শতসহস্র হুতাশনের জ্বালা থেকে পরম শান্তির স্বাদ পেতে কলমের আশ্রয়ই একমাত্র ভরসা। কিছু মানুষ কখনোই টেনে উপরে তুলবে না। তবে জীবনভর চেষ্টা চালিয়ে যাবে নিকটতম স¦জনের সাফল্যকে কিভাবে টেনে হিঁচড়ে গর্তে ফেলে দেয়া যায়। এই আত্মরত মানুষগুলোর নিকট সময়ের মূল্য কখনোই বিবেচ্য বিষয় নয়। অন্যকে পরাজিত করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালানোতেই তাদের জয়।
এবার আসা যাক আমাদের প্রাসঙ্গিক মর্মকথায়।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে অভিজ্ঞতার সঞ্চয়ও বাড়ছে। তারপরও কিছু কূটবুদ্ধির লোককে কখনো যথোপযুক্ত উত্তর দেয়া যায় না। জীবনভর কথায় তাদের সঙ্গে হেরেই যেতে হয়। তর্কেও হারতে হয় এই জাতীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে।
তার মানে হেরে যাওয়া মানুষটি বোকা!
মোটেও তা নয়।
বুঝে নিতে হবে যে, বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে কেবল আত্মসম্মান রক্ষা করার ক্ষুদ্র প্রয়াস ছিলো হেরে যাওয়া ব্যক্তির মাঝে। এসকল ক্ষেত্রে কাজই আনন্দহীন হয়ে পড়ে। জীবনে এই নিরানন্দময়তা কখনোই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। কোনো কাজ যখন কাউকে জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয় তাতে মোটেও আনন্দ বলে কিছু থাকে না। সেটি কেবলই পেশাগত কারণে চালিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা।
যে কাজটি করবো বলে স্বপ্ন দেখা হয়, সেই কাজটি তখন পেশা না হয়ে নেশায় পরিণত হয়। এমন নেশার কাজগুলোই আমাদের সাফল্যের পথ বাতলে দেয়। সে কাজে যত সময়, ধৈর্য বা পরিশ্রমই যাক না কেনো, তাতে আনন্দ থাকে ঢের। সেই নেশার কাজগুলো অতৃপ্তির তিতকুটে স্বাদ থেকে আমাদের রাখে দূরত্ব সীমায়।
আনন্দ নিয়ে যারা কাজ করে তাদের ব্যর্থতার দোরগোড়ায় পৌঁছানোর কোনো সুযোগ নেই। একই পেশায় থেকে একেক জনের সফলতা একেক রকম। এর পেছনেও আনন্দের এক বিশাল ভূমিকা রয়েছে। অনেকে অনেক বড় বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার হয়েও বেকার জীবন যাপন করছে আবার অনেকে অতি সাধারণ বিষয়ে পড়াশোনা করেও সফলতার মুখ দেখছে অবিরত। এর পেছনেও আনন্দের দিকটির প্রাধান্য সর্বাধিক।

লিখতে বসে এই মুহূর্তে খুব মনে পড়ছে, অনেক ছেলে-মেয়েকে অতিরিক্ত হাসি-আনন্দের জন্য শিক্ষকদের শাস্তি ভোগ করতে দেখতাম। আবার এই ছেলেমেয়েগুলোই শিক্ষকদের খুব ¯েœহের ও কাছের মানুষ হিসেবে শিক্ষকদের ভক্তি শ্রদ্ধা করতো। আরেকদল ছেলে-মেয়ে দেখতাম অন্যের দুঃখে যেমন দুঃখী নয়, তেমনি কারো সুখেও সুখী নয়। অর্থাৎ তারা পৃথিবী দেখে সুখী নয়। এরা আবার কখনোই কারো ভালো বন্ধু অথবা শিক্ষকের ¯েœহভাজনও হতে পারেনি।
অনেকের কাছেই শুনি, তারা নাকি বছরে একদিনও আনন্দ-হাসির ফুরসত পায় না। শুনে অবাক হই। এখনো আনন্দ-হাসি বিহীন জীবন ভাবাই দুষ্কর। যার কারণে মনে হয় পৃথিবীর কোনো সৃজনশীল কাজই বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। এই টুকরো টুকরো আনন্দগুলোই আমাদেরকে প্রতিনিয়ত সজীব ও স্নিগ্ধ রাখে। সবক্ষেত্রে বয়সের কথা মনে রাখা ঠিক নয়। প্রতিটি সুন্দর মুহূর্তে নিজেকে সবার মাঝে বিলিয়ে দিতে পারাটাই হচ্ছে আনন্দের বড় মাধ্যম। এই আনন্দময়ী মানুষগুলোর সঙ্গ প্রত্যেকেরই কাম্য।
তবে সমাজে কিছু লোকতো থাকবেই, যারা নিজেরা আনন্দ উপভোগ করতে জানে না আর অপরের আনন্দে ছাই দিতেই ব্যস্ত।
তবে অন্যের দুঃসংবাদে এরা বড়ই নিয়মিত দর্শক-শ্রোতা। অন্যের দুঃখ দেখে নিজেদের সুখী ভাবতে এরা বড়ই উৎসাহী।

