বড় নয়। সাধারণত রাস্তার মোড়কে চত্বর বলা হয়। এমনই একটি চত্বর হলো মতিঝিল শাপলা চত্বর। মতিঝিল দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা। এটি ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। মতিঝিল ঢাকা শহরের প্রধান ব্যবসায়িক এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। শাপলা চত্বরের কারণে মতিঝিল সকলের কাছে বিশেষ পরিচিত। একসময় ঢাকার সিনেমায় একটি বারের জন্য হলেও এই শাপলা চত্বরটি দেখানো হতো। তখন মতিঝিল ব্যাংকপাড়া বা অফিসপাড়া শুধু নয়, ঢাকার অন্যতম প্রতীক ছিল এই শাপলা চত্বর। এখনো মতিঝিল এলেই প্রথমে দেখা হয়ে যায় আমাদের জাতীয় ফুল শাপলার সাথে। না এখানে কোনো জলাধার নেই। নেই পুকুর বা কোনো ঝিল। নদী নেই, ডোবা নেই তবে শাপলা ফুল কিভাবে ফুটে আছে! মতিঝিলের বুকে। এই আমাদের জাতীয় ফুল মতিঝিল পিচঢালা চৌরাস্তার বুকে নান্দনিকভাবে ফুটে আছে এর স্থপতি আজিজুল জলিল পাশা। মতিঝিল চৌরাস্তার প্রাণকেন্দ্রে এলে বিশালাকার শাপলা ফুলের ছবিটি আমরা দেখতে পাই। ঢাকায় চত্বরের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে শাপলা চত্বর। এখনো শাপলা চত্বরটি আমাদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়।

আমাদের জাতীয় ফুল বলে সবাই সহজে একে চিনতে পারি। এই চত্বরটির চারপাশ বৃত্ত আকৃতির। স্টিলের বেড়া দ্বারা ঘেরা চৌদিক। স্টিলের বেড়া ঘেঁষে আছে গোলাকার স্থলভাগ। যা সবুজ ঘাসে আবৃত। মাঝে মাঝে রয়েছে ছোট ছোট ফুলের গাছ। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রঙ্গন ফুল গাছ। এরপর দেখা যায় ছোট একটি দেয়াল। দেখতে দেয়াল মনে হলেও এটি আসলে দেখতে জলের ঢেউয়ের মতোই। ঢেউ ভেঙে ভেঙে দেয়ালটি যেন শাপলাটিকে ঘিরে করছে নৃত্য। এ ঢেউয়ের মাঝে ফুটে থাকে সহসা একটি কল্লোলহীন কাল্পনিক উল্লাস। তারই একটি নমুনা দেখতে পাই ঢেউদেয়াল ঘেরা ছোট্ট জলাধারটি। দেখতে যেমন নান্দনিক তেমনি প্রাণচঞ্চল। ছোট্ট এই জলাধারটি যেন শাপলাটিকে সতেজ রাখতে সাহায্য করছে। রাতের শাপলা চত্বর আরো বেশি সতেজ দেখা যায়। রাতে চারিদিকে আলোর সাথে ঝর্ণা ধারাটি যখন উপরের দিক পানি ছিটকে থাকে তখন মনে হয় প্রকৃত শাপলাই আমাদের দৃষ্টিজুড়ে হেসে উঠছে। তখনই মনে হয় লাজুক শালুক। অনাবৃত হয়ে বুকের সাদা পাপড়ি ও হলুদ বৃতি দেখিয়ে দিচ্ছে সরল উপমায়। তখন শাপলার সৌন্দর্য দ্বিগুণ থেকে চারগুণ হয়ে যায় আপন মহিমায়।

বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা জলপদ্ম প্রজাতির শালুক। প্রায় সারা বছর শাপলা ফুটতে দেখা যায়। এই উদ্ভিদ জন্মানোর শ্রেষ্ঠ সময় বর্ষা ও শরৎ। আমাদের দেশে শাপলা ফুল নানা রঙের দেখা যায় যেমন- সাদা, নীল, বেগুনি, গোলাপি, ইত্যাদি। তবে জাতীয় প্রতীক হিসেবে সাদা শাপলাকেই নির্বাচিত করা হয়েছে। সাধারণত শাপলা ফুল ফোটে ভোরবেলায়। সূর্যের তাপ বাড়ার পরপরই এর পাপড়ি নুয়ে পড়ে। তবে মতিঝিল শাপলা চত্বরের এই শাপলা কোনোদিন নুয়ে যাওয়ার নয়। এটি চিরকাল আমাদের আনন্দ আর গৌরবের জাতীয় প্রতীক হয়ে থাকবে আমাদেরই দৃষ্টিজুড়ে। এমন দৃষ্টিনন্দন যে শাপলা চত্বরটি আজ দেখতে পাই এর পেছনে রয়েছে আমাদের আরেক ইতিহাস। এই চত্বর ‘শাপলা চত্বর’ হওয়ার আগে ছিল একটি গণকবর। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে এদেশের লাখ লাখ মানুষ শহীদ হন। তখন একটি একটি লাশ কবর দেয়ার সুযোগ ছিল না বেশির ভাগ জায়গায়। সেই কঠিন সময় এখানেই শহীদদের গণকবর দেয়া হয়। শাপলার আড়ালে আজ ঢাকা পড়ে আছে আমাদের চেতনার ইতিহাস। যাদের প্রাণের বিনিময় আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন বাংলাদেশ।

Share.

মন্তব্য করুন