“Time and Tide wait for none”.
‘সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।’
এই বাক্যটি প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রী ছাত্রজীবনের শুরুতেই অত্যন্ত নিষ্ঠায় জীবনের সাথে মেখে নেয়, মুখস্থ করে। ছোটবেলায় এই জাদু মিশ্রিত লাইন দুটো পড়তে পড়তে কতদিন যে দেখেছি- চোখের সামনে নদীর নীল অবারিত স্রোতধারা বয়ে গেছে বিরামহীন! আর সেখানে, সেই পাড়ে তন্ময় হয়ে নির্বাক হয়ে বসে থেকেছি এই আমি। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখেছি, সে অবিরাম বয়েই যায়, বয়েই যায়, আমার দিকে ফিরেও তাকায় না, ফুরসত নেই তার। আমার মনে হয়, আমার মতো প্রতিটি শিশু শিক্ষার্থীর চোখের সামনে এই চিত্রকল্পটিই ভেসে বেড়িয়েছে দীর্ঘদিন। তারা তন্ময় হয়ে নদীর অনন্ত স্রোতের সাথে নিজের চলার পথকে মিশিয়ে দিয়েছে কল্পনায়। সেই কল্পনাশক্তির বুনিয়াদে তারাও হাঁটতে শিখেছে অনন্ত, একা একা। কারো দিকে ফিরে তাকাবার কিংবা কারো জন্য অপেক্ষা করবার ফুরসত নেই তারও। যারাই এই মূলমন্ত্রের সাথে নিজেকে মেশাতে পেরেছে, তারাই ছুটতে শিখেছে, বয়ে চলতে শিখেছে নদীর স্রোতের মতো বিরামহীন!

‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের পাঁচ ফোঁড়’- এ কথাটি যারা আজীবন মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, এবং নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেন, তাঁরই জীবনে সফলতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে যান, পৌঁছে যান সর্বক্ষেত্রে। সম্প্রতি একটি নিবন্ধ আমার মন ছুঁয়েছিলো। তাতে একটি গল্প ছিলো। এক বনে দুই ব্যাঙ ছিলো। তারা দুজনই খুব দুষ্টু ছিলো। তবে তাদের মধ্যে একটি ছিলো একটু শান্ত আর বুদ্ধিদীপ্ত। খুব ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে সিদ্ধহস্ত। অপরটি ছিল একটু উচ্ছল প্রকৃতির তবে অলস। একদিন শীতকালে কোনক্রমে হঠাৎ লাফিয়ে ব্যাঙ দুটি একটি গরম, ফুটন্ত পানির পাত্রে পড়ে যায়। শীতের মধ্যে প্রথমে গরম পানিতে তারা আরাম অনুভব করে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে গরম অনুভূতি বাড়তে থাকায় তারা সেখান থেকে উদ্ধারের চেষ্টা করতে থাকে। বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাঙটি যে কোনভাবেই গরম পানি থেকে উদ্ধার পেতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু অলস ব্যাঙটি চেষ্টা করে, তবে আবার যে লাফিয়ে পড়তে হবে, সেটা ভাবে না। বরং সঙ্গীটিকে নিষেধ করে, অত লাফালাফি ভালো নয়, গরমে থাক, আরামে থাক। সে বুঝতে চায় না, সময়ের সাথে সাথে এই গরম যে তার জন্য অসহনীয় হয়ে উঠছে, উঠবে। কিন্তু অন্য ব্যাঙটি যেভাবে হঠাৎ লাফিয়ে গরম পানিতে পড়েছিলো ঠিক সেই একই ভাবে পানি অসহনীয় গরম হয়ে উঠবার আগেই তা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে পরিত্রাণ পায়। তারপর একটু শান্ত হয়ে সঙ্গী ব্যাঙটিকে খুঁজলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সে গরম পানিতে সিদ্ধ হয়ে পানির সাথে মিশে গেছে। শত চেষ্টাতেও তার দ্রবীভূত তারল্য শরীর গরম পানি থেকে আলাদা করতে পারে না।

এই ঘটনা থেকে সম্প্রতি আমার ভাবনাগুলো খুব বড় ধরনের এলোমেলো হয়েছিলো। আমিও লাফিয়ে পড়েছিলাম গরম জলের প্রাথমিক আরাম এবং শেষ পর্যন্ত নিজের গলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসাবে। আমি জানি, শুধু আমি নই, যারাই যাপিত জীবনের প্রয়োজনে হিজরত করতে পারেন, বা লাফিয়ে পড়তে পারেন, তারাই তাদের সামনের ঘটনাবহুল জীবনের সাথে অতীতের ঘটনাবহুল জীবনের মধ্যে একটি সাযুজ্য তৈরি করতে পারেন। কখন লাফিয়ে পড়তে হবে, আর কখন আরাম আয়েশে বসে, শুয়ে গরম পানির সুখ অনুভব করতে হবে, সেই সামঞ্জস্যতা প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব। তবে হ্যাঁ, কোনো কোনো ব্যাপারে যদি আমরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে না পারি- সেক্ষেত্রে আমাদের অভিভাবক, পরিবার, সমাজের সহায়তা, সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া উচিত। সেই সব (নিজের নেয়া অথবা অন্যের দেয়া) সিদ্ধান্ত মোতাবেক যদি আমরা আমাদের প্রতিটি মুহূর্তকে নদীর স্রোতের মতো বিরামহীন কাজে লাগাতে পারি, তো আমরাও সফলকাম হতে পারি শতভাগ। এটা আমাদের প্রত্যেকেরই জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে হয় সারাক্ষণ।

আবার এটাও ভাবতে হয়, এক জীবনে সময়টা শুধু নিজের নয়। সময়কে ভাগ করতে হয় সবার জন্য চুলচেরা। নিজের জীবনের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব বাদ দিলেও আমাদের পরিবার, পরিজন. আত্মীয় স্বজন, সমাজ, রাষ্ট্র, দেশ, ইহকাল, পরকাল সর্বোপরি মৃত্যুর জন্যও তৈরি থাকতে হয় সর্বক্ষণ। কারণ আমরা জানিই তো, জীবনের মতো মৃত্যুও আমাদের একটিই। একবার চলে গেলে দ্বিতীয়বার তাকে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। যিনি যে অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন, তিনি সেই অবস্থার ফায়সালা অনন্ত মৃত্যুপরবর্তী জীবনে উপভোগ করেন। তাই আমাদের উচিত সারাক্ষণই জীবনের মতো মৃত্যুর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকা। আমরা তো জানি না, কখন মৃত্যু নামের খড়গ কিংবা ফুলমাল্য আমাদের ওপর নেমে আসবে। তাই যখন যার যতটুকু প্রাপ্যতা (আত্মার নিম্গ্নতা কিংবা বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা) তখনই তাকে তা পরিশোধ করে দেয়া উচিত। বাকি রাখা ঠিক হয় না। ‘জীবনে যা পাও, হাত পেতে নাও, বাকির খাতা শূন্য থাক।’ ওপরের কথাগুলি মনে রেখেই হয়তোবা কবি এই লাইনটি লিখেছিলেন।

এবার আসি কার কি পাওনা? আমার তো মনে হয়, সময়টাই সব থেকে বেশি পাওনা থাকে আমাদের। আমাদের পরিবার, স্বজন সবচেয়ে বেশি আশা করে আমাদের সাহচর্য। ঠিক যেমনটি আমরাও আশা করে থাকি আমাদের স্বজনদের কাছ থেকে। সেই সময়টি যদি আমরা সুন্দরভাবে সদ্ব্যবহার করতে পারি, তবেই আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব কিছুটা হলেও সুসম্পন্ন করতে পারা সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস। প্রবাদ আছে- সময়ের দাম সোনার চেয়েও বেশি! অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, একই সাথে সংসার, পরিবার, চাকরি, লেখালেখি, সমাজ, সংগঠন কি করে সম্ভব? ঐ যে বললাম সময়ের সদ্ব্যবহারই এর একমাত্র চাবিকাঠি।

