ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে একটির নাম হচ্ছে কোমোডো। এই দ্বীপে কোনো মানুষের বসবাস নেই। চারদিকে গভীর অরণ্য। ছায়া ছায়া অন্ধকার। ভেজা মাটি। এই কোমোডো দ্বীপের একটি রহস্যময় প্রাণীর কথা হঠাৎ প্রচণ্ড চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করল। ১৯১২ সালে সেই দ্বীপে আকস্মিকভাবে একটি বিমান ভেঙে পড়ে। বৈমানিক কোনোমতে বেঁচে যায়। কোমোডো দ্বীপে বেশ কিছু হিং¯্র প্রাণী রয়েছে। বৈমানিক বুদ্ধি করে এইসব প্রাণীদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হন। কিন্তু তিনি সেখানে এমন একটি অদ্ভুত প্রাণী দেখেন যা তাকে আতঙ্কিত করে তোলে। তিনি দেখেন প্রাণীটির মুখ থেকে আগুনের শিখা বেরুচ্ছে। সেই দ্বীপ থেকে কোনোরকমে উদ্ধার পেয়ে বৈমানিকটি সভ্য নগরে ফিরে এসে বর্ণনা করেন তার সেই বিচিত্র রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কথা। তিনি জানান, আগুনমুখো ড্রাগন তিনি দেখেছেন সেই দ্বীপে।

তার এই কথাকে অনেকেই তখন পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেয়। ড্রাগন হচ্ছে চীনের একটি কাল্পনিক প্রাণী। ড্রাগন নিয়ে প্রাচীনকালে চীনে অনেক গল্পগাথার সৃষ্টি হয়েছিল। চীনের পৌরাণিক কাহিনিতে ড্রাগনের কথা আছে। আধুনিক সভ্য পৃথিবীতে এই পৌরাণিক প্রাণীটিকে কী করে দেখা যাবে?
১৯৪৭ সালে একদল আমেরিকান অভিযাত্রী কোমোডোর দ্বীপে যায় সেই রহস্যময় প্রাণীর খোঁজে। তারা সেই ভয়ঙ্কর আকৃতির প্রাণীটির ছবি তুলতে সমর্থ হয়। যখণ সেই ছবি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলো যখন অনেকেই রীতিমত বিস্মিত হলো। এই ধরনের বিচিত্র আকারে কোনো প্রাণী যে ইন্দোনেশিয়ার একটি দ্বীপে আছে তা ভেবে অনেকে স্তম্ভিত হলো। তবে আমেরিকান অভিযাত্রীদের নেতা বললেন, ওই প্রাণীটির মুখ দিয়ে আগুন বের হয় না। বের হয় কমলা রঙের চকচকে জিভ। সেই জিভটি যখন বাতাসে সাঁই সাঁই করে কাঁপতে থাকে মনে হয় বুঝি আগুনের শিখা ঝলকে ঝলকে বেরুচ্ছে।

এরপর ফ্রান্স থেকে একদল টিভি তথ্যচিত্রের কলাকুশলী সেই দ্বীপে যায় এবং ছবি তোলে। সেই ছবির নাম দেয়া হলো কোমোডের ড্রাগন। বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করল সেই ছবিটি। এ যেন বিখ্যাত বিজ্ঞান কল্পকাহিনির লেখক এইচ জি ওয়েলস এর লেখা ‘হারানো মহাদেশ’ এর কোনো আজব প্রাণী। বিজ্ঞানী বললেন, এই ধরনের প্রাণী পৃথিবীতে পাঁচশো লক্ষ বছর আগে অষ্ট্রেলিয়াতে ছিল। এটি হচ্চে মনিটর লিজার্ড জাতের প্রাণী। আকারে দেখতে গোসাপের মত। বড় হয় পনেরো ফুটের মত। সেই প্রাগৈতিকহাসিক কালের প্রাণীর কঙ্কাল তারা দেখেছিলেন।

