পরীক্ষা শেষ হতে আরো ঘণ্টাখানেক বাকি। তারপর ঘণ্টা বাজবে রজিম মিঞার। সময় যেন কাটছেই না সাবুর। লেখা শেষ হয়েছে, সাথে রিভিশন দেয়াও। কিন্তু হেড স্যারের নির্দেশ, শেষ ঘণ্টা বাজার আগে কেউ বেরুতে পারবে না।
গত দু’সপ্তাহ যাবৎ সাবু শুধু এ দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছে। কারণ প্রতি বছর বার্ষিক পরীক্ষা শেষেই কেবল নানুবাড়ি যাওয়া হয়। নানুবাড়িও কম দূরে নয়, সেই দূর শহরে কোথায় যেনো। সাবু পুরো ঠিকানা না জানলেও বলে দেয় শহরেই তার নানুবাড়ি। এ নিয়ে অবশ্য তার ভাবও কম নয়। তার মতে, তার গ্রামের অনেক বন্ধুরই এখনো শহরে যাওয়া হয়নি। আর সে প্রতি বছরই শহর ঘুরে আসে। সে চোখ বুজে ভাবে হরেক রকমের মানুষের দেখা, মেলার মতো ভিড় করে সবাই কাজে যাচ্ছে, মার্কেট-দালানকোঠা আরো কত কী। বন্ধুদের জন্য তার ভীষণ মায়া হয়। সাবু ভাবে, বড় হলে একদিন সে সবাইকে নিয়ে ঘুরতে যাবে।

এদিকে ঘণ্টা পড়ে গেলো, ঢং ঢং শব্দ শেষ হবার আগেই হুড়মুড় করে সবাই খাতা জমা দিয়ে দিলো। সাবু বাইরে এসে দেখলো সাত-আট জনের জটলা, তারই বন্ধু সব। পরীক্ষা শেষে হবার আনন্দে সবাই আত্মহারা। রাফির খালাবাড়ি চা-বাগানের আশপাশে। সপরিবারে বেড়াতে যাবে সবাই। এদিকে রামিম যাবে চাচার সাথে পার্বত্য এলাকায়, এ নিয়েই তার উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। দেখা গেলো, সবাই কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে। প্রায় অনেক দিন দেখা হবে না তাদের। কিছুটা মন খারাপ লাগলেও ছুটির সীমাহীন আনন্দের সাথে তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।
স্কুল থেকে বেরিয়ে বটগাছটার নিচে সবাই জড়োসড়ো হয়ে বসে বাঁধা বেড়িটার উপর। নিয়মমাফিক নাজিম মামার আইসক্রিম খাওয়া হবে। নাজিম মামা আধবয়সী হলেও বেশ রসিক মানুষ। গলায়-গলায় ভাব তাদের। গল্পের আসর জমিয়ে রাখেন কাজের ফাঁকে ফাঁকে। সাবু তাকে দেখে আসছে সেই ছোটো থেকেই। যার জীবনের অর্ধেক সময়টাই কেটে গেছে এই বটগাছের নিচে। এমন কোনো দিন নেই তিনি উপস্থিত থাকেন না। সাবু ভাবে, ক্লাস ক্যাপ্টেন ও নাজিম মামার উপস্থিতি গণনা করা হলে নাজিম মামাই এগিয়ে থাকবেন। বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে আইসক্রিমের ভ্যান টানতে টানতে ঠিক স্কুল ছুটির আগেই উপস্থিত হবেন।

সাবু কথার মাঝে বলে ওঠে, মামা কাল থেকে তো স্কুল বন্ধ, কই যাবেন ভ্যান নিয়ে?