এবার আসি মান সম্মত সময় বা Quality time বলতে আমরা কি বুঝি? সেটি হচ্ছে, বাবা, মা, ভাই, বোন, সন্তান-সন্ততি, বন্ধু বান্ধব, পরিবার, পরিজন বা অন্য যে কোন ব্যক্তির সাথে কথা বা কাজ করার সময় তার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দেয়া, যাতে সে বুঝতে পারে, তাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সে সময়টা তার সঙ্গে কাটাচ্ছেন, সে সময়টা শুধু তার জন্যই বরাদ্দ। হোক সে খুবই কম সময়, কিংবা বেশি। তাহলে সে বুঝতে পারবে- আপনার কাছে তার একটা মূল্য আছে এবং আপনি তাকে মূল্যায়ন করছেন। আপনাদের দুজনের পারস্পরিক সম্পর্কের একটি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন- এই মনোযোগ সম্পন্ন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সময় দেয়াকে Quality time বলে। বর্তমান iPhone এর যুগে Quality time maintain করা সহজ নয়। সময়কে সুন্দর ও আনন্দময় করা ব্যক্তির দক্ষতার সাথে সম্পৃক্ত। কেউ চাইলেই তার সময়কে মনের মাধুরী মিশিয়ে পরিবারের সাথে উপভোগ্য করে তুলতে পারেন। তিনি চাইলেই সাপ্তাহিক ছুটিতে পরিবারের সাথে ঘুরতে যেতে পারেন। একসাথে বাইরে বের না হয়ে ঘরে বসেই আকর্ষণীয় কোন মুভি দেখতে পারেন, গল্প গুজব করতে পারেন। ছোট ছেলেমেয়েদেরকে পাশে নিয়ে সুন্দর বই পড়ে শোনাতে পারেন, তাদের সাথে খেলা করতে পারেন। পরিবারের গৃহকর্ত্রীর সাথে রান্নাঘরে রান্নাসহ পরিবারের যাবতীয় সাহায্যের জন্য আপনার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন সহাস্যে। সবাই মিলে হাঁটতে যাওয়া বা ঘরেই নানা ধরনের ব্যায়াম চর্চার মাধ্যমে শারীরিক ফিট থাকতে পারার চেষ্টা করতে পারেন। এ ছাড়াও, বিভিন্নভাবে পারিবারিক বিচরণক্ষেত্র তৈরির পাশাপাশি অন্তরঙ্গ মুহূর্ত উপভোগ করতে পারেন। আসলে আমরা একটু চেষ্টা করলেই- জীবনের নানা পরতে পরতে দুর্বল সম্পর্কগুলোকে জোড়া লাগিয়ে দীর্ঘ জীবনের মূলমন্ত্রে নিজেদেরকে খুশি রাখতেই পারি।

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন- মহান আল্লাহ সূর্যকে তৈরি করেছেন বিচ্ছুরিত আলোর উৎস রূপে আর চাঁদকে করেছেন জ্যোতির্ময় (সে আলো প্রতিফলন)। তিনি চাঁদের কক্ষপথ ও কলাকাল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর, দিন ও সময়ের হিসাব নির্ণয় করতে পারো। মহান আল্লাহ এসব অনর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানীদের জন্য তার বাণী বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। সূরা ইউনুস : ৫। মহান আল্লাহ বলেন- ‘তুমি রাতে প্রার্থনার জন্য দাঁড়াও, রাতের অর্ধেক বা তার চেয়ে কিছু কম বা কিছু বেশি সময় নিবে। তুমি সে সময় কুরআন তেলাওয়াত করো শান্তভাবে, সুস্পষ্ট উচ্চারণে, অর্থের প্রতি মনোযোগী হয়ে।’ সূরা মুজাম্মিল : (২-৪)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন- তুমি দৃঢ়তার সাথে কাজ করো আর যখনই সময় পাও প্রতিপালকের কাছে একান্তভাবে নিমগ্ন হও। সূরা ইনশিরাহ (৬-৭)
এই সমস্ত আয়াত থেকেও আমরা Quality time উপভোগ করে আরো বিশ্বস্ত আরো সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে জীবনকে উপভোগ করতে পারি পরিপূর্ণ।

Share.

মন্তব্য করুন