আরিফ ছোট খালার বাসায় ঢুকেই ড্রয়িং রুমে দেখতে পেলো ফ্যান হুকের সাথে দড়িতে একটি মোজা বাঁধা। সে অবাক হয়ে মোজাটি ধরে বললো, এর ভেতর দেখি বল ভরা! তা এটা বেঁধেছে কে? খালার কাজের মেয়েটি হাসি মুখে বললো, এটা শাকিব ভাইয়ার বল। শাকিব ভাইয়ার বল। শাকিব ভাইয়ার আরেকটি ভাই থাকলে তো শাকিব ভাইয়া তার সাথে খেলতো। ভাইবোন নাই, একা একা তাই এইভাবে বলটারে বাইনদা ব্যাট দিয়া ঠাস্ ঠাস্ কইরা পিটাইয়া খ্যালে।
তেরো চৌদ্দ বছরের আরিফ, শাকিবের খালাতো ভাই। আসমার কথায় খুব মজা পেলো। বললো, খুব ভালো বলেছো তো! এটা এখনো আমার মাথায় আসেনি। তাহলে আমিও ওর মতো বয়সে এভাবে খেলতে পারতাম। তা কোথায় শাকিব, ওকে ডাকো তো!
শাকিব ভাইয়া এখন স্যারের কাছে পড়া শিখতাছে।
আর খালাআম্মা খবরের কাগজ পড়ে। আমি পিপ হোল দিয়া আপনারে দেইখা দরজা খোলার আগেই খালাম্মারে কইছি, আপনে আইছেন।
স্যার চলে গেলে, মোজায় বাঁধা বলটিকে ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে পরপর আরিফ, শাকিব দু’জন অনেকক্ষণ ধরে নিজেদের শরীর চর্চা করলো। তারপর বিশ্রাম নিতে নিতে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া শাকিব তার অষ্টম শ্রেণীর খালাতো ভাইটিকে হেসে বললো, আরিফ ভাইয়া, এক কাজ করো…
আরিফ শাকিবের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, কী?
শাকিব বললো, আরিফ ভাইয়া, এরকম একটা বল তোমার ঘরে বেঁধে রাখলে তোমার খুব কাজ দেবে!
: কেমন করে?
: তুমি কেমন মোটা হয়ে যাচ্ছো।
: খুব পেকেছিস, না? চল্, বলটা খুলে নিয়ে তোদের ছাদে যাই!
: মা ছাদে বল নিয়ে যেতে দেবেন না।
: তুই ভাবিস না ছোটো খালামনিকে আমি বলবো।
আরিফ তার ছোট খালামনিকে বুঝিয়ে এক হাতে বল, আর আরেক হাতে শাকিবকে একেবারে ধরে ছাদে নিয়ে গেলো। চারদিকে রেলিং দেয়া বেশ বড় ছাদ। তবু হাত ফস্কে এক সময় বলটি চলে যায় পাশের বাড়ি।
পাখা গজানো পায়ের মতো ছয় তলার সিঁড়ি বেয়ে দপাদপ দু’ভাই যেনো উড়ে উড়ে নিচে নামে। কিন্তু পাশের বাড়ির গেটে গিয়ে থমকে যায় তারা। বাঘের মতো ভয়ানক গম্ভীর গেটটি বন্ধ। গেটের একটুখানি ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে দারোয়ান ঝিমোচ্ছে। তার ইয়াবড় পাকানো গোঁফ দেখে দু’জনেরই গলা বুজে আসলো। ওরা কেউ-ই ডেকে বলতে পারলো না, দারোয়ান চাচা, আমাদের বলটা ছিটকে এই বাড়িতেই পড়েছে। হ্যাঁ, আমাদের চোখের সামনেই পড়েছে। আপনি গেটটি একটুখানি খুলে দিলে আমরা বলটা নিয়ে যেতে পারি।
খুব মন খারাপ করে আরিফ আর শাকিব বাসায় ফিরে আসে। তারপর শাকিবের মাকে দু’জন ঘটনাটি একসাথে বলে, কেমন করে বলটা পড়ে যায়। আর কেমন করে ওরা ওই বাড়ির গেট পর্যন্ত গিয়ে ও বল নিয়ে ফিরে আসে। কিন্তু মা আর কী করবেন!