নাজিম মামা একটু ভেবে বললেন, দেখি বাজারের দিকেই বসবো। তোমাদের সাথে দেখা হবে না কি আর করা।
চটপটে রাফি বললো, কয়েকদিন বিশ্রাম নেন মামা; যা রোদ পড়ছে। আপনার খুউব কষ্ট হবে।
নাজিম মামা তাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, কি বলো বাজান। ভ্যান নিয়ে বের না হলে যে আমার চুলায় আগুন জ্বলবে না। এমন কত দিন তো এই বটগাছটার নিচেই কাটিয়ে দিলাম।
নাজিম মামার কথাগুলো অন্যরা না বুঝলেও সাবু ঠিকই তার চাপা কষ্ট বুঝতে পারে।
সবাইকে বিদায় দিয়ে যে যার মতো বাড়ি ফিরতে লাগলো। সাবু ও সামির বাড়ি এক পাড়ায় হওয়ায় একসাথেই চললো তারা। সাবুর বাবার মতো সামির বাবাও কৃষক। তবে আর্থিকভাবে দুর্বল সামিরা। সামির বাবা বর্গাকৃষক। সারা বছর যা উৎপাদন করে তাই খরচ হয়ে যায়।

সামি জানতে চায়, শহর কি অনেক দূরে? বড় বড় দালান আছে?
সাবু উচ্ছ্বসিত হয়ে জবাব দেয়, শুধু কি দালান, কত্ত বড় বড় বাড়ি, মার্কেট আর স্থাপনা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তা দেখলেই অবাক হবে। তোমার মনে হবে এখনই যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে তারা।
এক নিশ্বাসে সব কথা যেন ঝরে পড়লো সাবুর কণ্ঠে।
সামি অবাক হয়ে শোনে। যেনো রূপকথার পাতালপুরী আর তেপান্তরের কোনো কাহিনী শুনছে।
তার মনে হয়, এমনও হয়তো কিছু এখনো অজানা আছে সে দেখেনি। মনে মনে নিজেকে কথা দেয় সে, সাবুকে সাথে নিয়ে সে শহরে যাবে। সাবু ওখানকার পথঘাট কিছু হলেও তো চেনে। তাই হারানোর ভয়ও নেই ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।
সাবুর মৃদু ধাক্কায় সম্বিত ফিরে পেলো সে। সামি জিজ্ঞেস করলো, কোথাও যাচ্ছো না ছুটিতে?
সামি অস্ফুট স্বরে বললো, না। যখন মা ছিলো তখন মামাবাড়ি যেতাম। এখন মা নেই, মামাবাড়িও নেই।
সাবুর কণ্ঠে এতক্ষণ যে উৎসাহ উদ্দীপনা ছিলো তা নিমিষেই হারিয়ে গেলো সাবুর কথায়? সামির জন্য মায়া হতে লাগলো তার।
জামে মসজিদের কাছেই সাবুর বাড়ি। তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে সামি বললো, ফিরে এসো তাড়াতাড়ি। ভালো থেকো।
সাবু কিছু বলতে পারলো না, সাবুর বোবা কষ্টের সাথে বোকা হাসিটা তার অন্তরে রক্তক্ষরণ করছে। এদিকে সামি ভাবছে, সাবুর কাঁধে হাত রেখে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে শহরময়। অলিতে-গলিতে চষে বেড়াচ্ছে। যেখানে হয়তো দুঃখ নেই। এমন কোনো কষ্ট নেই যা তাদের দমিয়ে রাখবে। আহা শহর, স্বপ্নের শহর।

২.
