কয়েক হাজার বছর পূর্বে রাজা হুন ভুং ভিয়েতনামের শাসক ছিলেন। তার মহৎ ও উদার শাসনব্যবস্থার ফলে প্রজারা তাকে খুব ভালোবাসত। তার শাসনামলে রাজ্যের সকলে সুখে শান্তিতে বসবাস করছিল। তবে এত সুখের মাঝেও রাজার মনে ছিল খুব দুঃখ। কেননা রাজার কোন পুত্র সন্তান ছিল না। তার ছিল একটিমাত্র মেয়ে। বৃদ্ধ বয়সে রাজ্যের শাসনভার হস্তান্তর করার জন্য তার একজন পুত্র সন্তানের প্রয়োজন ছিল। তাই তিনি একটি পুত্র সন্তান দত্তক নেয়ার পরিকল্পনা করলেন। রাজ্যের দূরবর্তী দ্বীপে বসবাসরত এক গরীব পরিবার থেকে তিনি একটি পুত্র সন্তান দত্তক নিলেন। ছেলেটির নাম রাখা হলো এন তীম। রাজা তীমকে ভালোবাসা, আদর ও স্নেহ দিয়ে নিজের সন্তানের মত বড় করে তুললেন। তীম ছিল খুবই বুদ্ধিমান এবং একজন দক্ষ যোদ্ধা। ফলে রাজা এবং রাজ্যের সকলের কাছে সে দ্রুতই খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠল।

একদিন রাজা নিজের কন্যার সাথে তীমের বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তীমের বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে রাজকুমারী এই বিয়েতে মত দিল। প্রচুর ধুমধাম এবং জাঁকজমকের সাথে তাদের বিয়ে হল। বিয়ের পর রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দর প্রাসাদে তারা সুখে ও শান্তিতে বসবাস করতে লাগল। তাদের ঘরে দুটি সন্তানের জন্ম হল। ফলে তাদের প্রতি রাজার ভালোবাসা আগের চেয়ে আরো বহুগুণে বেড়ে গেল।
তীমের প্রতি রাজার এত দয়ামায়া দেখে রাজ্যের কিছু মানুষের মনে হিংসা জন্মাতে শুরু করল। ধীরে ধীরে এই হিংসা ঘৃণায় রূপ নিল। তারা তীমকে একেবারেই সহ্য করতে পারত না। তাই তাকে কিভাবে রাজ্য থেকে সরিয়ে দেয়া যায় এবং রাজার মৃত্যুর পর কি করে ক্ষমতা দখল করা যায় এ নিয়ে তারা ষড়যন্ত্র আরম্ভ করল। তীমকে রাজার চোখে খারাপ বানানোর জন্য তারা বানিয়ে বানিয়ে বিভিন্ন গল্প বলতে লাগল। একদিন রাজ্যের সবার মাঝে একটি গল্প ছড়িয়ে পড়লো যে তীম রাজাকে হত্যা করে রাজ্যের ক্ষমতা দখল করার জন্য ষড়যন্ত্র করছে। রাতারাতি এই ঘটনা রাজার কানে পৌঁছে গেল। রাজা খুব রেগে গেলেন। নিজের রাজ্যকে বাঁচানোর জন্য শাস্তি হিসেবে রাজা তার কন্যা এবং তীমকে তাদের সন্তানসহ অচেনা ও দূরবর্তী এক নির্জন দ্বীপে নির্বাসনে পাঠালেন।

নির্বাসিত হওয়ার ফলে এন তীম ও রাজকুমারীর জীবনে সবচেয়ে কঠিন সময় নেমে এল। আরাম-আয়েশ এবং বিলাসিতার জীবন ত্যাগ করে নির্জন দ্বীপে তারা দুজন টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দিনরাত পরিশ্রম করে দুজনে মিলে ছোট্ট একটি কুড়েঘর তৈরি করল। সন্তানদেরকে নিয়ে সেখানে তারা আশ্রয় গ্রহণ করল। জঙ্গলের বিভিন্ন জীবজন্তু শিকার করে তারা খাদ্যের চাহিদা পূরণ করল। পাশাপাশি দ্বীপের চারপাশে নিয়মিত মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে লাগল। সন্তানদেরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাদের কঠোর পরিশ্রম চলল।
একদিন সকালে তীম শিকারের উদ্দেশ্যে জঙ্গলের পথে হাঁটছিল। তখন হঠাৎ লক্ষ্য করল একদল পাখি জঙ্গলের ভিতরে কি যেন ঠুকরে খাচ্ছে। কাছে যাওয়ার পর কালো রঙের অদ্ভুত এক ধরনের ছোট ছোট বীজ দেখতে পেল। কৌতুহলী হয়ে তীম সেখান থেকে কিছু বীজ হাতে করে বাড়িতে নিয়ে এল। তারপর ভাবল এগুলোকে রোপণ করলে হয়ত ভালো কোন গাছের চারা গজাতে পারে যা তাদের পরিবারের উপকারে আসতে পারে। এই ভেবে সে বীজগুলোকে তাদের কুঁড়েঘরের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিল।

