দু’দিন দীর্ঘ সফর শেষে সুন্দরপুর এসে পৌঁছলাম। গ্রামটির নাম যে এমনিই সুন্দরপুর হয়নি তাও বুঝলাম। চারিদিকে গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালি কোনটারই কমতি নেই এখানে।
শহরের যান্ত্রিক জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম। তাই তো শরীর ও মন দুটোই চাঙ্গা রাখার জন্যই এলাম এখানে। ছিদ্দিক নামে আমার এক মামা এখানেই থাকেন। তাই তার বাসাতেই উঠলাম। সেদিন মামার বাসাতে উঠেই লক্ষ্য করলাম বাসাটি প্রায়ই অভিজাত ধরনের। একে তো দালান, তার উপরে সবকিছু রঙ করা। ভালোই লাগলো আমার। গ্রামের সব বাড়িগুলোর থেকে মামার বাসাটা আলাদা। সাধারণত টিনের চালা ও ছনের ঘর থাকে সবার। একসময় মামা এ গ্রামের একমাত্র স্কুলটির হেডমাস্টার ছিলেন। কিন্তু রিটায়ার্ড নিয়ে তার ছেলে এখন আছে তার দায়িত্বে। যাই হোক সেদিন খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিয়ে নিলাম।
পরদিন বেরোলাম ঘুরতে। কিছুদূর যেতেই আমার চোখ পড়লো এক অসহায় ছেলের দিকে। ছেলেটা একজনের দিকে কিছু টাকার জন্য হাত পাততেই এক লোক তাকে বকাঝকা শুরু করে। ছেলেটা অনেক ছোট। এ বয়সে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামার কারণ বুঝে পেলাম না। এগিয়ে গেলাম ছেলেটার দিকে।
– এই যে বাবু, এ দিকে শোন!
– আজ্ঞে বাবুমশাই আমারে ডাকছেন?
– হুম। তোমাকেই ডাকছি।
ছেলেটি এগিয়ে আসতেই তাকে পকেট থেকে ৫০ টাকা বের করে হাতে দিলাম। ছেলেটা দু’ এক টাকা নিয়েই অভ্যস্ত। হঠাৎ ৫০ টাকা দেয়াতে সে খুব অবাক হয়ে গেল। সে ছলছল চোখে আমার দিকে তাকাল। তার দৃষ্টিতে ছিল কৃতজ্ঞতার ছাপ। এরপর তাকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম-
– তুমি এই বয়সে ভিক্ষা করছ কেন? লেখাপড়া করনি?
– কি যে বলেন বাবুমশাই! বাপ মারা যাওয়ার পরে আমি আর মা অনেক কষ্টে ছিলাম। এখন দু’ মাস আগে মাও আমারে ছাইড়া গেছে। দিনে ভিক্ষা তাতে চলে না আর। আমি কেমনে আবার লেহাপড়া হরমু?
ছেলেটার দুঃখের কথা শুনে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম-
– তুমি থাক কোথায়?
– ওই যে ওইহানে মোর বাড়ি। ছিদ্দিক মাস্টারের বাড়ির পাশে। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ছেলেটি।
– ছিদ্দিক মাস্টার আমার মামা হয়। আমি এই ক’ দিন সেখানেই আছি। টাকা বা যে কোন কিছুর দরকার হলেই ওখানে চলে আসবে কিন্তু।
এ কথা বলেই দেখলাম পশ্চিম আকাশে সূর্যের লাল আভাটুকু মিলিয়ে যাচ্ছে। তাই “যাই গো” বলে আসলাম।
সেদিন রাতে খাবার পর মামার সাথে নানা বিষয়ে আলাপ আলোচনা করার সময় ছেলেটির পরিচয় জানতে চাইলাম মামার কাছে। তখন মামা বলল-
– ওর নাম হারু। একসময় ওদের কোনো অভাব ছিল না। পাঠশালাতেও আসতো নিয়মিত। কিন্তু ওর মা-টা মারা যাবার পর আর কেউ নাই তার। ভিক্ষা করেই খেতে হয় তাকে। তেঁতুলগাছটার পাশে যে ছনের ঘর আছে সেখানেই থাকে সে।
আর কিছু শুনতে মন চাইলো না আবার। মানুষের কষ্টের কথা শুনতে কোনদিনই ভালো লাগে না আমার। পরদিন বাগানে পায়চারি করছিলাম। দেখলাম পাড়ার কতক ছেলের সাথে ডাঙ্গুলি খেলছে হারু। ‘হারু’ বলে একটা হাঁক ছাড়তেই সে দৌড়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো।
– কি বাবুমশাই! ডাকছিলে?