সেই বারোটা থেকেই নতুন জামা কাপড় পরে তৈরি হয়ে আছে সাবু, সাথে মা ও বোন সাহানা। প্রতিবার কোথাও যাওয়ার জন্য প্ল্যান করলে বাবা আসবেন খুব দেরিতে। এবারও ব্যতিক্রম হলো না। বাবা এলেন, ভ্যান সাথে নিয়ে। এটা নিয়ে বড় রাস্তায় ধরতে হবে বাস। সাথে আছে তিন-তিনটে বড় ব্যাগের ঝোলা। মাসখানেক থাকবে বলে কথা। সাথে নিয়েছে শখের বড় মোরগটা যেটাকে সাবু কোলে-পিঠে পুষেছে। প্রিয় মামাতো ভাই রোহান চেয়েছে বলেই ত্যাগ স্বীকার করতে হলো সাবুর।
রোহানের সাথে গলায় গলায় ভাব। একসাথে সময় কাটানো থেকে শুরু করে প্রতিটি মুহূর্তই উপভোগ করে একসাথে। বাসের জানালার পাশে বসে সাবু ভাবছে সামনের দিনগুলোর কথা।
আগামীকালকে এ সময়টা তারা একসাথে থাকবে ভেবে, মনটা কেমন আনচান করে উঠলো। তার একহাতে মুঠি করে ধরে রাখা পলি ব্যাগ কারণ পাছে বমি করার ভয়।
অনবরত গাড়ির হর্ন, রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাঁধা জটলা, গোল পাকানো হকারের হাঁকডাক কানে আসছে তার। বোন সাহানা ও মা ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে আর সে পিটপিট চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।
সে ভাবে কত রঙের আর ঢঙের মানুষ তার চারদিকে গিজগিজ করছে। জানালায় চোখ বুলিয়ে সে দেখে রাস্তার ধারে দাঁড়ানো দালানের সারি। সে আগে ভাবতো, এসব হয়তো দৌড়াচ্ছে কিন্তু না তাদের বাসটাই ছুটে চলেছে? এটা মনে হতেই নিজে মনের অজান্তে লজ্জা পেলো?

কিছুদূর গিয়ে একটা স্টেশনে গাড়ি থামলে হুড়মুড় করে উঠে পড়লো এক লোক। বিচিত্র তার হাব-ভাব, টেনে টেনেও কথা বলা যায় সে এ প্রথম কারো মুখে শুনলো। মস্ত ভুঁড়ির সাথে ঝুলছে চটের ঝোলা। এক এক করে জিনিস বের করছে আর হাত নেড়ে সবাইকে দেখাচ্ছে। নেইল কাটার থেকে শুরু করে কটনবাড, তরকারি কাটার চাকু থেকে চিরুনি যাবতীয় সবকিছুই যেনো ব্যাগ বোঝাই তার। সাবুর পাশে আসতেই হকচকিয়ে গেলো সে।
‘এই যে বাবু, তোমার জন্যও আছে কিন্তু। নিবা নি?’
সাবু কিছু বলার আগেই বের করে রঙিন মলাটের ডায়েরি ধরিয়ে দিলো হাতে। মলাটের উপর লতাপাতার ছবির সাথে জরির কাজ করা। কেমন সুঘ্রাণ বের হচ্ছে।
‘পড়ালেহা করোনি তুমি? ছড়া কবিতা লেইখো। বন্ধুগো কথা লেইখো। এইডা হইলো ডায়েরি।’
সাবু শুধু মাথা নাড়লো। সাবুর আগ্রহ দেখে মা পুরো বিশ টাকা দিয়ে কিনে নিলেন। নতুন কেনা ডায়েরির সুঘ্রাণ নিতে নিতে তার মনে পড়লো বড় বোন সাহানার ডায়েরির কথা।
