আপনার কৈশোরকাল কেমন ছিল?
আমার অসম্ভব সুন্দর কৈশোরকাল ছিল। আমার আব্বা চাকরি সূত্রে বগুড়ার করতোয়া নদীর ধারে একটি এলাকায় আমরা থাকতাম। আব্বার কলিগের ছেলে মেয়ে মিলে আমরা আট দশজন বন্ধু ছিলাম কাছাকাছি বয়সের। আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে অবাধ প্রকৃতি, ধানক্ষেত, পাটক্ষেত, নদী, বিল, বিলের ধারে শাপলা, নৌকা ইত্যাদিতে অনবরত ঘুরে বেড়াতাম। স্কুলে যেতাম। এরকম একটা কৈশোর ছিল।

কৈশোরে কি কি স্বপ্ন দেখতেন?
লেখাপড়া শেষ করবো এরকম স্বপ্ন ছিল। তারপরে কি হব ওই বয়সে ওভাবে ভাবতে পারিনি।

কোনো দুরন্তপনা গল্প মনে পড়ে কি?
গ্রামে আমরা দৌড়ঝাঁপ করতাম। গাছে উঠতাম। পাখি ফুল দেখতাম। গাছের বিভিন্ন ফল পেড়ে খেতাম।

কৈশোরে দেখা স্বপ্ন জীবনে কতখানি পূরণ করতে পেরেছেন?
কৈশোরে আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আমাদের প্রাইমারি স্কুলের হেড মাস্টার। একবার এক্সিডেন্ট করে পা হারিয়েছিলেন। ক্র্যাচে ভর করে স্কুলে আসতেন। আমাদের মাঠে দাড় করিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়াতেন। আর বলতেন দুটো লাইন বল- পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল/ কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল। লাইন দুটো বলা হলে তিনি আমাদের বলতেন, ‘তোরা সবাই কাননের কুসুম কলি। তোদেরকে ফুটে ওঠতে হবে। আমি জানি তোরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হতে পারবি না। গবেষক হতে পারবি না। বড় চাকরি করতে পারবি না। কিন্তু মানুষ হিসেবে তোরা বড় হবি। তোরা কেউ যদি দোকান্দার হলে, রিকশা চালালেও কিন্তু মানবিক চেতনা যেন তোদের ভেতর থাকে। এই মানবিক চেতনা দিয়ে মানুষকে শ্রদ্ধা করবি। মানুষকে সম্মান করবি। ধনি গরীব নির্বিশেষে সব মানুষ যেন তোদের চোখে শ্রদ্ধার পাত্র হয়।’ এই শিক্ষাটা এখন পর্যন্ত আমার কাছে একটা গভীর শিক্ষা হয়ে আছে।

আরেকজন মানুষ ছিলেন করতোয়া নদীর খেয়া ঘাটের মাঝি। ওনার নাম ছিল বাড়–য়া মাঝি। তিনি পয়সার বিনিময়ে যাত্রী পারাপার করতেন। মাঝে মাঝে আমরা গিয়ে বলতাম, কাকু আমাদের একটু ঐ পাশে পার করে দেন না। ঐ পাশে আমরা ঘুরবো, বড় বড় গাছ আছে ওগুলোতে চড়ব। তখন তিনি বড়দের নামিয়ে দিয়ে আমাদের নিয়ে যেতেন। বড়রা তখন তাকে গালাগালি করতো, ‘অই শয়তান ওরা কি তোকে পয়সা দেবে!’ তখন তিনি বলতেন, ‘আমি তো ওদের কাছে পয়সা চাই না। ওরা শিশু। ওরা আগামী দিনের মানুষ। ওরা দেশটাকে দেখে, সব জায়গা দেখে ওরা বড় মানুষ হোক। কারণ ওরা যখন বড় হবে তখন এসব কথা মনে করে দেশের জন্য কাজ করবে।’ একজন নিরক্ষর খেয়া ঘাটের মাঝি শিশুদের নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছেন এই স্বপ্ন আজকের দিনেও আমার কাছে বিশাল স্বপ্ন হয়ে আছে। এ দুটো ঘটনা আমি সব সময় মনে রাখি। এবং ঈদের সময়টাতে মাকে বলতাম ওনার জন্য খাবার দিতে। মা গরুর মাংস কখনও দিতেন না। পোলাও, মুরগির মাংস কলাপাতায় মুড়িয়ে নিতাম। কেননা মা বলতেন, ‘মুসলমানের বাড়ির খাবার উনি হয়তো নাও খেতে পারেন। থালা বাসন দেয়া যাবে না। তোমরা কলাপাতা নিয়ে আসো সুন্দর করে মুড়িয়ে দিই, উনি যেন খায়।’

