বিদ্যুৎ চলে গেছে। এক ঘণ্টার উপর হবে, আসার কোন খবর নেই। তবে সায়ানের দাদির হাতের হাতপাখাটি ঘুরছিল। হাতপাখার বাতাসে মজা আছে। কিন্তু বাতাসের সাথে ভেসে আসা ক্যাচ ক্যাচ শব্দটি তার বিরক্ত লাগছে। চারদিকে ভীষণ গরম। মোবাইলে কথা বলার নেটওয়ার্কটি পর্যন্ত তার বাবা পাচ্ছে না। মোবাইল ফোনের একটি টাওয়ারও দেখা যাচ্ছে না। কোনোভাবে একবার কারো ফোন ঢুকলে অমনি তার বাবা ফোনটি হাতে দৌড়ে ছাদে উঠছে। আর তাকে বারবার বলতে শোনা যাচ্ছে, ভাই অথবা স্যার আমরা হোল ফ্যামিলি গ্রামের বাড়িতে এসেছি, এখানে নেট সমস্যা। সেখানে সায়ানের গেম খেলার নেট। কল্পনা করাও অসম্ভব ব্যাপার। এ এক গুহার জীবন। তার কোন বন্ধুর সাথে সে কোন যোগাযোগ করতে পারছে না। বিকেলে এখানে পৌঁছানোর পর তার মায়ের মোবাইল ফোনটি হাতে একবার সে ছাদেও উঠেছিল। কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। বাংলালিংক সিম খুলে গ্রামীণ সিম উঠিয়েও কোনভাবেই সে ডাটা কানেকশন পাচ্ছে না। শুধু গোল গোল করে ঘুরছে। এখন তার মনে হচ্ছে, গ্রামীণ ফোন কোম্পানি কত বড় একটা মিথ্যাবাদী। অ্যাড দেখায় পাহাড়েও তাদের নেট কত শক্তিশালী। অথচ এখানে, ছি…! গ্রাম দেখতে আসার তার স্বপ্ন-সাধ সব ধূলিসাৎ হয়ে গেল। তার বন্ধু-বান্ধব এবং সমস্ত দুনিয়া থেকে সে এখন বিচ্ছিন্ন। অথচ এখানে তাকে থাকতে হবে- আজকের রাত বাদেও আরও সাত দিন। সে মনে মনে ওয়াদা করেছে- একবার ঢাকায় ফিরতে পারলে হয় জীবনে আর কখনো গ্রামমুখো হবে না। তার কষ্ট বোঝার মতো এখানে এখন কেউ নেই। তার মা সেই বিকেল থেকে একবারও তার কাছে আসেনি। বাবাকে চোখে দেখা যাচ্ছে কিন্তু তার কাছে ঘেঁষার উপায় নেই। অনবরত অপরিচিত লোকজন তাকে ঘিরে রাখছে। আর সায়ানের বাবাও তাদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে, আবার কেউ এসে- তার বাবাকে জড়িয়ে ধরছে। আবার কাউকে জড়িয়ে ধরছে তার বাবাও। মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে কথা বলছে। বাবা-মা দু’জনকেই আজ তার অপরিচিত লাগছে। সায়ান তার বাবা-মায়ের এ রূপ কোনদিন দেখেনি।

অথচ সে জন্মের পর থেকে যে দু’জনকে সবচে কাছ থেকে দেখেছে তারা তার বাবা-মা। এ বাসায় চার-পাঁচ মাস- আরেক বাসাতে এক বছর। অথবা আরও কিছুদিন বেশি। এমন করে বাসা আর স্কুল বদলের মাঝে সায়ানের বেড়ে ওঠা। নতুন বাসাতে উঠে- নতুন আন্টি-আঙ্কেল হয়। কোনো কোনো বাসাতে একজন-দুইজন ভাইয়া-আপুও থাকে। তাদের সাথে পরিচয় হয়- একসাথে খেলাধুলা করতে করতে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। আবার বাসা বদলের সাথে সাথে শেষ হয়ে যায় সব সম্পর্ক। সায়ান রোজ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ব্রাশ করে। শুক্রবার সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠে- এগুলোর মতোই তার কাছে আর একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হচ্ছে পুরনো বাসার সবকিছু বেমালুম ভুলে যাওয়া। অথবা নতুন বাসা-নতুন স্কুলের সবার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়া। টিভি-টিভির রিমোট আর তার মায়ের মোবাইলটি- যেটির উপর তার দখলই তার মায়ের থেকে বেশি। এগুলোর সাথে তার যোগাযোগ সবচে ভালো। স্কুল-প্রাইভেট বাদে যেইটুকু সময় সে পায়, টিভি দেখে- তার মায়ের মোবাইলে গেম খেলে। পাবজি, মোবাইল লিজেন্ট, ফ্রি-ফায়ারের মতো যুদ্ধের গেমগুলো তার বেশি প্রিয়। ইউটিউবে নানান রকম কার্টুন দেখে।
সব মিলিয়ে সায়ানের মন একেবারে বিষিয়ে উঠেছে। তবে যাত্রাপথের ধকলের কারণে তার চোখ জোড়া কেবলই বুজে এসেছিল। এর মধ্যেই টিনের চালে তাল পড়ার বিকট শব্দ। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠল সায়ান- তার দাদির হাতের হাতপাখাটি তখনো বন্ধ হয়নি। পাখা ফেলে সায়ানকে জড়িয়ে ধরল তার দাদি। পাশের ঘর থেকে দৌড়ে এলো তার দাদা- সাথে বাবা-মাও। তার দাদি তাকে জড়িয়ে আছে। দাদা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে, আরে পাগল, গাছ থেকে তাল পড়ার শব্দ। ভয় কী? সায়ানের মুখে কোন কথা নেই। শুধু আলাভোলা চোখে এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছে। সায়ানের দাদি দোয়া পড়ে তার বুকে বারবার ফুঁ দিচ্ছে। সায়ান তার বাবাকে বলল, বাবা, আই ওয়ান্ট টু ব্যাক, অ্যাজ শুন অ্যাজ পসিবল। সায়ান ঢাকার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে… পড়ে। বাসা-বাড়িতে সে তার বাবা-মায়ের সাথে সাধারণত ইংরেজিতে কথা বলে না। তবে রেগে গেলে, বলে। সায়ানের দাদি তাকে এখনও জড়িয়ে ধরে আছে। তার দাদা এখনও তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। তার বাবা-মা একেবারে চুপচাপ।

সায়ানের বাবা তার ছেলের কথার কোন উত্তর দেয়নি। ছয় বছর পর আজ সে তার বাবার বাড়িতে এসেছে। বাবার অমতে বিয়ে করার কারণে এতোদিন সে বাড়িতে আসতে পারেনি। বিয়ের পর থেকেই সে বাইরে বাইরে। আজ এতোদিন পর এসেও আবার ছেলেটা এমন করছে। এসব মানিয়ে নিতে পারছে না। সে সায়ানের দিকে তাকিয়ে দেখল, আবার সে চোখ বন্ধ করেছে। সায়ানের দাদি তার বাবাকে ইশারায় ঘুমাতে যেতে বলল। কিন্তু তার দাদা বলল, বৌমারা এই ঘরে থাক। সায়ানকে নিয়ে চল, আমরা ঐ ঘরে যাই। ওখান থেকে অন্তত তাল পড়ার শব্দটা এতো জোরে শোনা যাবে না। সায়ানের দাদার কথামতো তাকে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হলো অন্য ঘরে।