বাক্সভর্তি ডায়েরি তার। কিন্তু সাবুকে ধরতেই দেয় না। বলতো, ‘এ্যাহ! পড়তে পারবি তুই? বয়স হয়নি এখনো।’
সাহানার কথাও মিথ্যে ছিলো না। তবে পড়তে শেখার পর থেকেই পাঠ্য বইয়ের চেয়ে বেশি ঝোঁক ছিলো সাহানার ডায়েরির প্রতি। বোনের অগোচরে যখনই সময় পেতো তখনই হামলে পড়তো তার ডায়েরির ওপর। কত কথা লিখেছে আপা। সুখের কথা, দুঃখের কথা, আরও কতো কি।

মজার বিষয় হলো, একবার মায়ের বকুনিতে বাড়ি ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবার কথা লিখেছে আপা। তা পড়েই হেসে কুটিকুটি।
আরো একটা চমৎকার তথ্য সে পেয়েছে তা হলো, আপা তাকে খুব ভালোবাসে।
ঘটনাটা এরকম।
একবার পাশের বাসায় রিমাদের বাড়িতে এলো নতুন টিভি। পাড়ার সকলেই সারাদিন রাত ও বাড়িতেই পড়ে থাকতো। এ নিয়ে বিচার এলো রিমার মায়ের। তারপর কি বেদম পিটুনিটাই না খেলো সাবু। তারপর থেকে ওমুখো আর কখনোই হয়নি। তা নিয়ে আপা ডায়েরিতে লিখেছে,
‘সাবুর জন্য কত মায়া লাগলো আজ। মনে হলো আজ হয়তো মা তাকে মেরেই ফেলবে। আমি শুধু দোয়া করছি তাকে যেনো মা আর না মারে। টাকা জমিয়ে একটা বিশাল টিভি কিনে দেবো সাবুকে। সে সারাদিন দেখবে, সারা সন্ধ্যা-রাত দেখবে। কেউই বকবে না আর।’
এসব ভাবতে ভাবতে কবে যেনো ঘুমিয়ে পড়লো সে।

৩.
সাহানার তীব্র ঝাঁকুনিতে চোখ মেলে তাকালো সাবু। সে শুনতে পেলো, ‘কিরে ঘুমিয়েই থাকবি? এসে গেছি আমরা।’
বাস হতে নেমে কিছুটা এগোলেই মামার বাড়ি। অনেক কিছু পাল্টেছে। আগের মতো সুনসান পরিবেশ নেই। পাশের এক চিলতে মাঠটাতেও হয়েছে দোকানপাট। পুরনো দোতলা বাংলো বাড়িটাই তার মামাবাড়ি। হরেক রকমের গাছে ভরপুর সারা উঠোন। এ যেনো শহরের বুকে এক চিলতে সবুজের পরম আশ্রয়।
কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে দাঁড়ালো রোহান। তারপর চেঁচিয়ে সারা বাড়ি মাতালো। শুক্রবার বলে মামাও ছিলেন বাসায়। যারপরনাই খুশি সবাই।
সাবু হালকা কিছু মুখে দিয়েই রোহানের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। সবাই জানে, তাদের আর সময় হবে না।
সাবুর সবচে পছন্দের স্থান হলো রোহানের রুমটা। দারুণ দারুণ সব বই আর বই। কমিকস, ম্যাগাজিন, গল্প, উপন্যাস আর ছড়া কবিতা মিলিয়ে সেলফ ভর্তি হয়ে আছে। গতবারও এত কিছু ছিলো না রোহানের। অন্য সময়গুলোতে তারা ভিডিও গেমস আর কার্টুন নিয়ে পড়ে থাকতো কিন্তু এবার পুরো সন্ধ্যে-রাত কাটতে লাগলো বইয়ের গল্পে।
এত সব কবে কিনলে, রোহান?