সেই সাথে তীম ও তার স্ত্রী নিয়মিত বীজগুলোর পরিচর্যা করছিল। দেখতে দেখতে প্রায় কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। এরপর দেখা গেল বীজগুলো থেকে ছোট ছোট অঙ্কুর বের হচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যেই সবগুলো বীজ থেকে অঙ্কুর বের হল। ধীরে ধীরে গজাল পাতা। তারপর ছোট এক ধরনের গাছে পরিণত হল। আর গাছ থেকে কিছুদিন পর বের হল ফল। ছোট ফলগুলো ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। বড় হতে হতে এটি একটি মানুষের মাথার আকারের থেকেও বড় হয়ে উঠল। ফলটির শরীর খুবই মসৃণ এবং মনোরম সুগন্ধিযুক্ত। এটি কাটার পর দেখা গেল এর ভিতরে লাল রঙের শাঁসযুক্ত সুমিষ্ট কিছু রয়েছে যা খেতে খুবই সুস্বাদু। তীম এর নাম রাখলো ‘ডিউয়ো ডো’। ক্রমেই এর সুগন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে গেল। ফলে সেখানে প্রচুর পাখির আগমন ঘটল। পাখিরা দল বেধে সেখানে এসে সুমিষ্ট ফলটি খেত। আর তাদের খাওয়ার সময় সৃষ্টি হত এক ধরনের করুণ সুরের মত শব্দ। এমন অদ্ভুত দৃশ্য দেখে রাজকুমারীর মনে হত পাখিরা যেন কাঁদছে। তারপর থেকে এর নাম রাখা হলো ‘ডিউয়ো তাই’, বাংলায় যাকে বলা হয় তরমুজ। এরপর থেকে ফলটিকে এই নামেই ডাকা হয়।

তীম ও তার স্ত্রী নিজেদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে তরমুজ সংরক্ষণ করে রাখল। তরমুজ খাওয়ার পর তারা বীজগুলোকে ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করল। মাসের পর মাস যায়। বছরের পর বছর আসে। ইতিমধ্যে তারা প্রচুর পরিমাণে চাষ করে তরমুজ দিয়ে দ্বীপটিকে ভরে ফেলল। নিজেদের চাহিদা পূরণ করে বাড়তি তরমুজগুলো দ্বীপের পাশ দিয়ে যাওয়া জাহাজের নাবিকদের কাছে বিক্রয় করতে লাগল। এগুলো বিক্রয় করে তারা খাবার, কাপড়-চোপড়, বাচ্চাদের খেলনা এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনল।
এদিকে রাজপ্রাসাদের ভিতরে রাজা ভীষণ একা হয়ে গেলেন। ইদানীং রাজকুমারী এবং তীমের কথা তার খুব মনে পড়ে। তাদের সন্তানদের কথা ভেবেও রাজার খুব মন খারাপ হতে শুরু করল। তারা কোথায় আছে, কেমন আছে কিছুই তিনি জানেন না। এমনকি তারা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তাও তিনি জানেন না। ফলে কষ্টের প্রহর শুধু বেড়েই চলছিল।