– হ্যাঁ রে। তোর পড়াশুনা করার ইচ্ছে হয় না?
– অ-নে-ক। কিন্তু পড়মু ক্যামনে? ভিক্ষা করে যা পাই তা দিয়েই তো ক্ষুধা মেটে না। তাহলে….
– তুই পড়বি। অবশ্যই পড়বি। আমি তোর পাশে আছি হারু। এই নে ধর ৫০০টা টাকা দিলাম তোকে। বই পত্তর যা লাগে কিনে কাল থেকে ক্লাস করা শুরু কর। আমি মাসুমের সাথে কথা বলেছি। ও তোকে ভর্তি করিয়ে দেবে। বুঝলি?
আমার কথা শুনে তো রীতিমতো হকচকিয়ে গেল সে। আমিও তার সেই চেহারার দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। পরক্ষণেই নিজেকে যখন আবিষ্কার করলাম তখন সে তার ছোট্ট দুটোপ হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। কেঁদে কেঁদে বলে উঠলো-
– বাবুমশাই! আপনি মানুষ না দেবতা?
– সে কি রে? দেবতা হতে যাবো কেন রে? আমি মানুষই। যা কান্নাকাটি ছেড়ে এখন টাকাটা নে দেখি।
প্রথমে সংকোচ থাকলে পরে আর সেটা রইলো না। সে টাকাটা নিলো। পাছেই মামা সবকিছু দেখছিলো। তাই হারু চলে যাওয়ার পর মামা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো-
– কি ব্যাপার? এখানে ওই কটি টাকা নিয়েই তো এসেছিলে। তার মধ্যে ওই টাকা তো ওষুধের জন্য এনেছিলো। তা দিয়ে দিলে ওকে?
– হ্যাঁ মামা। কারণ ওষুধে তো আমি শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে যাবো। কিন্তু একটা অভিজাত ছেলে যার কোন কিছুরই অভাব ছিল না সে এভাবে পড়ে পড়ে ভিক্ষা করবে তা তো আমি মেনে নিব না মামু। এভাবে কি আর সুস্থ থাকা যায় বলো দেখি?
মামা আর কিছুই বললো না। হয়তো বলার কিছুই ছিল না তার। পরদিন থেকে দেখি গাঁয়ের সেই প্রাইমারি স্কুলটা খুলেছে। দেখতে গেলাম। অনেক ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে হারুকেই খুঁজে ফিরছিলাম তখন। কিছুক্ষণ বাদেই দেখলাম আমাকে অপেক্ষা করার আর সুযোগ না দিয়ে হারু এদিকেই আসতে লাগলো। কাছে আসতেই বলতে লাগলাম তাকে-
– কি রে হারু! কেমন লাগছে?
– বাবুমশাই! আপনাকে আমি চিনি নে। কিন্তু আপনি আমার জন্য যা করলেন তা হয়তো কোনদিন আমি শোধ দিতে পারবো না।
– যাঃ ও কথা মুখে আনতে আছে রে! তোরাই হলে গিয়ে জাতির ভবিষ্যৎ। শুধু আমাকে কথা দে লেখাপড়া করে বড় অফিসার হয়ে আর দশটা মানুষের সেবা করতে পারবি তো?
– খুব পারবো। তুমি দোয়া করো শুধু।
হারুকে গেট পর্যন্ত দিয়ে আসলাম। গেটম্যান আমাকে দেখে বলে উঠলো,
– দাদা! এতদিন পর এলেন! যান অফিসে গিয়ে বসেন।
অগত্যা অফিসে গিয়েই বসে রইলাম। মামাতো ভাই মাসুম এখন এখানকার হেডমাস্টার। মামা রিটায়ার্ড হওয়ার পর থেকেই সে দায়িত্ব নিয়েছে এখানকার। হারু আর অন্য সব ছেলেকে দেখে রাখতে বললাম মাসুমকে। বললাম, দেখিস ওদের গায়ে হাত তুলিস নে যেন!