অপরের দুঃখ শুনে ওহ্ করে সবাই। কিন্তু সমাধান দেয়ার লোক এরা নয়। তবে অন্যের সুখ দেখে যারা সুখী হয় এবং তার আনন্দে একাত্মতা ঘোষণা করে তারাই প্রকৃত বড় মনের মানুষ।
অন্যদিকে হীন মন-মানসিকতার মানুষগুলো সারাক্ষণ অন্যের দুঃখ-কষ্ট খুঁজে বেড়ায়। এতে তারা খুব সুখ পায়। সময় মতো তারাও আবার অন্যদের থেকে একই ব্যবহার পায়। তাদের সুখে কেউ ভিড় করে না; তাদের দুঃখে সবাই মায়াকান্নায় মরে।
হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিটি তার হতাশার কারণ বা ঐ সময়গুলোকে যখন ভুলবার আপ্রাণ চেষ্টায় থাকে, ঠিক তখনই এই ধরনের নিরানন্দ মানুষগুলো তাদেরকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পুরনো জ্বলন্ত কষ্টগুলোর উপর পেট্রোল ঢেলে দেয়।
এর নাম সান্ত¡না নয়। এর প্রকৃত নাম দুষ্টুমি।
বহু জরিপে দেখা গেছে, যারা ছোট থেকে চাপের মধ্যে বড় হয় তারা উদারতা এবং আনন্দের বড়ই অভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে। সেজন্য তারা অন্যের দুঃখ-কষ্টের জ্বলন্ত আগুন না নিভিয়ে জিইয়ে রাখতে খুব বেশি পছন্দ করে। অযথা তারা অন্যের সঙ্গে যুক্তিহীনভাবে তর্কে জড়িয়ে পড়ে অহরহ। অন্যের সুখ-শান্তি তাদেরকে অতিরিক্ত পীড়াগ্রস্ত করে তোলে। হীনম্মন্যতায় ভোগে ভীষণ রকম। নিজেরাই নিজেদের ভেতর সহজ বিষয়গুলো জটিলতর করে তোলে। এরা কোথাও গিয়ে কাজ হাসিল করতে পারে না। অযথা অন্যকে সন্দেহ করে খুব বেশি। জটিলতার ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠার কারণে এরা কোনো বিষয়কেই ইতিবাচকভাবে গ্রহণ না করে প্রথমে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। আস্থা হারিয়ে ফেলে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির ওপর। তারা দাবি করে তারা খুব বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী। এই ধরনের সাংঘর্ষিক ব্যাপারগুলো তাদের জীবনে এক সাধারণ ও নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

এরা সাংসারিক জীবনেও পরের বাড়ির ছেলে কিংবা মেয়ের সঙ্গে সুমধুর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয় না। এমনকি তাদের কাছ থেকে নতুন প্রজন্ম হীনম্মন্যতার শিক্ষা পায় নিজেদের অজান্তেই।
তারা যেকোনো অনুষ্ঠান কিংবা মজলিসে গেলে ভালো জিনিসগুলোকে একদমই স্পর্শ করতে পারে না। সেখানকার সর্বনিকৃষ্ট বিষয়গুলো তাদের দৃষ্টি কাড়ে দারুণভাবে। যার কারণে তাদের কর্মজীবন ও পরিবারিক জীবনে সুশিক্ষার চেয়ে কুশিক্ষার দিকটিই বেশি ধরা দেয়।
এরা ভীষণ রকম পরশ্রীকাতর হয়ে থাকে। যার কারণে খুব কাছের মানুষেরা এদের থেকে বহুদূরে চলে যায়। এদের গল্পের বিষয়বস্তু অন্যকে বড় বেশি পীড়া দেয়। এই ধরনের মানুষগুলো সমাজকে, সংসারকে কখনোই আনন্দমুখর রাখতে পারে না।
পুঁথিগত বিদ্যা এদের পরীক্ষার খাতাতেই তালাবদ্ধ হয়ে যায়। জীবনে খুব ভালো ফলাফল ও এদের জীবনে দেখা যায় না।
পুঁথিগত বিদ্যা তখনই কাজে লাগবে যখন পরীক্ষার লেখায় লিপিবদ্ধ করার পর নিজ জীবনে তার প্রয়োগ করা হবে। সেটাই হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষা।
এরা মানসিকভাবে যেমন হীনম্মন্য, তেমনি কাজে-কামে অগোছালো। ঠিক তেমনি চলন বলনে মোটেও টিপটপ বা সুশ্রী থাকতে পছন্দ করে না।
এদের সঙ্গে যেকোনো মানুষের মতবিরোধ লেগেই থাকে।
এ ধরনের মানুষগুলোর সৃজনশীল ক্ষমতা নেই বললেই চলে। শুধু বোঝে নিজের স্বার্থ। কুক্ষিগত করে রাখে অন্যের সুখ-শান্তি আর আনন্দ। সময় জুড়ে চলে পরচর্চা।
অন্যের সংসারে আগুন জ্বালাতে পারলেই তাদের জীবন ধন্য। এসব পাপের প্রায়শ্চিত্ত সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক দ্রুত তাদের জীবনে এসে হাজির হয়।
নামাজ, রোজা আর তসবিহ পড়ে পড়ে অন্যের অশান্তি করলে এতে শান্তি হয় না। লোক দেখানো কাজ না করে মনটাকে পরিষ্কার করে চলাই আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
এই প্রকৃতির মানুষগুলো অন্যের ঘরে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে একদিন চেয়ে দেখে নিজের ঘর পুড়ে শেষ।
ন্যায়-অন্যায়ের মজলিসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা না বলা হলো সবচেয়ে বড় মুনাফেকি। এদের জীবনেও শান্তি আসে না।

