সৃষ্টি থেকেই যত কিছুর উদ্ভব, যা কিছুই সুন্দর সবই চোখে পড়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলতে শেখার মধ্যেই। চোখ মেলেই যেমন মাকে চিনি একইসাথে পরিচিত হই আপনজনদের সাথে। তেমনি ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠার সময়ে নানারকমের পশু ও পাখিদের সাথে বন্ধুত্ব হয় খুব সহজেই। ভালোবাসার শুরু তখন থেকেই। একটি বাচ্চা যেমন কাঁদে তার খেলনা পুতুলের জন্য তেমনি সে কাঁদে তার প্রিয় পোষা কোনো প্রাণীর জন্যও।

হাসি আর আনন্দ, কান্না আর হারানোর ব্যথার মধ্যেই বড় হওয়ার এই সময়ে ঈদের আনন্দ আসে সবকিছু ছাড়িয়ে সব বাধা পেরিয়ে। ঈদের খুশি ঈদের আনন্দ হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ঈদ যখন হয় কুরবানির তখন এক নতুন মাত্রা যোগ হয় ভালোবাসায়। পশুর প্রতি ভালোবাসার এক অন্যরকম ছবির প্রেক্ষিত এসে যায়। নতুন পোশাকের আনন্দকে ছাড়িয়ে তখন প্রিয় হয়ে ওঠে নতুন রঙ নির্ধারণের। কে কোন রংয়ের গরু কিনবে এরই আমেজ এসে যায় মনে। নতুন রং নতুন স্বপ্ন নিয়ে হাজিরা দেয়। ছোট্ট মনে ঈদের দিনে প্রিয় পশুকে হারানোর কষ্ট ও ঈদ আনন্দ একসাথে খেলা করে।

একসাথে একমাঠে খেলার সাথীদের সাথে আনন্দ ভাগ করে নেয়াতে যে আনন্দ, যে উচ্ছ্বাস জাগে মনে তা আর কিছুতেই মেলে না। সেইসব খেলার সাথীদের মধ্যে যখন ঈদের খুশি দেখা যায় না, কষ্টের রঙ দানা বাঁধে, অপারগতায় বাধ্য হয়ে; সেই সময়েও ছোট ছোট কিশোর মন বন্ধুর খুশিতে হাসির অভিনয়ে অংশগ্রহণ করতে চায়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম এই প্রকৃতির সৌন্দর্য। এজন্যই আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘নিশ্চিতভাবেই এটি ছিল একটি প্রকাশ্য পরীক্ষা। একটি বড় কুরবানির বিনিময়ে আমি এই শিশুটিকে ছাড়িয়ে নিলাম এবং পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে চিরকালের জন্য তার প্রশংসা রেখে দিলাম। (সূরা আস-সাফ্ফাত : ১০৬-১০৮)
‘আর কুরবানির উটকে আমি করেছি তোমাদের জন্য আল্লাহর দিনর্শনগুলোর অন্তর্ভুক্ত; তোমাদের জন্য রয়েছে তার মধ্যে কল্যাণ।’ (সূরা আল-হজ : ৩৬)
সেই থেকে কুরবানির প্রচলন। সেই থেকে পশুদের প্রতি ভালোবাসার এক অন্যরকম নজরানা। ঈদের আনন্দের প্রথম ধাপ হলো কুরবানির জন্য সামর্থ্যরে মধ্যে পছন্দসই পশু কেনা। এর জন্য আয়োজন করে পশুর হাটে যাওয়া। সারি সারি গরু বাঁধা থাকে নানারং ও নানান সাইজের। আরো দেখা মেলে ছাগল, ভেড়া মহিষের। দেখলেই মনে খুশির ঝলক খেলে যায় অজান্তেই। সবচেয়ে যা সুন্দর তা হলো, কুরবানির জন্য নিজেদের পরম ভালোবাসায় লালন-পালন করে যে পশুটি হাটে আনা হলো- তার বিচ্ছেদে পশুর মালিকের চোখ থেকে যে বোবা অশ্রু ঝরে সেই দৃশ্য। এখন মনে হতেই পারে অশ্রু কি কখনও সুন্দর হতে পারে? আমি বলবো হ্যাঁ। খুব ভালোবাসার কিছু কাউকে দেয়া পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন কাজ। বিনিময়মূল্য যতই হোক তার। একজন বাবা যখন তাঁর প্রিয় কন্যাকে বিদায় জানায়, একইসাথে বেড়ে ওঠা ভাই-বোন যখন বিচ্ছিন্ন হয় তাদের চোখেও অশ্রু খেলা করে ভালোবাসায়। বিদায়ী অবস্থায় যেমন মেয়ের চোখে পানি বাবা-মার মনকে আন্দোলিত করে তেমনি ভালোবাসার অনুভব দেখা যায় বোবা প্রাণীদের চোখেও। চোখের কোল ঘেঁষে গড়িয়ে পড়া পানি প্রমাণ করে বোবা হয়েও তাদের অন্তরের অনুভব তার মালিকের প্রতি। এইত কুরবানির সার্থকতা।