বিজ্ঞানীদের এই কথায় রহস্য আরও ঘনীভূত হলো। জাকার্তা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রণীবিজ্ঞান বিভাগের বিজ্ঞানীরা ব্যাপকভাবে এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাতে লাগলেন। ১৯৬১ সালের মধ্যে কোমোডোতে বেশ কয়েকটি অভিযান চালানো হলো। এর ফলে পাওয়া গেল আরও অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা গেল শুধুমাত্র কোমোডোতেই নয়, তার আশপাশের আরও চারটি দ্বীপে রয়েছে এই প্রাণী। আবার চিন্তায় পড়লেন বিজ্ঞানীরা। দূরের অস্ট্রেলিয়া থেকে কী করে এখানে এলো এসব প্রাণী? কেমন করে এতদিন ধরে এখানে টিকে রইল? পৃথিবীর অন্য কোথাও তো এই ধরনের প্রাণীর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে আগ্রহ প্রকাশ করল রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা। ঠিক হলো ইন্দোনেশিয়া আর রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে সেই দ্বীপগুলোতে অভিযান চালাবে।
জাহাজে করে এক সময় বিজ্ঞানীরা গেলেন সেই দ্বীপে। দ্বীপে নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটো ড্রাগন দেখা গেল। একটা তেরো ফুট লম্বা। অন্যটা সাত ফুট। শক্ত সমর্থ পা। খয়েরি কালো রঙ। মাটির উপরে লেজটাকে ঘষটে ঘষটে হাঁটে। বোঝা গেল, এদের লেজে রয়েছে সাংঘাতিক ধরনের শক্তি। বিজ্ঞানীরা একটা মরা হরিণ এনেছিলেন। দেখা গেল ড্রাগন দুটোর রাক্ষুসে ক্ষিধে। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা হরিণটাকে কামড়ে চিবিয়ে গিলে খেয়ে ফেলল। একেবারে চামড়া এবং শিংসুদ্ধ। কয়েকদিন পর দেখা গেল একটা ড্রাগন লেজের এক বাড়িতে একটি বুনো শুয়োরকে মেরে ফেলেছে। খুব পেটুক স্বভাবের প্রাণী এরা। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন খাবারের লোভ দেখিয়ে এদের আটকাতে হবে। বেশ ক’টা প্রাণী তখন ধরা হলো। জার্কাতার চিড়িয়াখানায় এনে রাখা হলো কয়েকটি।

গবেষণার প্রয়োজনে তিনটি প্রাণীকে ব্যবচ্ছেদ করা হলো। দেখা গেল, এরা আসলেই পাঁচশো লক্ষ বছর আগের পুরানো অস্ট্রেলিয়ার রহস্যময় সেই অদ্ভুত প্রাণী। একটা ড্রাগনকে সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়া হলো। দেখা গেল, সে দিব্যি সাঁতার কেটে তীরে উঠে এসেছে। এ থেকে অনুমান করা গেল, প্রাণীগুলো সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছে। এরপর যে প্রশ্নটা দেখা দিল, তা হলো প্রাণীটা সেখানে কী করে টিকল? তারও উত্তর পাওয়া গেল। পরিবেশের জন্যেই টিকে গেছে প্রাণীটি। কারণ সেসব দ্বীপে তাদের তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। খাবারের কোনো ঘাটতি পড়েনি। ডাইনোসরের সমকালীন এই প্রাণীটি এখনও কোমোডো দ্বীপে বেঁচে রয়েছে। সেখানে ইন্দোনেশিয়ার সরকার একটি জীববিজ্ঞান কেন্দ্র স্থাপন করে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা সেখানে বিচিত্র সেই প্রাণীটিকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের খাবারের জন্যে দেয়া হয় অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা খরগোশ।

১৮৫০ সালে দক্ষিণ আমেরিকার পাকা ও আকুচি। বিশ শতকের গোড়ার দিকের বড় আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে আফ্রিকার জায়াণ্ট হগ। ১৯১২ সালে পৃথিবীর বৃহত্তম স্থলচর গিরগিটি ইন্দোনেশিয়ার কোমোডো দ্বীপের ড্রাগন। চীনের ইয়াংসি কিয়াং নদীর শুশুক।

Share.

মন্তব্য করুন