জলবায়ুর পরিবর্তন মানব স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য আতঙ্কের খবর। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বিপন্ন পরিবেশ মানব স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য যে হুমকিস্বরূপ তা গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু দূষণ, পরিবেশ বিপন্ন, গ্রিনহাউজ এফেক্ট, বিপন্ন পৃথিবী, ওজোনস্তর ক্ষয়ে যাচ্ছে বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ব্যাপক লেখালেখি চলছে। এ বিষয়টির ওপর কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট আলগোর নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন।

বিশ্বব্যাপী পরিবেশ নিয়ে কাজ চললেও তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সুফল ঘরে আসেনি। যার ফলে দেখা গেছে সুনামির আঘাত, যুক্তরাষ্ট্রে পরপর কয়েক বছর প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ২০০৩ সালে ইউরোপে ৪৪ হাজার মানুষ হিট ওয়েভে মৃত্যুরমত মানবিক বিপর্যস্ত ঘটনা।

আমাদের দেশে ১৯৮৮, ১৯৯২, ১৯৯৮ সালে ভয়াবহ বন্যা, ১৯৯১ সনে ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালে সিডর, ২০০৯ সালে আইলা ও গত বছর আম্পান বিশ্বের পরিবেশবিদদের ভাবিয়ে তোলে। গত কয়েক বছরের গরম ও শীতের তীব্রতা আমাদের উদ্বিগ্ন করছে।
দূষিত বাতাসে আমরা প্রতি ৪ সেকেন্ডে একবার শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করি। প্রতিদিন প্রায় ২৩ হাজার বার শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করছি। পরিমাপে প্রতিদিন প্রায় ৩৬ পাউন্ড শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে। বিভিন্ন কারণে প্রতিদিন বায়ুদূষণের ফলেই সৃষ্টি হচ্ছে গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধি। ফলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এতে করে আমাদের শরীর স্বাস্থ্য অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

যেভাবে জলবায়ু দূষিত হচ্ছে
বাণিজ্যিক কল-কারখানা ও পরিবহনের নিঃসৃত বিষাক্ত কালো ধোঁয়ার সাথে কার্বন মনো-অক্সাইড শহরের বাতাসে ভেসে বেড়ায়। কার্বন মনো-অক্সাইড রক্তের হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে অক্সিজেনের চেয়ে ২০০ গুণ বেশি মেশার ক্ষমতা রাখে। এই গ্যাসের উপস্থিতিতে হিমোগ্লোবিন থেকে অক্সিজেন সরিয়ে নিজে স্থান দখল করে নেয়া, ফলে রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দেয়। বর্ণহীন, গন্ধহীন বিষাক্ত এ গ্যাস গাড়ির গ্যারেজ, গাড়ির টারমিনাল, গাড়ির ভেতর ও গাড়ির পেছনে মুক্ত বায়ুতে স্বাভাবিকভাবে ১০০ পিপিএম থাকে। ২০০ পিপিএম থাকলে অবসন্নতা, ঘুম ঘুম ভাব, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এটি গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

ইটভাটা, শিল্প-কারখানা, রান্না ঘরের ধোঁয়া থেকে সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, হাইড্রো কার্বন ইত্যাদি যুক্ত হয়ে মুক্ত বাতাস দূষিত করছে। যা পরবর্তীকালে গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।
ফ্রিজ, এ/সি থেকে ক্লোরফ্লুর কার্বন নিঃসরণ ঘটায় বা জলবায়ু দূষণ ঘটে।
পেট্রোলিয়াম শোধনাগার, পেইন্ট, চামড়াশিল্প, সিমেন্ট কারখানা, সারকারখানা, লৌহ ও ইস্পাত কারখানা, প্রসাধনী কারখানা, খাদ্য প্রস্তুত কারখানা প্রভৃতি থেকে প্রতিনিয়ত দূষিত গ্যাস বায়ুমণ্ডলে মিশে গিয়ে পরিবেশ দূষণ করছে। রাজধানীর চারপাশে ও আশপাশের জেলার শত শত ইটভাটার দূষিত বায়ু মহানগরকে তপ্ত করছে।