যখন কুরবানির জন্য প্রাণীটি ঠিক হয়ে যায়, তখন মালিক পরিবর্তন হয়, কিন্তু ভালোবাসা শেষ হয় না। ভালোবাসা নতুন করে নতুন রূপে দেখা দেয়। নির্দিষ্ট দিনটি আসার আগ পর্যন্তই গরুকে খাওয়ানো, গোসল করানো তার দেখাশোনায় মনে এক উৎসবের পুলক অনুভব হয়। যেমন করে সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটি অতি যত্নে বেড়ে ওঠে তেমনি প্রাণের হয়ে ওঠে কুরবানির পশুটি। এইত আনন্দ এইত খুশি। এই খুশির সাথে যোগ হয় যারা কুরবানি দিতে পারে না তাদের ভালোবাসাও। তারাও কুরবানির পশুটির দেখাশোনা করে আপনমনেই। এভাবেই ঈদ হয়ে ওঠে সকলের।

ঈদের আগের সন্ধ্যাটি আসে আনন্দবার্তা নিয়ে, আসে চাঁদ ওঠার খবর নিয়ে। চারিদিক তখন আলোকোজ্জ্বল হয়, প্রতিটি ঘর পাড়া-মহল্লা ঈদের আমেজে মেতে ওঠে। শিশু-কিশোররা তাদের আনন্দ প্রকাশের জন্য নিয়ে আসে নানাধরনের আতশবাজি। মুহুর্মুহু শব্দে ধ্বনিত হতে থাকে ঈদের আগমনী বার্তা। ঈদের গান মনে আনে সুরের ঝংকার। এখনকার এই সময়ে সবাই হাতে তুলে নেয় সেলফোন। স্ট্যাটাসের মাধ্যমে ঈদ শুভেচ্ছা জানিয়ে দেয় সহজেই। পেছনের সোনালি দিনের কথা মনে পড়ে যায়, যেখানে অন্ধকার আকাশে তারাদের মেলায় চাঁদ দেখার আনন্দই ছিল ঈদের সেরা আনন্দ। তখনও আতশবাজি ছিল, ছিল শিশু-কিশোরদের আনন্দ মিছিল। সবার বাসায় পালাক্রমে যাওয়া নতুন কাপড় দেখা একইসাথে কুরবানির পশুকে হারিয়ে ফেলার কষ্টে তাকে আরো বেশি ভালোবাসাই ছিল ঈদ আনন্দ।

ঘুম ভেঙেই ঈদসকাল। একইসাথে আনন্দ ও বেদনায় মন ভরে ওঠে। তবুও যেতে হবে ঈদের নামাজে, বহুদিনের প্রতীক্ষিত একটি দিন, ঈদের দিন। যেখানে ঈদের মাঠে আয়োজন করে আদায় করা হয় ঈদ নামাজ। কচি-কাচা বাচ্চারাও অংশ নেয় আনন্দে। রাগ-অভিমান সব ভুলে কোলাকুলির মাধ্যমে আন্তরিকতার এক অভূতপূর্ব পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সেমাই, পিঠা আরো রকমারি আয়োজনে শুরু হয় ঈদের দিন।

