হ্যান্ডসআপ…। হাত উপরে তোল, আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ কর?
রাজ্জাক মাস্টার ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে পেপার পড়ছিলেন। হঠাৎ ‘হ্যান্ডসআপ’ শব্দটি শুনে চমকে উঠে পেপার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তিনি সামনের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে যান। একি! আদরের নাতি রিজু মাথায় গামছা বেঁধে ক্রিকেট ব্যাটটাকে রাইফেল বানিয়ে তার দিকে তাক করে আছে। নয় বছরে পা রাখল রিজু। এই বয়সে এমন মুক্তিযোদ্ধা সাজার দৃশ্য থেকে রাজ্জাক মাস্টার বেশ খুশি হয়ে ওঠেন। তিনি তাড়াতাড়ি পেপারটা রেখে ভয় পাওয়ার ও সারেন্ডারের ভঙ্গি করে হাত দুটো উপরে তুলে দাঁড়িয়ে পড়েন। ছোট্ট রিজু তখন তাক করা রাইফেলটা নামিয়ে দাদার কাছে যায়। দাদা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে আলতো চুমু দিয়ে আদর করে বলেন, বাহ! খুব সুন্দর হয়েছে, এক্কেবারে সাচ্চা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। তা হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধা সাজলে কেন দাদা ভাই?

মাথায় বাঁধা গামছাটা খুলতে খুলতে রিজু বলে, দাদাজান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আমাদের স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। সেখানে আমি মুক্তিযোদ্ধ হবো। গত বছরতো করোনাভাইরাসের কারণে স্কুলে অনুষ্ঠান হয়নি। এর আগের বছর স্মৃতিসৌধের ছবি এঁকে পুরস্কার পেয়েছি। আমাদের ম্যাডাম মোবাইলের মেসেজ করে জানিয়েছেন, এবার যদি করোনাভাইরাস না থাকে তাহলে স্কুলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করা হবে। এতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। আমি তাতে অংশ নেব এবং মুক্তিযোদ্ধা হব। আমি যদি মুক্তিযোদ্ধা হই তাহলে কেমন হবে দাদাজান?
: খুউব ভালো হবে। আমার দাদাভাইকে এক্কেবারে বীর মুক্তিযোদ্ধার মতো লাগবে।
: আচ্ছা দাদাজান আমারতো রাইফেল নাই। এই ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে রাইফেল বানালে হবে না।
: হবে, অবশ্যই হবে।
: দাদাভাই মাথায় যে গামছা বাঁধবো সেটাতো আমি পারি না। আম্মু মাথায় গামছাটা বেঁধে দিয়েছে। তুমি আমাকে গামছা বাঁধাটা একটু শিখিয়ে দাও না?
: ঠিক আছে গামছাটা আমার কাছে দাও, আমি শিখিয়ে দিচ্ছি।
রাজ্জাক মাস্টার উৎসাহের সাথে রিজুকে মাথায় গামছা বাঁধা শেখানো শুরু করেন। আর রিজু তখন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাকে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে।
দাদাকে নিয়ে রিজুর অনেক গর্ব ও অহঙ্কার। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এলাকাতে রাজ্জাক মাস্টার হিসাবেই তিনি পরিচিত। একজন শিক্ষক হিসাবে এলাকাবাসী তাকে যেমন সম্মান করেন তেমনি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবেও সবাই তাকে শ্রদ্ধা করেন। এলাকার প্রতিটি অনুষ্ঠানেই রাজ্জাক মাস্টারের উপস্থিতি থাকে। বেশ কয়েক বছর আগে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন। মাঝে মধ্যে তিনি ঢাকায় ছেলের বাসায় আসেন। দাদা এলেতো রিজুর আনন্দের সীমা থাকে না। সারাক্ষণই দাদার সাথে থাকে। দাদাও রিজুকে নিয়ে খেলা করেন, তার সাথে অনেক গল্প করেন।

রাজ্জাক মাস্টার এবার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের এক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ঢাকায় এসেছেন। দাদাকে পেয়েতো রিজু খুশিতে আত্মহারা। করোনাভাইরাসের কারণে এক বছর যাবৎ স্কুল বন্ধ রয়েছে। বাসার বাইরে কোথাও যেতে পারে না। একা একা টিভি দেখে, বই পড়ে সময় কাটে। দাদাকে পেয়ে গল্প করার ও খেলার সঙ্গী পেয়ে রিজুতো খুশিতে আটখানা। দাদার কাছে আগে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছে রিজু। তখনতো সে আরও ছোট ছিল তাই মুক্তিযুদ্ধের মানে বুঝতো না। এখন সে ক্লাস ফোরে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে স্কুলেও পড়ানো হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছে। রিজু দাদার কাছে শুনেছে নেত্রকোনা জেলার মহিষখলার বর্ডারে পাকসেনাদের সাথে কিভাবে যুদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ী হয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প করতে করতে রিজু ওর দাদাকে বলে, রাইফেল নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে, বনে-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে তোমরা শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছো। ইস! কি যে থ্রিল তাই না দাদাজান? আমি যদি তখন থাকতাম তাহলে আমিও মুক্তিযোদ্ধা হতাম। শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করতাম। ইস! যদি মুক্তিযোদ্ধা হতে পারতাম। রিজুর কণ্ঠে আক্ষেপ ঝরে পড়ে।