বাবার সাথে গত বইমেলায় গিয়ে নিলাম। তোমরা চলে যাওয়ার পরের মাসেই।
এবার কি হবে বইমেলা? সাবুর কণ্ঠে উচ্ছ্বাস ভেসে উঠলো।
প্রতি বছরই হয়। ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়ে এক মাস পুরোদমে চলে। এবার কিন্তু তোমার থাকতে হবে, বলে রোহান আবদার করলো।

দেখি কি করা যায়, বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সাবু।
রাতের খাবার খেয়ে দু’জন এসে দাঁড়ালো রোহানের ছোট্ট বারান্দায়। এখানেও ফুলের টব লাগিয়েছে সে। বেলি ফুলের মৃদু গন্ধে চারপাশ মো-মো করছে যেনো। বাংলোটার সামনে কোনো বড় বিল্ডিং না থাকায় শহরের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়।
সাবু দেখলো, দূরে সব দালানের গায়ে গায়ে বাতি জ্বলছে। রাত দশটা হতে চললো তবুও কেমন প্রাণবন্ত শহর। এদিকে গ্রামে সন্ধ্যে হলেই সবকিছু ছাপিয়ে শোনা যায় ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। সরু হয়ে চলা মেঠোপথগুলো থাকে শেয়ালের দখলে। মাঝে মাঝে ভেসে আসে আর্তচিৎকার। জোছনায় মাখামাখি পুকুরঘাট আর আমের মুকুল ছড়ানো উঠোন।
শহরেও এমন জোছনার দেখা পেলো সাবু। কি অদ্ভুতভাবে নিয়ন আলোকে গ্রাস করে রেখেছে জোছনা।
রোহান একের পর এক গল্প জুড়ে দিচ্ছে। অনেক দিনের জমানো কথাগুলো যেনো আজ রাতেই শেষ করতে হবে তার। নতুন স্কুলের কথা, গত ছুটিতে কাটানো সময়, আরো কত কি। সাবুও কম যায় না। সেও গল্পের ঝাঁপি খুলে দিলো রোহানের সামনে।
রাত আরো কিছুটা বাড়লে রোহান বললো, চলো ঘুরে আসি। তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে একটা।
সাবু চমকে উঠলো, ‘কয়টা বাজে খেয়াল আছে? কেউ জানতে পারলে তো আর কথাই নেই।’
রোহান অভয় দিয়ে বললো, এসো তো। যা হবার হবে। বারান্দার সাথে লাগোয়া দেয়াল টপকে নেমে পড়লো রাস্তায়। নীরবতা যেনো মহল্লার টুঁটি চেপে ধরেছে, কোথাও কোনো শব্দ নেই। দু’ একটি কুকুর ছাড়া রাস্তায় কেউ নেই। মহল্লা থেকে মহল্লা, ছোটো ছোটো গলি পেছনে ফেলে নেমে এলো মূল সড়কে। রোহান আগে চললো। পাশে ভয়ে ভয়ে এগোতে লাগলো সাবু।
হঠাৎ পাঁচতলা ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে গেলো রোহান। সিঁড়ি ঘরের বিপরীতে একটা কামরার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো তারা। রুমে ঢুকেই চমকে গেলো সাবু। রুমভর্তি বিভিন্ন বয়সের ছেলে। বেশির ভাগই তাদের সমবয়সী।
আজ এত দেরি করলি যে রোহান? বলেই রোহানের সাথে হাত মেলালো সবাই।
সবার সাথে সাবুকে পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে বললো, ‘আমার কাজিন সাবু, তাকে নিয়ে আসতেই এত লেট হলো।’ সবাই হাসিমুখে পরিচয় হলো সাবুর সাথে। চেয়ারে বসে চারদিকে চোখ বুলাতে লাগলো সাবু। দেয়ালের মাঝে বড় করে লেখা, ‘স্বপ্নজয় সামাজিক সংগঠন’।