ঈদের দিন আসে ভালোবাসার পরীক্ষা নিতে। কে পাস করবে কেইবা ফেল হবার তকমা লাগাবে গায়! কেউ কান্না করে, কেউবা মনের চোখের পানিতে পশুকে বিদায় জানায় কুরবানির জন্য। এসবই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য। গরুকে যখন মাটিতে শুইয়ে রশি দিয়ে বেঁধে কয়েকজন মিলে টেনে ধরে কুরবানির জন্য তখনকার কষ্টের কোনো ব্যাখ্যা হয় না। অথচ খুশি মনে আনন্দ নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানি সম্পন্ন করতে হয়। কী সুন্দর ইসলামের শিক্ষা! এ থেকে কত সহজেই আমরা জানতে পারি আল্লাহর রহমতের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাদের করণীয় কী? কিভাবে আমরা তা আদায় করবো। কিভাবে উন্নত জীবনের ধারক হবো। কুরবানির ঈদ শুধুই আনন্দ নিয়ে আসে না, আসে শিক্ষা নিয়ে, আসে মনে গভীরতা তৈরি করতে। আনন্দের যে কান্না লুকিয়ে থাকে তাকে দেখাতে আসে ঈদুল আজহা।

কুরবানির মাংস কাটাতেও অংশ নেয় সকলে। স্থানে স্থানে জমায়েতের মাধ্যমে নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শেষ হয় কুরবানির মাংস কাটার কাজ। বর্তমান সময়ে অবশ্য অনেক জায়গাতেই কসাই নিযুক্তের মাধ্যমে কুরবানির কাজ সম্পন্ন করা হয়। সবচেয়ে যা গুরুত্ব বহন করে তা হলো কুরবানির মাংসকে তিনভাগে ভাগ করে খুশিমন নিয়ে তা বণ্টন করা। এ কাজটি কুরবানির ঈদকে পরিপূর্ণতা দান করে। প্রতিবেশী সকলকে কুরবানির মাংস দেয়ার পাশাপাশি যাদের কুরবানি হয়নি তাদের ঘরে ঘরে মাংস পৌঁছে দেবার যে সুখানুভব যে পরিতৃপ্তি তা একমাত্র কুরবানিরই দান। এতে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বেড়ে যায় বহুগুণ।

কুরবানির পশুর মাংসসহ রকমারি খাবারে সজ্জিত টেবিলে সবাই একত্রিত হয়ে যখন খাবার মুখে দেয় তখন হদয়স্পর্শ করা এক অনুভূতি খেলা করে শিরা-উপশিরায়। আমরা সবসময়ই মাংস খেয়ে থাকি কিন্তু কুরবানির মাংসে থাকে ভালোবাসার পরশ। থাকে মাংস কাটার আনন্দ। থাকে সকলের সাথে ভাগ করে নেয়ার সুখ। সেদিন সর্বস্তরের মানুষের মুখে থাকে হাসির রেখা, যা কেবল কুরবানির ঈদে আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যমে অর্জিত হয়।
বিকেল হতেই ছেলে-মেয়েরা খেলায় মেতে ওঠে। অপেক্ষা করে সন্ধ্যার। আবারো সন্ধ্যারাতের আকাশে জ¦লে ওঠে আতশবাজির ঝিলিক। মুরুব্বিজনরা অপেক্ষা করে বৃষ্টির। বৃষ্টি এসে পশুর রক্ত মুছে দিয়ে যায় তার নিজস্ব নিয়মে। কত আয়োজন কত আবেগের একটি দিন রাতের সমাপ্তি হয় এভাবেই। আবারো একটি ¯িœগ্ধ ভোরের প্রতীক্ষায় রাত গভীর হতে থাকে।

Share.

মন্তব্য করুন