ভোরে মোরগের হাঁক আর মোয়াজ্জিনের ডাক কেউই সায়ানকে জাগাতে পারেনি। আর কেউ তাকে জাগাতে চেষ্টাও করেনি। সে একা একা জেগে উঠে দেখল, তার বুক বরাবর পুরনো আমলের একটা বৈদ্যুতিক ফ্যান লোহার রডের সাথে ঝুলানো। ফ্যানটি ঘুরছে। তার মাথার নিচের বালিশের উপর আরও একটি ফুলতোলা কাঁথা বিছানো। তার পিঠের নিচের কাঁথাটির ফুলগুলোর সাথে বালিশের কাঁথার ফুলগুলোর মিল রয়েছে। সে সেগুলোকে ছুঁয়ে দেখল, বেশ নরম। দেয়ালে ঠিক কী রঙ করা হয়েছিল, এখন বোঝা যাচ্ছে না। তবে বর্তমান রঙটি হলদেটে। কাঠের জানালায় তাকিয়ে সে দেয়ালটির পুরুত্ব আন্দাজ করল। বেশ পুরু একটা দেয়াল, কমপক্ষে তিনটি করে ইট দেয়া। আর ছাদে বিমের জায়গাতে কিসের যেন গাছ দেয়া। চারটির মধ্যে একটা গাছের গায়ে আবার খোদাই করে লেখা, ১৩৪৯ বাংলা। সে মনে মনে বলল, এ কোন পাগলের ঘরে সে আসল। যদি গাছগুলো ভেঙে যায় আর যদি ছাদও ভেঙে পড়ে! ঠিক একই সন্দেহ তার ট্রেনে করে যমুনা ব্রিজ পার হওয়ার সময়ও হচ্ছিল। ট্রেনের ব্রিজটির ডানপাশে তো আর কিছু নেই। যদি ভেঙে যায়! রাতের চেয়ে এ মুহূর্তে তার মন অনেকটা ফ্রেশ। সায়ান বুঝতে পারল, রাত্রে সে এই ঘরে ছিল না। তার ঘুমের মধ্যেই কেউ তাকে এ ঘরে এনেছে। এরই মধ্যে তার দাদি ঘরে ঢুকলো। সায়ানের ধারণা, তিনিও বোধ হয় এখন তার মনের ফ্রেশ অবস্থাটা বুঝতে পারছে। তার দাদি এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, চল দাদা ভাই বাইরের দিকে যাই। পুরাতন লোকে বলতো, সকাল বেলার হাওয়া, লাখ ট্যাকার দাওয়া। আর চলো, দেখো গা কত মানুষ তুমাক দেখতে আসিছে? সায়ান তার দাদির মুখের কথা শুনে থমকে গেল। কী সুন্দর! একটা কথা তিনি কত সহজে বলে দিলেন। আর তাকে লোকজন দেখতে এসেছে, মানেটা বুঝে উঠতে পারল না সায়ান। যাইহোক সে বাইরে যাওয়ার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হয়ে উঠল। তবে তার ছোট্ট বুকের ভেতর ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নটি তার দাদিকে করে বসল আগে, দাদি আম্মা, এ ঘরগুলো এমন কেন? আর এগুলো কিসের গাছ এভাবে দেয়া, গাছগুলো যদি ভেঙে যায়? প্রশ্নটি শুনে সায়ানের দাদি একেবারে স্থির হয়ে গেল যেন স্রােতশীল জলের জমাট রূপ। কারণ এ বাড়িতে আসার পর, নাতির মুখে এই প্রথম কোন প্রশ্ন শুনল সে। তার ভেতরের বরফ গলে সায়ানের প্রশ্নের উত্তর বেরিয়ে আসতে লাগল, ও দাদা বলে তাকে আবার বুকের মধ্যে জড়িয়ে বলল, শুনো এগিন মিঠন প্রেসিডেন্টের আমলের ঘর। তহুন ব্রিটিশ আমল। সায়ান এবার তার দাদির স্পর্শের উষ্ণতা অনুভব করছে। সারা দুনিয়ার কত কিছুই তো সে দেখে রোজ। কত জায়গাতেই তো সে ঘুরেছে। সে ছুঁয়ে দেখেছে ঝর্ণার