ফররুখ ছিলেন স্বচ্ছ কবি, সাচ্চা দিলের ভাব
থাকতো না’ক খুঁত কখনো, যেনো কচি ডাব
স্বচ্ছ যেমন ডাবের পানি, পান করতে ভালো
তাঁর কবিতা ঠিক তেমনি, চাঁদ ঝলমল আলো

হ্যাঁ, সত্যিই! তার হৃদয় ছিল স্বচ্ছ ও নিখুঁত। উন্নত মনের জ্যোতিই যেন ছড়িয়ে পড়তো তাঁর লেখনীতে। সন্ধ্যা রাতের জোছনা দেখে আমরা শিশুরা চাঁদের দিকে তাকিয়েছি। কখনো হাঁটার সাথে চাঁদকে হাঁটাতাম। ঠিক তেমনি ফররুখের ছড়া কবিতাও চাঁদের মতো জোছনার মতো টানছে। পড়তাম। পড়ার সাথে সাথে পাশের চিত্রকেও মনোযোগ দিয়ে দেখেছি। সবচেয়ে বেশি দেখেছি-পড়েছি ‘ঝুমকো জবা’। তখন শিশুদের প্রথম পাঠেই ফররুখের এই বিখ্যাত ছড়াটা ছিলো। বারবার পড়তে পড়তে ঠোঁটস্থ হতো। এখনও সে লোভ সামলাতে পারছি না! আবারও পড়ছি-
ঝুমকো জবা বনের দুল
উঠল ফুটে বনের ফুল।
সবুজ পাতা ঘোমটা খোলে,
ঝুমকো জবা হাওয়ায় দোলে।
সেই দুলুনির তালে তালে,
মন উড়ে যায় ডালে ডালে।
আহা, দারুণ কথা! আমাদের মন যদি ফুল হয়। তাহলে তো মন উজ্জীবিত উচ্ছ্বসিত হবেই। এমন মন থেকেই আসে নতুন ভাবনার নতুন কল্পনার সৌরভ। নতুন ভাবনা ও কল্পনা বেশি থাকে শিশুদের। হাজারও কল্পনার ডালে ডালে ঘুরে। শিশুমন মাঠে ঘাটে নদীসহ কত্ত জায়গায় ঘোরে! ঘুরতে ঘুরতে সহজেই দেখা মেলে বকের। কখনও বৃষ্টি হলে বকেরা থাকে না। কেন থাকে না? সেই প্রশ্নটা শিশু মনে বেশি জাগে। এই বিষয়টা কবি যেন তুলে ধরেছেন এভাবে-
‘বৃষ্টি এল কাশ বনে, জাগল সাড়া ঘাস বনে,
বকের সারি কোথা রে, লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে।’
হাজারও বিষয় ফররুখের ভাবনায় সাড়া দেয়। বাদ যায়নি নদীও। বাদ যায়নি বনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোনো ফুলও। যেমন তিনি লিখেছেন-
নদীতে নাই খেয়া যে, ডাকল দূরে দেয়া যে
কোন সে বনের আড়ালে, ফুটল আবার কেয়া যে।
শুধু কি বৃষ্টি বাদলের দিন! বৃষ্টিহীন ঝিমিয়ে পড়া দিনও তিনি দেখেছেন আপন মনে। এমন দিনে ঘরে থাকলে মন স্থবির হয়ে যায়। হয়ে যায় নিস্তেজ। অলসতাও চাপিয়ে পড়ে জগদ্দল পাথরের মতো। শিশুরা চির চঞ্চল। দুরন্ত। ঝিমিয়ে থাকার বয়স নয় সেটা। এ দিকেই ইঙ্গিত করে কবি বলেছেন-
আয় গো তোরা ঝিমিয়ে পড়া দিনটাতে
পাখির বাসা খুঁজতে যাবো একসাথে।