নিপীড়ন বা কঠোর শাস্তি কিশোর বিকাশের ক্ষেত্রে কতটা ক্ষতিকর?
কতটা না পুরোপুরিভাবে ক্ষতিকর। নিপীড়ন তার অধিকার থেকে তাকে যেমন বঞ্চিত করা তেমন তার সুস্থ চিন্তাধারাকেও বাধাগ্রস্থ করা। নিপীড়ন করলে তার মন খারাপ হয়ে যাবে। মন খারাপ হয়ে গেলে সে মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণ করবে না। এ জন্যই নিপীড়ন করে তাকে খারাপভাবে দেখা এবং তাকে মূল্যবোধহীন জায়গায় ফেলে দেয়া একেবারেই ঠিক নয়।

কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে পিতা-মাতার কর্তব্য কি হতে পারে?
মধ্যবিত্ত পরিবার বা উচ্চবিত্ত পরিবার ঠিকমতো যত্ন নেয় লেখাপড়া, স্কুলে যাওয়ার। কিন্তু আমাদের নিম্নবিত্ত পরিবারে তাদের যে পড়ালেখা শেখানো যায়, শৈশব থেকে গড়তে হয় অনেক সময় তারা সে জায়গাগুলো ধরতে পারে না। এ জায়গাগুলো ধরে তাদেরকে ঠিকমতো লেখাপড়া শেখানো দরকার। আরেকটা কথা বলি আমি- শিশুদের গল্পের বই দেয়া। সেই বই থেকে তারা কল্পনার দিগন্তটা বিস্তার করতে পারবে। তারা লেখক না হোক জীবনের সাথে সামাজিকভাবে এই কল্পনা কাজে লাগিয়ে মানুষের জন্য বড় জায়গা তৈরি করতে পারবে। সাংস্কৃতিক চেতনার জায়গাটা তৈরি হবে।

এই আধুনিক সময়ে শিশুরা বই বিমুখ হচ্ছে কেন?
বই বিমুখ বলা যাবে না। আমি বলবো অভিভাবকরা বই বিমুখ করছে শিশুদের। আমি শিশু একাডেমিতে থাকতে সব সময় বলতাম, বাচ্চাদের বই উপহার দিন। একটি বই পড়তে দিলে ও ঠিকই পড়বে। একটা গল্পের বই থাকলে পড়ে মাথার পাশে রেখে ঘুমাবে। শিশুদের হাতে বই না দিয়ে বলা যাবে না যে বই পড়া থেকে শিশুরা বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। এই জায়গায়টায় আমাদের সঠিকভাবে বিবেচনা করতে হবে যে আমরা শিশুদের হাতে সঠিকভাবে বইটি পৌঁছাচ্ছি কিনা।

আপনার সময়ের কৈশোর আর এখনকার সময়ের কিশোরদের কৈশোর জীবনের পার্থক্য কেমন দেখছেন?
আমার পঁচাত্তর বছর বয়স হয়েছে। পঁচাত্তর বছর আগে তো এই সমাজ এমন ছিল না। এখনকার শিশুরা ডিজিটাল দেশ দেখতে পাচ্ছে, এর মাঝে বসবাস করছে। ইন্টারনেট পেয়েছে। ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইমো, বিপ, হোয়াটস্অ্যাপ, ইউটিউব এসব জায়গায় প্রবেশ করেছে। সুতরাং সময়ের বিবর্তন এই জায়গাগুলো তৈরি করবে এটাই সত্য।
কিশোরদের স্মার্টফোন ব্যবহার কতটা উপযোগী এবং সুশিক্ষার জন্য এর ব্যবহার কতটা নেতিবাচক?
আমি মনে করি না যে এটা খুব উপযোগী। আমরা তো এসবের মাঝে বড় হইনি। এসব না পাওয়ার ব্যর্থতা আমাদের ওভাবে মনে হয় না। এখনকার শিশুরা পেয়েছে আমরা পাইনি। আমরা সময়কে অনুধাবন করেছি আমাদের মত করে। সুতরাং এই জায়গায়টায় শিশুদের যেমন চিন্তার বিষয় আছে, যেটা উপযোগী না সেটা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা। আর যেটা উপযোগী সেটাতে থেকে নিজের জায়গাটা তৈরি করা। এসব শেখাবেন অভিভাবকরা। স্কুলের শিক্ষকরা।