তীম একদিন দ্বীপের পাশের সমুদ্র তীরে অনেকক্ষণ বসেছিল। সেখানে বসে একপর্যায়ে নিজের জীবনে ঘটা নাটকীয় পরিবর্তনগুলো নিয়ে ভাবতে লাগল। অনেক দূরে অবস্থিত রাজপ্রাসাদটি তখনও সেখান থেকে দেখা যাচ্ছিল। তীম রাজপ্রাসাদের জীবনের স্মৃতিগুলো কল্পনা করতে লাগল। অতীতের সুখী দিনগুলোর কথা তার মনে পড়ে গেল। আর মনে মনে ভাবল নিয়তি কতইনা অদ্ভুত। এটি কখন মানুষকে কোথায় নিয়ে যায় এবং কোন পরিণতিতে ফেলে তা বোঝা বড়ই মুশকিল। তার পরিবারের সাথে যা ঘটে গেছে তা যেন নিয়তিরই খেলা। তবে তার মনে এ নিয়ে কোন দুঃখ নেই। প্রচন্ড লড়াই ও সংগ্রামের মাধ্যমে সে এখনও টিকে থাকতে পেরেছে। এসব ভাবতে ভাবতে সে এক পর্যায়ে একটি তরমুজ হাতে নিল। তরমুজটির গায়ে নিজের নাম খোদাই করে লিখল। এরপর সে এটিকে পানিতে ভাসিয়ে দিল। আর ভাবল সমুদ্রের ঢেউ এটাকে নিশ্চয়ই এমন কোন এক জায়গায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ঠিক যেভাবে নিয়তি তার জীবনকে সময়ের স্রোতে ভাসিয়ে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তরমুজটি সমুদ্রের তীব্র স্রোতে ভাসতে থাকল। ভাসতে ভাসতে এক পর্যায়ে এটি সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

নিয়তির নির্মম পরিহাসে সমুদ্রের তীব্র স্রোত এটিকে ভাসিয়ে রাজা ভুন হুংয়ের রাজ্যে নিয়ে গেল। রাজ্যের সমুদ্রতীরে প্রহরীরা খোদাই করা এমন অদ্ভুত একটি জিনিস দেখে অবাক হল এবং এটিকে রাজার কাছে নিয়ে গেল। রাজা এটি হাতে নিয়ে দেখলেন এর মধ্যে এন তীমের নাম লেখা রয়েছে। তিনি বুঝতে পারলেন তারা এখনো বেঁচে আছে। তার চোখে-মুখে হাসির ছাপ ফুটে উঠল। পাশাপাশি তীমের বুদ্ধিমত্তা রাজাকে মুগ্ধ করল। তীম ও রাজকুমারীর দুর্গম ও নির্জন পরিবেশে লড়াই করে বেঁচে থাকার শক্তি দেখে রাজা খুব গর্বিত বোধ করলেন। সাথে সাথে রাজকুমারী ও এন তীমকে তাদের সন্তানসহ যেখান থেকেই হোক খুঁজে আনার জন্য প্রহরীদেরকে নির্দেশ দিলেন।

প্রহরীরা তাদেরকে রাজ্যের আশেপাশের দূর্গম দ্বীপগুলোতে দিনরাত খোঁজাখুঁজি করতে লাগল। কয়েকদিন খোঁজার পর অবশেষে তাদের সন্ধান পাওয়া গেল। প্রহরীরা তাদেরকে রাজপ্রাসাদে এনে রাজার সামনে হাজির করল। দীর্ঘদিন পর সন্তান এবং নাতি-নাতনিদের দেখে রাজার মন খুশিতে ভরে উঠল। তারা রাজার জন্য উপহারস্বরূপ প্রচুর পরিমাণে তরমুজ সাথে করে নিয়ে এসেছে। তরমুজ চাষ এবং এর নামকরণ করার ঘটনা তীম সংক্ষেপে রাজাকে জানাল। সেই সাথে বর্ণনা করল নির্জন দ্বীপে লড়াই করে টিকে থাকার সংগ্রামী ইতিহাস। এসব শুনে রাজা প্রচন্ড খুশি হলেন এবং গর্ববোধ করলেন। তীমের রাজ্য চালানোর ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি অনুধাবন করতে পারলেন। তিনি বুঝতে পারলেন তীম রাজ্য পরিচালনায় তার থেকেও অধিক মেধা ও যোগ্যতার অধিকারী। তাই বৃদ্ধ রাজা সকলের সামনে এন তীমের মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দিলেন। তীমকে রাজ্য পরিচালনার সকল দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে রাজা স্বেচ্ছায় ক্ষমতা থেকে অবসর গ্রহণ করলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তীম বুদ্ধিমত্তার সাথে তার রাজ্য শাসন করেছিল।

Share.

মন্তব্য করুন