সামাজিক সংগঠন শব্দটার সাথে তেমন পরিচিত নয় সাবু, এসব সংগঠনের কাজকর্ম নিয়ে কখনোই চিন্তা করেনি আগে। তার চিন্তার মাঝে ছেদ পড়লো আতিক ভাইয়ের কথায়।
‘আজকে আমাদের সংগঠনের সবচেয়ে বড় ইভেন্ট। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে আমাদের পথচলা। সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে নয় বরং নিজেদের সামর্থ্য মতো সমাজ বিনির্মাণে অংশীদার হওয়াই আমাদের লক্ষ্য। কথা না বাড়িয়ে আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে। আর হ্যাঁ, আমাদের অতিথি সাবুও যেনো কিছু শিখতে পারে তোমাদের কাছ থেকে।’ বলেই সবাইকে নিয়ে রওনা দিলো আতিক ভাই।
বাইরে দাঁড়িয়ে আছে দুটি ভ্যান। ভ্যান ভর্তি খাবারের বড় বড় ডেকচি। আতিক ভাই সবাইকে দু’দলে ভাগ করে দিলেন। আশপাশের কয়েকটি বস্তি ও ছিন্নমূল মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ করবে তারা।
বস্তির দিকে এগোতে এগোতে সাবুর নজরে এলো, নানা বয়সী মানুষ। যাদের নিজের বলতে কিছুই নেই। থেকে থেকে কেঁদে চলেছে বস্তির কয়েকটি শিশু। পুরনো কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে আছে পাগল কিছিমের কিছু লোক। তাদের ভ্যান দেখে ইতোমধ্যে এসব মানুষেরা ছুটোছুটি শুরু করে দিলো। তাদের একবেলা খাবার তুলে দিতে পারবে ভেবেই সাবুর খুব ভালো লাগতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে, একটা পাথর গড়িয়ে পড়লো বুক থেকে।
কাজে চটপটে বিধায় সাবুর দায়িত্ব পড়লো খাবার বণ্টনের। মুহূর্তের মধ্যে জটলা বেঁধে গেলো ভ্যান ঘিরে।
অসহায় ক্ষুধার্ত মানুষের জটলা। স্যাঁতস্যাঁতে বস্তির পরিবেশে বেড়ে ওঠা রুগ্ন শিশুটাও মুখে বুলি ফোটার আগেই শিখেছে হাত পেতে দেয়া।

এক ফাঁকে এক মহিলা এসে বললো, সারাদিন কিছুই খেতে পাইনি বাবা। ঘরে দুটে ছোটো মেয়ে আছে, বলে দূরের অন্ধকার ঝুপড়ির দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিলো। সাবু খাবার এগিয়ে দিতেই তার চোখ জুড়ে গড়িয়ে পড়লো কৃতজ্ঞতার অশ্রু।
সাবু ভাবলো, সবাই তো সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। সবার চাহিদা তো একই। অসহায় মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে পারলে এ জীবনে আর কিইবা চাওয়ার আছে?
মানুষ বাঁচেই তো ভালোবাসায়।

কিছুদূর যেতে এক আধবয়সী লোককে দেখে অবিকল নাজিম মামার মতোই মনে হলো, যার আইসক্রিম না বেচলে সংসারে চুলা জ্বলে না। বেঁটে শরীর, সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটছে। পরক্ষণেই নিজেকে তার অপরাধী মনে হলো। সে চাইলেই কি পারতো না, নাজিম মামার জন্য কিছু করতে?