পরদিন কালেন্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম যে আজ আমার দিন শেষ। চাকরি থেকে ছুটি পেয়ে দিন চারেকের জন্য এসেছিলাম এখানে। খুব তাড়াতাড়িই যেন চলে গেল দিনগুলো! এখন শহরে চলে যেতে হবে। তাই সেদিন আমার সন্তানতুল্য হারুকে তার ছনের বাসাতে গিয়েই ডাকতে লাগলাম। আমার একডাকেই সে বাইরে এসে হাজির। তার দ্রুত সাড়াদানের ক্ষমতা দেখে ভারি অবাক হলাম আমি।
– চল। বাগানে গিয়ে বসি।
– চলো
এরপর বাগানের এক দোলনায় তাকে নিয়ে বসলাম। বসার পর তার খবর নেয়ার পর বলে উঠলাম।
– হারু! আমার মনে হয় কালকেই আমাকে চলে যেতে হবে রে!
মানুষ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে যতটা আহত হয় হারু তার চেয়ে কোন অংশে কম আহত হয়েছে বলে মনে হলো না।
– কেন দাদা?
– বাঃ রে। এখানে কি আর আমি থাকতে এসেছি বল তো?
– আমি তোমাকে যেতে দেব না।
– আরে তোর চিন্তা কিরে? তোকে কি আর আমি ভুলে যাচ্ছি? প্রতি মাসে তোর জন্য টাকা পাঠিয়ে দেব।
– দাদা আমার টাকা চাই না।
– সে কথা বলতে নেই হারু। এখানে যতক্ষণ ছিলাম তোকেই আমার ছেলে বলে মনে হয়েছে। কিন্তু ওপারেও তো আমার ছেলে আছে রে! আমাকে ওদিকে যেতে দেবি নে?
– না… বলতে বলতে সে কোনদিক বিবেচনা না করে দৌড় দিয়ে চলে গেল। তাকে আর আটকে রাখার সাহস হলো না আমার।
পরদিন থেকে জিনিসপত্র বাঁধাবাঁধি শুরু হলো আমার। আবার এর মধ্যে ভ্যানও চলে এসেছে। জিনিসপত্র গোছগাছ শেষে ভাবলাম হারুকে গিয়ে ডাকবো। কিন্তু তার আগেই দেখি হারু আমার অপেক্ষায় দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে আমার পথ আগলে দাঁড়ালো সে। যেতে দেবে না কিছুতেই। তাকে কোলে নিয়ে বসলাম। চোখের জল মুছে দিলাম। বললাম,
– যে যেতে চায় তাকে আর বাধা দিতে আছে রে? শোন্ আমি আজ যাচ্ছি। আমাকে আর ধরে রাখিসনে। কিন্তু বড় হয়ে গেলে এ দেশের সব শিশুকে দেখে রাখার দায়িত্ব কিন্তু তোর হবে। তাদের কিন্তু ধরে রাখতেই হবে বুঝলি?
আর কিছু বললাম না। আমার এই দোষ, বেশি কথা কইতে পারি নে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাসুমকে ডেকে বললাম, ওরে ওর খেয়াল রাখিস কিন্তু। দূরের বলে দূরে ঠেলে দিস নে। আচ্ছা দাদা বলে সে সায় দিলো। এবার ভ্যানে উঠে পড়লাম। উঠে বসার পর দোয়া করলাম আমি, হে প্রভু! সুন্দরপুরকে আরো সুন্দর করে দাও তুমি। এখানকার ¯িœগ্ধ আলো দিয়ে আলোকিত করে দাও সকলের মন।
এরই মাঝে ভ্যান বড় রাস্তায় গিয়ে উঠলো ভ্যান। রাস্তাটা পুরো নিস্তব্ধ। প্রার্থনা শেষে পিছু ফিরতেই দেখি নিস্তব্ধ এই রাস্তাটার মধ্যে চলমান এই ভ্যানের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে হারু!
এটি চিরকাল স্থায়ী হয়।

Share.

মন্তব্য করুন