বড় হতে হলে কিশোরদের কি যোগ্যতা অর্জন করতে হবে?
লেখাপড়াটা ভালো করে করতে হবে। স্কুলের লেখাপড়া ফাঁকি না দিয়ে, অবহেলা না করে ঠিকভাবে পড়াশোনা করে নিজেকে গভীর জ্ঞানের জায়গায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে হবে। এই জায়গাগুলো কৈশোর থেকেই গড়া দরকার। কিশোর বয়স থেকেই এই জায়গাগুলো ধারণ করবে। সামাজিক মূল্যবোধের জায়গাগুলো বুঝবে। ধনি গরীব নির্বিশেষে সবাইকে শ্রদ্ধা করবে। কোনো মানুষকে অমর্যাদার জায়গায় ফেলে দেবে না।

বড়দের সাথে কিশোরদের আচরণ কেমন হওয়া দরকার?
কিশোররা তো অনেক কিছু না বুঝে বড়দের সাথে আচরণ করতে পারে। সেখানে বড়দের ঐভাবে, খারাপভাবে শাসন করা উচিত না। ওকে একটু বুঝিয়ে কথা বলা উচিত। ওদের বোঝানো উচিত যে শ্রদ্ধেয় মানুষের সাথে এভাবে কথা বলবে, এভাবে তাকাবে, ওভাবে শ্রদ্ধা করবে। এগুলো শেখানো বড়দের দায়িত্ব। আর কিশোররা এত দ্রুত ওসব শিখতে পারবে এটা ভাবা উচিত নয়। কেউ হয়তো পারে, কেউ পারে না। কারণ সবার মেধা এক রকম নয়। তাই সবাইকে এক কাতারে বিচার করা উচিত নয়। কাজেই অভিভাবকের দায়িত্ব সে জায়গাগুলো তৈরি করে দেয়া।

পিতা-মাতার কাছ থেকে কোন কিছু বায়না করে না পেলে, কিশোরদের একগুঁয়েমি করা কি ঠিক?
কিশোরদের চিন্তা করা উচিত কোন কিছু বায়না করে না পেলে; ভাবতে হবে বাবা মা কেন দিতে পারলো না। বাবা মা’তো আমাকে ভালোবাসে তবু কেন পেলাম না। তাকে বুঝতে হবে, হয়তো তাকে সে জিনিসটা দেয়া ঠিক হবে না। অথবা টাকার অভাবে দিতে পারলো না। এসব জায়গাগুলো তাদের একটু মূল্যায়ন করে বুঝতে হবে যে কেন আমি পেলাম না।

কিশোররা কেমন স্বপ্ন দেখবে?
যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী সে তার স্বপ্ন দেখবে। আর সার্বিকভাবে মানবিক হওয়ার স্বপ্ন দেখবে। মানুষের জন্য কাজ করা। আর যদি সে মনে করে ডাক্তার হতে হবে, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, অধ্যাপক হতে হবে, ব্যবসায়ী হতে হবে, বড় অফিসে চাকরি করতে হবে। সেইভাবে একটা চিন্তা তো থাকবেই। কিন্তু সর্বাবস্থায় মানবিক হওয়াটা একদম সমান্তরালভাবে সবারই থাকা উচিত।

নাগরিক সচেতন হয়ে গড়ে উঠতে আমাদের কিশোরদের মননে কি শিক্ষা প্রয়োজন?
শিক্ষাটা হলো মনোনয় শিক্ষা। যেমন কিশোর যদি একটি পথশিশুকে দেখে আর রাস্তার সে শিশুটি এসে ওর কাছে একটি আবেদন করলো। তাহলে সস্নেহে কথা বলে ওর পকেট থেকে দুটো টাকা ওকে দিয়ে বলবে- যাও এটা তোমাকে দিলাম এবং তোমাকে আমি ভালোবাসি। এভাবে সুন্দর সহজ আচরণ করা উচিত।

আবার যদি কৈশোর ফিরে পাওয়া যায় তবে কি হতে চাইবেন?
আমি আবার লেখক হতেই চাইবো। যেভাবে লেখক জীবনকে দেখছি এবং লিখছি এ জীবনটাই যেন আমার কাছে আবার ফিরে আসে। আমি যেন শৈশবে সেই গণমানুষকে দেখি। মানুষের দারিদ্র দেখি। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখি। সবকিছু মিলিয়ে জীবনের প্রেক্ষাপট যেন আমার কাছে সাহিত্যের মাধ্যম হয়ে যায়।

Share.

মন্তব্য করুন