আমাদের ঢাকা মহানগরীর সড়কের দু’ধারে মাটি/ধুলাবালির স্তর জমে থাকে সব সময়। গাড়ি চলাচলের সময় ধুলাগুলো বাতাসে ভাসতেই থাকে। ফলে তা ১৫-২০ তলা ফ্ল্যাট বাড়িতেও ঐ ধুলার স্তর পৌঁছে যায়। ধুলার কুয়াশায় ঢেকে থাকে যেন ঢাকা মহানগরী। এতে ঢাকা মহানগরীর এক কোটি মানুষের অধিকাংশ কোন না কোন রোগে ভুগতেই থাকে। রাজধানীর পাকা রাস্তা ধূলিমুক্ত রাখার যোগ্যতা এখন পর্যন্ত কোন মেয়র অর্জন করেনি।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর প্রায় ২০০ কোটি নগরবাসী দুই-তৃতীয়াংশ সালফার ডাই-অক্সাইড ও বাষ্পবাহিত বস্তু বাতাসে বসবাস করছে। আমরা বহু বছর থেকেই শুনে এসেছি ঢাকা মহানগরী বিশ্বের সবচেয়ে বায়ুদূষণ সমৃদ্ধ নগরী।
বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রিয় পৃথিবীকে বেষ্টন করে রয়েছে যে বায়ুস্তর সেই বায়ুস্তরে বৃদ্ধি পাচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, সিএফসি প্রভৃতি গ্যাসে এবং সূর্যের রশ্মি যখন পৃথিবী থেকে বিকিরিত হয়ে মহাশূন্যে ফিরে যেতে চায় তখন ওইসব গ্যাস তাপ শোষণ করে। স্বাভাবিক উষ্ণতা পৃথিবীকে গরম রাখে যা পৃথিবীকে বসবাস উপযোগী করে রেখেছে কিন্তু মানুষের কর্মতৎপরতা ওই গ্যাস স্তরকে বাড়িয়ে তুলছে। এতে উষ্ণতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে পৃথিবীর দুই মেরুর বরফ গলে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। সাগরের পানির স্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আরও বৃদ্ধি পাবে। এই ক্রম উষ্ণতার কারণে রোগ-জীবাণুর জীবনচক্র পরিবর্তিত হচ্ছে নতুন নতুন জীবাণু মানুষকে এবং পশুপাখিকে সংক্রমিত করছে- যেমন বার্ডফ্লু।

বিপন্ন পরিবেশ মানব স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর
– তপ্ত জলবায়ুর ফলে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, কলেরা, ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত, খাদ্যবাহিত এবং বায়ুবাহিত রোগ বৃদ্ধি পাবে।
– দূষিত বাতাস গ্রহণে মানুষ বেশি বেশি শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমাসহ ক্রনিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
– মানব শরীর পুষ্টিহীনতায় আক্রান্ত হবে।

অপচয় ও অপব্যবহারে পরিবেশ দূষণ
মানুষ গ্রিনহাউজ গ্যাস উৎপন্নতে সরাসরি জড়িত। প্রধানত, ফসিল ফুয়েলের মাধ্যমে অর্থাৎ কয়লা, জ্বালানি তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস প্রতিনিয়ত ব্যবহার করার মাধ্যমে গ্রিনহাউজ এফেক্ট করছে। যত বেশি ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার বাড়বে তত বেশি এফেক্ট হবে সুতরাং অন্তত অপব্যবহার বা অপচয় রোধ করতে হবে। গ্যাস, বিদ্যুতের অপচয় ও অপব্যবহার এবং এসব জ্বালানি থেকে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী ব্যবহারে অপচয় রোধ করা জরুরি যেমন আপনি যদি সারারাত অকারণে কোন বিদ্যুৎ বাতি জ্বালিয়ে রাখেন তবে ঐ পরিমাণ বিদ্যুতের জন্য ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার বাড়বে। ফলে গ্রিনহাউজ গ্যাস উৎপন্নতে আপনি দায়ী থাকলেন অথবা কম্পিউটার থেকে কোন লেখা প্রিন্টারে প্রিন্ট করার সময় বা ফটোকপি করার সময় অসতর্কভাবে যত কাগজ নষ্ট করলেন তত বিদ্যুৎ ও কালি অপচয় হবে, তত ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার বাড়বে পৃথিবী তত গরম হবে। সড়কের লাল বাতিতে গাড়ি চালু রাখলে ফসিল ফুয়েল ব্যবহার বাড়বে। এ থেকে উৎপাদিত যত সব পণ্য রয়েছে তার ব্যবহারে আপনাকে মিতব্যয়ী হতেই হবে। মহানবী সা:-এর হাদিসে উল্লেখ আছে অপচয়কারী শয়তানের ভাই। প্রতিটি মানুষকে সতর্ক হতে হবে, কোন কাজ মানুষ, সমাজ, বিশ্বের জন্য ক্ষতির তা থেকে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে নগরায়ণের মাধ্যমে গাছপালা কেটে ফেলছে, ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড (ঈড়২) বেশি মাত্রায় থেকে যাচ্ছে। রাসায়নিক সার ও রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ।

