আমার শুধু ঘুরতে ইচ্ছা করে! বিশেষ করে অনুচ্চ ঘাস আবৃত সুউচ্চ পাহাড়, ফেনিল ঢেউয়ের অতি উচ্চ গর্জন আর কুচকুচে আঁধার আকাশে সর্বোচ্চ সংখ্যক চকচকে তারা-তিনটিই আমার মন ভালো হওয়ার রেসিপি। ইংল্যান্ডের ব্রাইটনে থাকতে সুযোগ পেলেই প্রথম দুটোর খোঁজে ঘরছাড়া হতাম।
ব্রাইটনের যে স্থানটি পর্যটকদের মূল আকর্ষণ, তার নাম ‘সেভেন সিস্টার্স’ বা ‘সাত বোন’! শৈশবে রূপকথার বইয়ে পড়েছি ‘সাত ভাই চম্পা’, কৈশোরে দেখেছি সেটির চলচ্চিত্র আর তরুণ বয়সে জেনেছি ‘সেভেন সিস্টার্স স্টেটস’ বা ‘সাত বোন রাজ্য’ বলতে বোঝায় উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য অর্থাৎ আসাম, অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মণিপুর, মিজোরাম ও নাগাল্যান্ড। কিন্তু ব্রাইটনে সাসেক্স ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সহপাঠীদের কাছে আরও এক সেভেন সিস্টার্স-এর গল্প শুনলাম। একদিন মৌবীণাকে নিয়ে পূর্ব সাসেক্সের সেই সেভেন সিস্টার্সে ঘুরতে গেলাম। যেন আমার মন ভালো করার রেসিপি অনুযায়ী গড়ে উঠেছে এলাকাটি! ঘাস আবৃত সুবিস্তৃত ঢেউখেলানো ভূমিরূপ, তাতে বিভিন্ন স্থানে দলবেঁধে চরে বেড়াচ্ছে লোমশ ভেড়ার দল, মাঠের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে রুপালি পানির নদী, সেই নদীতে পর্যটকদের কেউ কেউ করছেন কায়াকিং! রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ায় মেঘের ছায়া পড়েছে মাঠ ও নদীর এখানে-ওখানে।
মাঠের মধ্য দিয়ে হাঁটতে থাকলাম। যতই হাঁটতে থাকি, ততই সৌন্দর্য বাড়তে থাকে। ঢেউখেলানো মাঠ একপাশে ধীরে ধীরে উঠে গেছে অনেক উঁচুতে। কেউবা সেই পথ ধরে হেঁটে চলেছেন ওপর থেকে ভিন্ন আঙ্গিকে দৃশ্যপট উপভোগের জন্য। আমরা সমতল তৃণভূমি দিয়ে হেঁটে চললাম। প্রায় আধঘণ্টা হাঁটার পর শেষপ্রান্তে পৌঁছে মন আরও ভালো হয়ে গেল। বুনো ঢেউয়ের গর্জন; তার পাশেই সাদা চকপাথরের উঁচু পাহাড়। পরপর সাতটি খাড়া চকপাহাড়ের নামই সেভেন সিস্টার্স বা সাত বোন। দেখতে পেলাম, ইংলিশ চ্যানেলের প্রবল ঢেউ আছড়ে পড়ছে সেভেন সিস্টার্সের গায়ে। পরবর্তীতে আরও কয়েকবার সেভেন সিস্টার্সে গেছি। অতি প্রকাণ্ড এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে খুঁজে পেয়েছি পর্যটকদের জন্য নির্মিত আরেকটি হাঁটাপথ। পথটি সহজ ও নান্দনিক হলেও মাঠের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাওয়াই বেশি উপভোগ্য।
দর্শনীয় এলাকাটিতে আমাদের গোছানো ট্যুর ছিল পড়াশোনার শেষদিকে। সৌভাগ্যবশত সেসময়ে আমার বাবা-মা (আমি ডাকি আব্বু-মামণি) ছিলেন ব্রাইটনে আমাদের বাসায়। একদিন বুয়েটের সিনিয়র আরিফুর রহমান ভাই গাড়ি নিয়ে এলেন। মামণি রান্না করলেন ল্যাম্ব বিরিয়ানি; সঙ্গে নেওয়া হলো চানাচুর, চিপস ও কোক। পিকনিকের আমেজে আমরা বের হলাম। আরিফ ভাই প্রথমে নিয়ে গেলেন বিচি হেড (ইবধপযু ঐবধফ)-এ। বিচি হেড মূলত সেভেন সিস্টার্সের পূর্বে অবস্থিত ব্রিটেনের চকপাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়া। সেই চূড়া থেকে নিচে তাকিয়ে আমার বেশ ভয়ই লাগছিল। তবে ওপর থেকে প্রকৃতি অসম্ভব সুন্দর! নিচে তাকালে দেখা যায়, ফেনিল ঢেউ আছড়ে পড়ছে সাদা পাহাড়ের পাদদেশে। এছাড়াও চোখে পড়ে একটি লাইটহাউজ। জাহাজকে সতর্ক করার জন্য সেটি স্থাপিত।