রাজ্জাক মাস্টার এবার রিজুকে কাছে বসিয়ে বলেন, ওই সময় তো তোমার জন্ম হয়নি, তাই এ নিয়ে দুঃখ করে কি হবে। এখনতো তুমি যুদ্ধ করতে পার।
: বল কি দাদাজান! রিজু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, এখন কার সাথে যুদ্ধ করব? এখনতো আমরা সবাই বাংলাদেশের মানুষ। কেউতো আমাদের শত্রু না। শত্রু ছাড়া যুদ্ধ করবো কার সাথে।
: হ্যাঁ তাইতো যুদ্ধতো শত্রুর সাথেই করতে হয়। তুমিও শত্রুর সাথেই করবে। শোন দাদাভাই, মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু শত্রুদের সাথে লড়াই হয়নি। অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দিয়ে আশ্রয় দিয়ে এবং নানাভাবে সহযোগিতা করেও মুক্তিযুদ্ধ করেছে। দেশকে ভালোবেসে আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন করেছি। আমরা এ দেশকে সুন্দর সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছি। এখন দেশকে সুন্দর করে গড়ার জন্য ভালো কাজ করাটাও এক ধরনের যুদ্ধ। তুমি দেশের জন্য যে কোন ভালো কাজ করে দেশ গড়ার যুদ্ধে অংশ নিতে পার।
: তাই? তাহলে তুমি বল আমি দেশের জন্য কী করতে পারি।
: অনেক কিছু করতে পার। এই যেমন ধর, দেশটাকে সুন্দর রাখতে হলে পরিবেশকে সুন্দর রাখতে হবে। তুমি তোমার আশপাশের পরিবেশকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে সবাইকে সচেতন করতে পার। বলতে পার কেউ যাতে যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা না ফেলে। এটা একটা ভালো কাজ।
: হুম, এটা হতে পারে। এ ছাড়া আর কী হতে পারে?
: আর একটা ভালো কাজ করতে পার, সেটা হলো বৃক্ষরোপণ। কারণ গাছ হলো আমাদের পরম বন্ধু। আমরা নিঃশ্বাসের সাথে যে অক্সিজেন গ্রহণ করি তা গাছ থেকে পাই। গাছ বায়ু থেকে কার্বনডাই অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে। গাছ না থাকলে পরিবেশ উষ্ণ হয়ে যায়। অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ঝড়, টর্নেডোসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সৃষ্টি হয়। তাই গাছ আমাদের এবং পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু। তাই গাছ লাগিয়ে তুমি সবচেয়ে ভালো কাজ করতে পার।
: একদম ঠিক বলেছো দাদাজান। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য গাছ যে অপরিহার্য এটাতো স্কুলে স্যারও আমাদের পড়িয়েছেন। গাছ লাগানোর মতো এমন ভালো কাজের আইডিয়াটা আমার মাথায় আসেইনি। আচ্ছা দাদাজান কি গাছ লাগাতে পারি বলতো?
: সেটা তোমার ইচ্ছা। তুমি তোমার পছন্দ মতো যে কোন গাছ লাগাতে পার।
: একটা ফলের আর একটা ফুলের গাছ লাগালে কেমন হয়?
: খুবই ভালো হয়। তা কি ফল ও ফুলের গাছ লাগাতে চাও তুমি।
: আমার খুব প্রিয় ফল আমের গাছ আর আমাদের গ্রামের বাড়িতে পুকুর পাড়ে একটা বকুল ফুলের গাছ আছে না, তেমনি একটা বকুল ফুলের গাছ লাগাবো।
: বাহ! খুব সুন্দর হবে। তবে ভাবছি গাছের চারা রোপণ করবো কিভাবে?
: কেন আমাদের বাসার পিছনে যে খালি জায়গাটা আছে সেখানে চারা দুটো লাগাব।
: হ্যাঁ তাতো লাগাবে, তবে ওই খালি জায়গার মাটি কি গাছ লাগানোর উপযোগী আছে?
: কেন কেন থাকবে না কেন?
: এই যে তুমি শত্রুর কথা বলেছিলে না? সেই শত্রুর কবলে পড়েছে মাটি।
: বল কী, এটা আবার কেমন কথা?
: বুঝলে না তো। তাহলে বুঝিয়ে বলছি শোন। গাছ যেমন আমাদের এবং পরিবেশের পরম বন্ধু, তেমনি পলিথিন হলো আমাদের ও পরিবেশের চির শত্রু। এই পলিথিন মাটিতে পচে না, জমা হয়ে থাকে। এতে মাটিতে পলিথিনের স্তর জমা হয়ে এর উর্বরা শক্তি নষ্ট করে ফেলে। পলিথিন ড্রেনে ভিতরে আটকে জলাবদ্ধতা তৈরি করে। এসব নানা কারণে পলিথিন মাটি ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। এটা মাটির এবং পরিবেশের শত্রু, তাই আমাদেরও শত্রু। আর শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাইতো মুক্তিযোদ্ধার কাজ।
: হ্যাঁ দাদাজান এখন বুঝেছি। এমন এক ভয়াবহ শত্রুর বিরুদ্ধে আজ থেকে যুদ্ধ শুরু করতে হবে।
: একবারে তাই। এখন থেকে ক্ষতিকর পলিথিনের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ শুরু করতে হবে। পলিথিন ব্যবহার বর্জন করতে হবে। বাজারে যেতে হবে কাপড়ের থলে বা পাটের ব্যাগ নিয়ে।
তুমি ঠিক বলেছো দাদাজান। আজ থেকে পলিথিনের বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধ শুরু। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশকে সুন্দর করে গড়ে তোলার যুদ্ধে বিজয় অর্জন করে আমি হব এ যুগের মুক্তিযোদ্ধা। রিজুর মুখে এ যুগের মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি শুনে রাজ্জাক মাস্টারের বুক গর্বে ভরে যায়। তিনি রিজুকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।

Share.

মন্তব্য করুন