এবার প্রতিকারের উপায়
– এমন যানবাহনের চেষ্টা চলছে যাতে অল্প জ্বালানিতে বেশি পথ অতিক্রম করে যেমন এক গ্যালনে ৫৬ মাইল চলবে।
– সোলার এনার্জি (সূর্যের তাপ শক্তি) মাধ্যমে ঘর-বাড়ির বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ এবং গাড়িতে স্থাপন যাতে সোলার এনার্জিতে গাড়ি চালানো যায়।
– বাতাসের শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা বাড়ানো- প্রভৃতি কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া। এনার্জি বাল্ব ব্যবহার করা। বাড়িতে, কর্মস্থলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অপচয় কঠোরভাবে রোধ করা। গ্যাস, বাতি, এসি প্রয়োজনের পরপরই বন্ধ করে দেয়া। অত্যাবশ্যক ছাড়া গাড়ি ব্যবহার না করা। সপ্তাহে দু’দিন গাড়ি না চালান। হাঁটাচলার অভ্যাস করা এবং বাইসাইকেল ব্যবহার করা।
– প্রচুর পরিমাণে গাছ রোপণ করা, মাঠে-ঘাটে পথের ধারে, ব্যাপক গাছ রোপণের উদ্যোগ নেয়া। ব্যক্তি উদ্যোগে, সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নিয়মিত বৃক্ষরোপণ অভিযান চালু রাখা এবং এ ধরনের কার্যক্রমকে পুরস্কৃত করা।

পরিশেষে বলতে চাই এই পৃথিবী আমাদের। সৌরজগতের অন্য কোন গ্রহে প্রাণী আছে কি-না এখনও জানা যায়নি। লক্ষ-কোটি গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্যে একটি প্রাণীসমৃদ্ধ গ্রহকে কি আমরা বাস উপযোগী করে রাখতে পারব না? অবশ্যই পারা উচিত। জলবায়ুর পরিবর্তন রুখতে আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ অবস্থান থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। কে করলো কে করলো না সেটা না দেখে আমি করলাম কিনা সেটাকেই গুরুত্ব দিতে হবে। কলটা বন্ধ করলাম কিনা, ঘর থেকে বেরুনোর সময় ঘরের সুইচগুলো বন্ধ হলো কিনা, গ্যাসের চুলা বন্ধ করেছি কিনা, টিভি, কম্পিউটার, এ/সি, প্রিন্টারের সুইচ বন্ধ হয়েছে কিনা যার যার দায়িত্ববোধ থেকে পালন করা উচিত। যত বেশি কাপড়, কাগজ, ব্যবহার্য পণ্য ব্যবহার করবো বা অপচয় করবো তত বেশি উৎপাদন বাড়াতে হবে, এতে তত বেশি বিদ্যুৎ, গ্যাস, তেলের ব্যবহার বাড়বে এবং উষ্ণতা বাড়বে। অতএব আসুন সবাই মিলে মিতব্যয়ী ও সংযমী হই। শীতল সুন্দর নির্মল বাতাসের মুক্ত পৃথিবী গড়ে তুলি।

Share.

মন্তব্য করুন