পাশের দোতলা বাড়িতে মালিক একা তাঁর পরিবারসহ থাকেন। কোনো ভাড়াটিয়া থাকেন না। তাই যখন তখন গেটও খোলা হয় না। বয়স্ক রাগি এক দারোয়ান সারাক্ষণ বন্ধ গেটের এপাশে একখানা লাঠি নিয়ে বসে থাকে। কারণ বাড়ির ভেতর অনেক রকম ফল ও ফুলের গাছ আছে। প্রায়ই কাগজ কুড়ানো ছেলেমেয়েগুলো দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকতে চায়। ভয় দেখিয়ে তাদের তাড়াতে হয় বলে লাঠিখানা সে কখনো হাতছাড়া করে না।
সূর্য প্রায় ডুবে আসছে। একটি বলের জন্য দু’জনের মন খুব খারাপ। তা ছাড়া আরিফও অনেক দূর তাদের বনানীর বাসা থেকে এই শান্তিনগর খালার বাসায় এসেছে। আগামীকাল শুক্রবার তারপর শনিবার। এই দু’দিন জমিয়ে শাকিবের সাথে খেলবে বলে এসেছে।
শাকিবের আম্মা আরেকটি বলের দাম দিচ্ছিলেন। এমন সময় দশ-এগারো বছরের আসমা বললো, খালাআম্মা, আমি ইকটু যাই ভাইয়াগো লইয়া, দারোয়ান চাচারে কইয়া দেখি…।
: দারোয়ানকে বলবি মানে? তুই কি ওকে চিনিস্ নাকি?
: আমাগো একটা জিনিস তাগো বাড়িতে গিয়া পড়ছে, একটা হক কথা কমু, এইটার লাইগা আবার আগে চেনোনের দরকার লাগেনি? আমারে যাইতে দ্যান খালাম্মা!
: না থাক, ওই কয় টাকার বল…
: টাকাটা তো বড় কথা না খালা আম্মা, এমনি কইরা নিজের জিনিস ছাইড়া দিলে ভাইয়ারা তো ভিতু অইয়া যাইবো! এইটা আপনে অইতে দিবেন ক্যান?
: এই তুই থাম তো!
আরিফ বেশ মজা পেয়ে যায় আসমার কথায়। তার মনে একটু সাহস এসে ভর করে। সে ছোট খালাকে বললো, আচ্ছা খালামনি, আসমার সঙ্গে আমরা যাই। দেখি ও যা বলেছে, ঠিকই বলেছে।
জবুথবু আসমা তার রঙিন ওড়নার কোনাটি আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে ওদের আগে আগে যাচ্ছে। আরিফ, শাকিব দু’ভাই এক সাথে তার পথ ছেড়ে দিচ্ছে। যেনো আগে যেতে তার কোনো অসুবিধা না হয়। গেট থেকে আরিফ, শাকিব একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকলো। আর আসমা গিয়ে অসীম সাহসে বিশাল গেটটিতে মৃদু টোকা মারলো। তাতেই ভেতর থেকে হেড়ে গলায় দারোয়ান বললো, কে?
আসমা কোমল স্বরে বললো, আমি! চাচা আমি পাশের বাড়ি থেইকা আইছি। আমার নাম আসমা! আসমা খাতুন…।
গেট একটু ফাঁক হতেই আসমা জিরাফের মতো মুখ বাড়িয়ে খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, চাচা, আমাদের বাসার দুইটা ভাই আমাগো ছাদে বল খ্যালতে গিয়া আপনেগো বাসার ভিতরে বলটা ফালাইয়া দিছে। …না, ফালাইয়া দেয় নাই। বলটা লাফাইয়া আইছে। আমরা সেই বলটা খুইজ্জা লইতে আইছি। আমাগোরে ইকটু ঢুকতে দিবেন চাচা?
চোখের পাতায় যেটুকু ঘুম লেগেছিলো, বোধ হয় আসমার সাহস দেখে চলে গেলো। দারোয়ান চাচা চোখ বড় করে আসমাকে দেখতে লাগলো। তারপর একটু ধমকের সুরে বললো, কোন বাড়ি থেইকে আইছোস্ কইলি?
আসমা আঙুল উঁচিয়ে পাশেই তাদের বাড়িটি দেখিয়ে দিলো। এবার দারোয়ান বললো, দ্যাখ খুঁইজা। যদি পাস্!
নিজে ঢোকার অনুমতি পেয়ে আসমা পিছন ফিরে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আরিফ, শাকিবকে বললো, আসেন ভাইয়ারা…। ওরা ভয় ভুলে লাফিয়ে আসমার পিছন পিছন ঢুকে পড়ে বাড়িটির ভিতরে।
দারোয়ান, থতমত খেয়ে চেঁচিয়ে বললো, আরে আরে আমি তো শুধু তোরে আইতে কইছি!
আসমা বললো, তিনজনে মিললা খুঁজলে তাড়াতাড়ি পাইয়া যামু চাচা!
সত্যিই খুব বেশি সময় লাগলো না বলটি খুঁজে পেতে। আরিফ বললো, একটা বল আজ আমাদের কেমন একটা শিক্ষা দিলো দেখ!
শাকিব বললো, আসমাও কিন্তু আমাদের কম শিক্ষা দেয়নি ভাইয়া!
আরিফ বললো ঠিক বলেছিস! এখন থেকে রোজ এক ঘণ্টা পড়ানোর দায়িত্ব তোর। বই খাতা আমি কিনে দিয়ে যাবো।
শাকিব বললো, আচ্ছা!

Share.

মন্তব্য করুন