শুভ্রতা, সাগরের নীল জল, উড়োজাহাজের জানালায় সে মেঘকে দেখেছে কত কাছ থেকে… আরও কত কী! তবু আজকের এ অনুভব তাকে যা দিল, তা সে এতোদিন কোথাও পায়নি। পৃথিবীর কোন সার্চ ইঞ্জিন এ অনুভবকে খুঁজে এনে দিতে পারবে না। সায়ানের পাল্টা প্রশ্ন, প্রেসিডেন্ট? তার দাদি বলল, হ্যাঁ। আগের দিনের, মানে ব্রিটিশ আমলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের প্রেসিডেন্ট বলত। আর মিঠন প্রেসিডেন্ট হলো তোমার দাদারও দাদার নাম। তোমার দাদার বাবাও চেয়ারম্যান ছিল, পাকিস্তানিরা বাড়িতে শেল মারিছিল, সেই শেলের আঘাতেই তিনি মারা গেছেন। তারপরে এ বাড়ির আর কেউ চেয়ারম্যান হওয়ার চেষ্টা করেনি। তবে এলাকার মানুষজন তোমার দাদাকে এখনও মান্য করে। ও দাদা ভাই, এগিন হলো খয়ের গাছ। সহজে ভাঙে না।

ঘর থেকে বের হওয়া মাত্র পাড়ার মেয়েগুলো ঘিরে ধরল। কেউ তাকে জড়িয়ে ধরছে। আবার যে জড়িয়ে ধরার চান্স পাচ্ছে না, সে তার গালে-কপালে হাত ছোঁয়াচ্ছে- তারপর তারা চুমো খাচ্ছে সেই হাতে। কেউ কেউ তাকে কলা-পাকা পেঁপে এরকম কিছু ফলও উপহার দিল। তাদের আচরণে সায়ান অবাক! মেয়েগুলোর কাছ থেকে ছাড়া পেলে- তার দাদি তাকে পুকুর ঘাটের দিকে নিয়ে গেল। পুকুরে জাল টেনে মাছ ধরার চেষ্টা চলছে। তার দাদা-বাবা-মা- সবাই সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। পুকুরের পাড় জুড়ে জোড়া জোড়া খেজুরের গাছ, সটান দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চারপাশে নানান জাতের জংলি গাছগাছালিতে ভরা। সায়ান তার দাদিকে এটার ওটার নাম জিজ্ঞেস করছে, তার দাদি বলছে, সে শুনছে, আবার ভুলেও যাচ্ছে। তার জীবনে এই প্রথম শোনা এসব গাছগাছালির নাম। তবে সায়ান একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝতে পারছে, এ বাড়ির আঙ্গিনায় বোধ হয় আগাছাকেও তেমন একটা শাসন করা হয় না। বর্ষার বৃষ্টিতে লতিয়ে উঠেছে সবাই।
এখান থেকে তার দাদাকে দেখা যাচ্ছে। তিনি বাঁশের তৈরি একটি মোড়াতে বসা। বাকি সবাই তার চারদিকে দাঁড়ানো। পুকুরে জালের বেড়ের মধ্যে আটকা পড়েছে অনেকগুলো মাছ। তারা ভীষণ লাফালাফি করছে। মূলত মাছগুলো কেউ পানির কাছ থেকে আলাদা হতে চাইছে না। যারা লাফ দিচ্ছে- তাদের দু-একজন চলে যাচ্ছে জালের বেড়ের বাইরে। আর কেউ কেউ আবার ঘুরে গিয়ে পড়ছে ঐ জালের মধ্যেই। এগুলো দেখতে দেখতে সায়ান তার দাদার কাছে পৌঁছাল। দাদা তার হাত ধরে তাকে কোলের মধ্যে বসিয়ে বলল, ইয়েস, ইয়াং ম্যান। হাউ আর ইউ নাও। দাদার কোলটাকে এখন তার রাজা-বাদশার সিংহাসন মনে হচ্ছে। সে তার দাদাকে বলল, ফাইন, অ্যান্ড আই ওয়ান্ট টু ব্যাক হেয়ার। ইটস্ এ গ্রেট কানেকশন।

Share.

মন্তব্য করুন