শিশু কোলাহল পছন্দ করে। গ্রামের মাঠে শিশুরা একসাথে খেলাধুলা করে। শিশুদের পাখির বাসা খোঁজাও এক ধরনের দারুণ খেলা। সে রকম আরো অনেক খেলা আছে। আছে কানামাছি বৌ-ছি ইত্যাদি খেলাও।
অপরের দয়ায় যারা বেঁচে থাকতে চায় তারা কখনো কাক্সিক্ষত জায়গায় যেতে পারে না। হতে পারে না মহৎ মানুষ। হতে পারে না সুখীও। তাই ছোটদের স্বনির্ভরতার ডাক দিয়েছেন কবি। আর সে ডাকটি পাওয়া যায় রূপক ছাড়া ‘চড়–ই পাখির বাসা’য় :
চড়–ই পাখি চালাক তবু ভাই
নিজের বাসার ঠিক ঠিকানা নাই,
পরের দালান বাড়ি খুঁজে, থাকে সে তার মাথা গুঁজে
সবাই তাকে খারাপ বলে, বলে যে দূর ছাই।
পরের দয়ায় বাঁচতে যারা চায়,
দুঃখ তাদের ঘোচানো যে দায়॥

পাখিদের নিয়ে লেখা সহজ নয়। খুব চিন্তা করতে হয়। কষ্ট করতে হয়। ফররুখ যথাযথভাবেই তা ফুটিয়ে তুলেছেন। কবির এ পরিশ্রম বৃথা যায় নি। ‘পাখির বাসা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। তার পরের বছর ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক ‘ইউনেস্কো পুরস্কার’ দেয়া হয় কবিকে।
কবি আল্লামা ইকবালের প্রিয় পাখি ‘শাহীন’ আর ফররুখের ‘ঈগল’। কবির প্রত্যাশা আমাদের শিশু-কিশোররা ঈগলের মতো স্বাধীন স্বভাব অর্জন করবে। সুস্বাদু পুষ্টিকর হালাল খাদ্য খাবে। আপন মনে ঊর্ধ্বাকাশ, নীল আসমানে উড়ে বেড়াবে। কবি চিড়িয়াখানায় ঈগল নামক ছড়ায় লেখেন :
উঁচু আশা ঈগল পাখির, সাহস ভরা বুক,
মুক্ত, স্বাধীন জীবনে তার নাই ভাবনা দুখ।
ফররুখ মাতৃভাষা বাংলাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন। সেই ভালোবাসার সুস্পষ্ট নিদর্শন কবির ‘হরফের ছড়া’ বইটি। বাংলা বর্ণমালাকে শিশুদের কাছে ছন্দে ছন্দে সুখপাঠ্য করে তোলার জন্য তিনি এ বইটি লেখেন। যেমন-
ঝ-য়ের পাশে ঝিঙে, ঝিঙে লতায় ফিঙে
ঝিঙে লতা জড়িয়ে গেলো, কালো গরুর শিঙে।
শুধু কি দেশ ও মাতৃভাষার প্রতি তার টান ছিল। ছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সভ্যতা সংস্কৃতির টানও। ছিল শ্রেষ্ঠ শাশ্বত গভীর বিশ্বাসের প্রকাশও। তাঁর ভাষায়-
তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে, খোদার মদদ ছাড়া
তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে, নিজের পায়ে দাঁড়া।
আসলে কবি ফররুখ আহমদের ছড়া কবিতা পড়লে মনের ভেতর একটা জগৎ তৈরি হয়। সেই জগৎ শ্রেষ্ঠভাবে বেঁচে থাকার জগৎ। তার লেখায় দেশ ও মাতৃভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ভালোবাসার উৎসাহ পাওয়া যায়। পাওয়া যায় বিশ্বাসী মুক্তির চেতনায় নিজের অস্তিত্ব। তাই তো বলতে বাধ্য হয়-
স্বচ্ছ কচি ডাবের গায়ে, হাসে সবুজ বেশ
তাঁর ছড়াতে ঠিক তেমনি ভাসে আমার দেশ
ডাবের ভেতর আছে যেমন, শুভ্র কোমল শাঁস
তাঁর ভেতরে ছিল তেমন, দ্বীনের অভিলাষ।
এ মাসের ১০ তারিখ, অর্থাৎ ১০ জুন বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ এই কবির জন্মদিন। আমরা আমাদের প্রিয় কবির আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তাঁর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

Share.

মন্তব্য করুন