সৌন্দর্য উপভোগ শেষে বিচি হেড লেখা নামফলকের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা ছবি তুললাম। সবার হাতে ছিল আমার লেখা বই। আব্বু-মামণি সুদূর আমেরিকা থেকে বইগুলো বয়ে এনেছেন। অভ্যাসবশত সেখানকার কয়েকটি তথ্যফলক পড়ে দেখলাম। সবচেয়ে মজার যে তথ্যটি জানতে পারলাম, তা হলো-এই চকপাহাড়ের গঠনপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগে, যখন স্থলভাগে চষে বেড়াত ডাইনোসর! কয়েকটি স্মৃতিফলকও আছে সেখানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রয়েল এয়ার ফোর্স বোম্বার কমান্ড-এর এক লক্ষ দশ হাজার সৈন্যের স্মৃতির উদ্দেশে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে ব্রিটেনের সর্বোচ্চ এই চূড়ায়। রয়েল এয়ার ফোর্স বোম্বার কমান্ড-এর অধিকাংশ সৈন্যের চোখে তাদের প্রিয় মাতৃভূমি ইংল্যান্ডের শেষ দৃশ্য ছিল বিচি হেড! এই কষ্টের ইতিহাসের পাশাপাশি নৈসর্গিক স্থানটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসুন্দর একটি সত্য। বিচি হেড পৃথিবীর অন্যতম সুইসাইড স্পট হিসেবে বিবেচিত। প্রতি বছর কমপক্ষে বিশ জন মানুষ এই স্থানে এসে আত্মহত্যা করেন! হয়তো জীবনের অব্যক্ত গ্লানি সহ্য করতে না পেরে শেষ শ্বাসটি তারা নিতে চান অপার্থিব সৌন্দর্যের মাঝে।

বিচি হেডের পর আমাদের গন্তব্য বার্লিং গ্যাপ। এটি মূলত সেভেন সিস্টার্সের শেষাংশে অবস্থিত। স্থানটিতে কোস্টগার্ডদের থাকার জন্য রয়েছে কুটির, যেগুলো ১৮৭৮ সালে নির্মিত! পর্যটকদের জন্য রয়েছে কফিশপ ও নানা স্যুভিনির শপ। বার্লিং গ্যাপ-এ একটি ধাতুনির্মিত সিঁড়ি আছে, যেটি দিয়ে চকপাহাড়ের চূড়া থেকে নিচের পাথুরে সৈকতে নামা যায় এবং হেঁটে সেভেন সিস্টার্সের দিকে যাওয়া যায়। আমরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে কিছুক্ষণ পাথুরে সৈকতে কাটালাম। স্রােত এখানেও প্রবল কিন্তু তার গর্জন ভীতি ছড়ায় না; বরং ভালোলাগার আবেশে মন ভরিয়ে দেয়।