সত্যের পথে থেকে বাঁচাই উত্তম।
কিছু লোকের মিথ্যা কথা বলাটা এক ধরনের রোগ বিশেষ। তারা খুবই বিনয়ী, কম কথা বলে, নামাজি, পরহেজগার। সব ঠিক আছে। কিন্তু তারা মিথ্যা ছাড়া তাদের জীবন বড় অর্থহীন মনে করে। ছোটবেলায় শুনেছি, জান বাঁচাতে আর মান বাঁচাতে নাকি মিথ্যা বলা যায়। তাও সঠিক কিনা বলতে পারবো না।
কিন্তু এক শ্রেণির মানুষ আছে বিনা প্রয়োজনে অহেতুক মিথ্যা বলেই যাচ্ছে। তারা স্বল্পভাষী হলেও মিথ্যাবাদী। বাচাল হলেও মিথ্যা বলছে। বহু চেষ্টা করেও এর সঠিক কারণটি বের করা বড়ই দুরূহ। যেমন: ধরা যাক, কখনো স্বামীর অতিরঞ্জিত প্রশংসা আবার পরক্ষণেই এই স্বামীর বিরুদ্ধে অহেতুক বদনাম। আর এদের মুখে সন্তানের রেজাল্ট দিয়ে মিথ্যার ঝড় বইয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে দেখা যায় সব পরীক্ষাগুলো এদের সন্তানদের ডবল ডবল দিতে হয় নতুবা ছোট ফলাফল ঘরে আনতে হয়।

আবার অনেককে দেখা যাচ্ছে চলন্ত গাড়িতে বসে মোবাইলে অপরপ্রান্তের কাউকে বলছে, আরে আমি তো পরিবারের সঙ্গে চাইনিজ খেতে এসেছি। আরে বোঝেন না, এখানে অনেক লোক খেতে এসেছে তো তাই এত হৈ চৈ।
বেশ কয়েক বছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল, আমাকে একজন মেসেঞ্জার থেকে ফোন দিয়ে বলছে তোমার কথা হঠাৎ করে খুব মনে পড়লো তাই তোমাকে ফোন দিলাম! আমি দুবাই এসেছি বেড়াতে। এইটুকুন বলার সঙ্গে সঙ্গেই আযান পড়লো। আমি বললাম, এই বাংলাদেশ টাইম দুপুর ১টায় তোমাদের ওখানে কোন নামাজের আজান দিলো? ওখানের সঙ্গে তো আমাদের দুই ঘণ্টা টাইম ডিফারেন্স। এখন তো দুবাই কোনো নামাজের আজান দেয়ার কথাই নয়। এই বলার সঙ্গে সঙ্গে হ্যালো হ্যালো করে শুনতে পাচ্ছি না বলে লাইনটি কেটে দিলো। তাতেও বেশ কিছুক্ষণ হেসে আনন্দ পেলাম।
এই মিথ্যে বলাটা তাদের এক প্রকার মানসিক রোগ।
এই পৃথিবীতে কত রকমের মানসিক রোগী যে রয়েছে! আমার এক স্কুল বন্ধু বলতো, দোস্ত পৃথিবীতে যদি এত ভ্যারাইটিস আইটেমের মানুষ না থাকতো, তাহলে কাকে নিয়ে আমরা এত হেসে আনন্দ পেতাম।
সত্যি তাই!
সর্বোপরি বলতে চাই, “অসৎ আনন্দের চেয়ে সৎ দুঃখ অনেক শ্রেয়”।

Share.

মন্তব্য করুন