টুনটুনি নামটা শুনলেই ভেসে ওঠে তাদের নাচানাচি। ডালে ডালে পাতায় পাতায় কতো দেখেছি! বেশি দেখা যায় লুকোচুরি খেলায়। একথা এভাবেই বলা যাক-
টুনটুনি ও টুনটুনি
বলাবলি মেলা খেলি
পলাপলি খেলা খেলি
থামাও তোমার গুণগুনি!
আচ্ছা! নাচো টুনটুনি
ওই ঝুপেতে জামি রুমি
এই ঝুপেতে আমি তুমি
থাকো দেবো ঝুনঝুনি।
এভাবেই টুনটুনিকে নিয়ে অনেক কিছুই ভাবা যায়! তাই টুনটুনি কেমন, কেমন তার স্বভাব-বুদ্ধি ইত্যাদি না জানলে কি চলে! জানা ভালো। জানা দরকার।
টুনটুনি বাংলার সবচেয়ে ছোট পাখি! বিশ্বে মোট ১৫ প্রজাতির টুনটুনি পাওয়া যায়। আমাদের বাংলাদেশ ও ভারতে রয়েছে তিনটি প্রজাতির টুনটুনি। তারা হলো- কালাগলা টুনটুনি, পাহাড়ি টুনটুনি ও পাতি টুনটুনি। এরা কখনো চালাক কখনো বোকা। একই সাথে বোকা ও চালাক পাখি বাংলায় খুব কম আছে। বোকা বলি এই কারণে- বিপদ দেখার সাথে সাথেই চেচামেচি করে। ফলে সহজেই শত্রুর কবলে পড়ে। আর তার চালাকি বা বুদ্ধির পরচিয় হলো- বাসা বাঁধা ও পাতার আড়ালে লুকিয়ে যাওয়া। কখনো এদের শব্দই শুনা যায়, দেখা যায় না। তবে বেশি বুদ্ধি ও চালাকের পরিচয় পাওয়া যায় তার বাসা বুননে। গাছের দু-তিনটা তরতাজা পাতাকে তারা টার্গেট করে। ঠোঁট দিয়ে পাতাগুলো সেলাই করে। এই জন্যে তাদেরকে দরজি ও কারিগর পাখি বলা হয়। ইংরেজীতেও তাকে Teilor bird বলে। ওরা Sylviidae পরিবারের অন্তর্গত। তাই বৈজ্ঞানিক নাম: Orthotomus.
তারা সেলাই করার জন্য বাজার থেকে কাটিন সোতা আনে না। মাকড়সা জালের রেশমি সুতা ও গাছের আঁশ ব্যবহার করে। তাদের সুন্দর ঠোঁট তখন হয় সুঁই। এই সুঁই সোতা দিয়ে পাতা সেলাই করে ঘর বানায়। আমরা তাকে বলি বাসা। এই বাসাকে মজবুত করতে তুলাও ব্যাবহার করে। ভেতরে আরামদায়ক করার জন্য কাশফুল ঘাসফুল ইত্যাদি সুন্দরভাবে কাজে লাগায়। এতো সুন্দর বাসা বানানোর বুদ্ধি এরা পেলো কোথায়! আসলে তিনিই তাদের এমন বুদ্ধি দিয়েছেন। টুনটুনির বাসা খুব বেশি উচুতে হয়না। সাধারনত এরা ৬-১০ সেমি উচ্চতায় বাসা বাধে। ছোট গুল্ম জাতীয় গাছ অথবা ঝোপঝাড় এদের প্রধান পছন্দ। শিম, লাউ, কাঠ বাদাম, সূর্যমূখী, ডুমুর, লেবু ও মেহগনি গাছে এরা বেশি বাসা বাধে। পুরুষ ও স্ত্রী পাখি মিলে বাসা তৈরী করে। বাসা বানাতে এদের সময় লাগে ৩-৫ দিন। বাসা তৈরীর ২/১ দিন পর বাদামী ছোপওয়ালা ৩-৪ টা ডিম পাড়ে। ১৪-১৫ দিনেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। মা-বাবা ঠোঁট দিয়ে ডিমের খুশা বাইরে ফেলে। এতে বাচ্চাদের চলা ফেরা সহজ হয়। টুনটুনি বাচ্চারা খুব লক্ষী। বড় হলে মা-বাবা বাইরের জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে যায়। তারপর বাচ্চার একাই আরো বড় হতে থাকে। বড় বড় হতে মাতিয়ে তুলে আমাদের সকলের মন।

বিভিন্ন পোকা ও বিছার জন্য আমাদের কষ্ট হয়। এক্ষেত্রে তারা উপকার করে। বড়িগাছ বা আমপাতা জামপাতার বিছা পোকা ওদের প্রিয় খাবার। ধান-পাট-গম পাতার পোকাও পছন্দ করে। এদিক দিয়েও সে আমাদের উপকারি বন্ধু। এছাড়া এরা বিভিন্ন রকম খাবার খায়। আরো অনেক অপকারী পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ খাদ্য হিসেবে খায়। তাছাড়াও ছোট কেঁচো, মৌমাছি, ফুলের মধু, রেশম মথ ইত্যাদি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। শুয়োপোকা আর তার ডিমও তাদের খাদ্য তালিকায় আছে।
এসো- এই উপকারী পাখি আরেকটু দেখে নেয়া যাক! টুনটুনির বুক ও পেট সাদাটে। অনেকটা মাটির ঢিলার মত। ডানার উপরিভাগ জলপাই-লালচে। মাথা জলপাই-লালচে। চোখের মণি পাকা শুকনো লাল মরিচের মত। বুক সাদা পালকে ঢাকা। লেজ খাড়া, তাতে কালচে দাগ আছে। ঋতুভেদে পিঠ ও ডানার রঙ কিছুটা বদলায়। শরীরের মাপ ১২ সেন্টিমিটারের একটু বেশি। শরীরের সমান লেজটা দুই ভাগ করা, আগা সুচের মতো ধারালো। যখন তখন তাদের গান শুনা যায়। ফাল্গুন মাসে বাসা বাধার সময় গান বেড়ে যায়। তবে বাসা বানানো, ডিম পাড়া ও বাচ্চা ফোটানোর খুশিতে বেশি গান গায়। টুনটুনির গান যে একবার শুনেছে সে কখনো ভোলে না! ভোলতে পারে না। ভোরে ওরা সবার আগে ওঠে। তখন খুব তীব্র স্বরে পিঠে লেজ উচিয়ে ডাকে। আসলে সব উপকারারী ও পরিবেশ বান্ধব পাখিরা ভোরে ওঠে। একদিন দুদিন নয়! প্রায় প্রতিদিন। টুনটুনিরা বা পাখিরা ভোরে না ওঠলে যেনো সকালই হয় না! আমাদের প্রিয় জাতীয় কবি- কাজী নজরুল ইসলাম তো একথাই বলেছেল। বলেছেন-
আমরা যদি না জাগি মা
কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে ওঠবে মাগো
রাত পোহাবে তবে।

এইসব পাখিদের মতো চঞ্চল মন আর বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে হলে ভোরেই জাগতে হবে। ভোরে জাগলে মন ও দেহ উজ্জীবিত হয়। উজ্জীবিত মনের কারনেই টুনটুনিরা ভোরে ডাকে। শুধু কী ডাকে নাচি নাচি ও আনন্দ করে! কী তাদের মতো আমারাও জাগতে পারবো না! অবশ্যই পারবো, পাখিরা পারলে আমরা মানুষ কেন পারবো না!

Share.

মন্তব্য করুন