বার্লিং গ্যাপ থেকে পাথুরে সৈকত ধরে না এগিয়ে ধাতব সিঁড়ি দিয়ে আমরা আবার ওপরে উঠে এলাম। তারপর সেভেন সিস্টার্সে যাওয়ার জন্য মূল সড়কের পথ ধরলাম। সেভেন সিস্টার্সের যে মাঠে মৌবীণা ও আমি আগেও কয়েকবার এসেছি, সেখানেই তার প্রধান ফটক। ফটকের সামনে দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেলে মূল সড়ক। ফটক বরাবর সড়কের ওপাশে গাড়ি রাখার স্থান, ফুডশপ, স্যুভিনির শপ, ছায়া সুবিনিড় জায়গা। গাছের ছায়ায় আমরা বনভোজন সারলাম। বিরিয়ানি ও কোক আমার প্রিয় মেন্যু। আর মামণির হাতের রান্না শুধু আমার পেট ভরায় না; আত্মাও জুড়ায়। সঙ্গে প্রিয় মানুষরা থাকায় কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেলাম দেশের বাইরে আছি।
বনভোজন শেষে রাস্তা পার হয়ে প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকলাম। হাঁটা ধরলাম সেভেন সিস্টার্সের পথে। এবার আর মাঠের মাঝ দিয়ে নয়; পরিসীমার হাঁটাপথ ধরে হেঁটে চললাম। হাঁটাপথের পাশে মাটির ঢিবি করে তাতে নানা ফুলগাছ লাগানো। আমাদের নজর কাড়ল মাটির ঢিবিতে থাকা বড় বড় গর্ত! সেখানে কী বাস করে, জানা যায়নি। ঘাস আবৃত মাঠের মাঝে নদীকে আরও সুন্দর লাগছিল সেদিন। যখন সৈকতে পৌঁছলাম, সবার ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। পাথুরে সৈকতে সাবধানে এগোলাম। একটি চকপাহাড়ের পাদদেশে আমরা কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। অদূরে একটার পর একটা অতিকায় ঢেউ আছড়ে পড়ছে সাদা পাহাড়ের গায়ে। এপাশ থেকে সেভেন সিস্টার্সের দৃশ্য দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে, আগে কোথাও দেখেছি! কারণ, মাইক্রোসফট উইন্ডোজ সেভেন যারা ব্যবহার করেছেন, তারা সেভেন সিস্টার্সের ছবি ডিফল্ট ওয়ালপেপার হিসেবে পেয়েছেন।

শুটিংয়ের সুবিধার্থে সেভেন সিস্টার্সের হোয়াইট ক্লিফগুলো প্রায়ই টেলিভিশন প্রোডাকশনে বা চলচ্চিত্রে দেখানো হয় ডোভার-এর হোয়াইট ক্লিফ হিসেবে! ডোভারের হোয়াইট ক্লিফের ঐতিহাসিক ও আঞ্চলিক গুরুত্ব অসীম। ডোভারের চকপাহাড়ের চূড়াগুলো ব্রিটেনের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে প্রাকৃতিক অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে। এই হোয়াইট ক্লিফগুলো জুলিয়াস সিজার হতে শুরু করে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর আগ্রাসন থেকে ব্রিটেনকে আগলে রেখেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধে যাওয়া অধিকাংশ ব্রিটিশ সৈনিকের চোখে শেষ দৃশ্য ছিল ডোভারের হোয়াইট ক্লিফ; এমনকি যুদ্ধফেরত সেনাদের চোখে মাতৃভূমির প্রথম দৃশ্য ছিল এটি। এসব কারণে এই ক্লিফের সঙ্গে ব্রিটিশদের আবেগ জড়িত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভেরা লিন-এর ‘দ্য হোয়াইট ক্লিফস অব ডোভার’ গানটি ছিল ব্রিটিশদের মনোবল চাঙ্গা রাখার রেসিপি।

আমাদের বনভোজনের দিনটি ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল এবং আবহাওয়া ছিল ভালো। তাই পেছনে সুউচ্চ চকপাহাড়ের সারি এবং গর্জনশীল ঢেউমালা সামনে রেখে বিশ্রাম নিতে ভালো লাগছিল। পরিশেষে কিছু মধুর স্মৃতি নিয়ে ফিরলাম ইউনিভার্সিটিতে আমাদের ফ্যামিলি ফ্ল্যাটে। ফেরার পথে ব্রাইটন মেরিনা ও ব্রাইটন পিয়ার-এ কিছুটা সময় কাটালাম। ব্রাইটন পিয়ার আর মেরিনা নিয়েও নানা স্মৃতি আছে। সেগুলো আলাদা লেখায় লিখতে চাই। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে এটি ধ্রুব সত্য যে এসব স্থানে এভাবে আর কখনো বেড়াতে যাওয়া হবে না; তবে বয়ে বেড়ানো আনন্দময় স্মৃতি প্রকাশ করতে পেরেছি-এটিও কম আনন্দের নয়।

Share.

মন্তব্য করুন