এদিকে খাবার শেষ হয়ে এলো। তবুও অনেক মানুষ খাবার না পেয়ে ফিরে গেলো এক বৃদ্ধ মহিলা। আবদার রাখলো, ‘মাঝেমধ্যে আমাদের দেখে যেয়ো, আজ তোমরা না এলে হয়তো তিন দিন ধরে উপোস থাকতুম।’
সংগঠনের অফিসে ফিরে এসে হাত মুখ ধুয়ে সবাই খেতে বসবে এমন সময় সায়েম ভাই সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বললো, ‘কোনো খাবারই বাকি নেই। যা রাখার কথা ছিলো সবই ভুলে বিতরণ করা হয়ে গিয়েছে।’
এ কথা শুনে কেউ রাগ হওয়া দূরে থাক সবাই এক চোট হেসে নিলো। আতিক ভাই বললো, ‘খালি মুখে তো অতিথিকে বিদায় জানাতে পারি না, চলো চা-নাস্তার ব্যবস্থা করতে পারি কি না দেখি।’
সাবু তখনই আবৃত্তি করলো কবি জসীমউদ্দীনের বিখ্যাত সেই কবিতা,
সবার সুখে হাসবো আমি,
কাঁদবো সবার দুঃখে;
নিজের খাবার বিলিয়ে দেবো
অনাহারীর মুখে।
সায়েম ভাই তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এই তো আদর্শ মানুষের মতো কথা।’
রোহান হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। বললো, ‘বড্ড দেরি হয়ে গেছে আমাদের। যেতে হবে।’
সবাই সবার কাছে বিদায় নিয়ে পা বাড়ালো বাড়ির পথে।
রুমে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়লো রোহান। এদিকে ঘুম আসছে না সাবুর। সে এখনো একটা ঘোরের মধ্যে রয়ে গেছে। তার চোখে ভাসছে, ছিন্নমূল মানুষের চেহারা আর ক্ষুধার্ত রাতের গল্পগুলো। স্মরণীয় রাতটাকে ডায়েরি বন্দি করার তর সইছিলো না আর। ব্যাস, চুপিচুপি ডায়েরি বের করে লিখে রাখলো, অসাধারণ রাতের উপাখ্যান।
সুন্দর সময়গুলো কিভাবে কেটে গেলো তার কিছুই টের পেলো না সাবু। শহরের কত জায়গা রোহান তাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সংগঠনের দ্বারা পরিচালিত বিজ্ঞান ক্লাব, বুক ক্লাব ও ব্লাড ব্যাংকেও কাজ করার সুযোগ হয়েছে সাবুর।
রোহানকে নিয়ে সাবু তার ডায়েরিতে লিখলো,
‘রোহান আমার বন্ধু ও ভাই। তার কাছে আজীবন ঋণী হয়ে থাকবো। বেঁচে থাকার উপলক্ষগুলো কিভাবে নিজেদের তৈরি করে নিতে হয় তা শিখেছি তার কাছে।’

৪.
গ্রামে ফিরেই যেনো উৎসব লেগে গেলো। নবান্নের উৎসব। সারা বছর ধরে কাজ করে ঠিক এ সময়টার জন্যই অপেক্ষা করে তারা। ঘরে ঘরে নতুন ফসল ওঠার আয়োজনে মুখর থাকে পরিবেশ।
সাতসকালে বাবার ডাকে ঘুম ভাঙে সাবুর।
‘সাবু উঠে পড় বাবা। বেলা তো অনেক হলো। চল একবার মাঝ মাঠে গিয়ে ঘুরে আসি।’
আড়মোড়া ভেঙে সাবু উঠে বসলো। দক্ষিণের জানালা জুড়ে চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ। হালকা কুয়াশার চাদর চিরে বেরিয়ে আসছে সূর্য। কাঁচা-মিঠা রোদের সাথে মৃদু বাতাস বইছে। এ সময়টা সাবুর মনে হয় অতুলনীয়। যদিও সে জানে, সময়টা বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না। কিছুক্ষণ পরেই আগুনের ফুলকি ছিটোতে থাকবে সূর্যিমামা।
মাঠের দিকে এগোতেই সামির বাবা মতিয়র মিঞা ছুটে এলো সাবুর বাবা হাসান মিঞার দিকে।
‘আপনের সামনেই তো হাশেম মাতবরের থেইকা সাত হাজার ট্যাকা নিসিলাম। হেই মিঞা আইজকা কয়, আমি নাকি সত্তর হাজার ট্যাকা নিসিলাম। আমারে বাঁচান ভাইজান। এবারের ধানও হইসে কম। আমার যাওয়ার কুনো পথ নাই।’ এক নিশ্বাসে সব কথা বললেন মতিয়র মিঞা। পিছনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সামি।
হাসান মিঞা অভয় দিয়ে বললো, ‘এটা তো কুনো কথা অইতে পারে না। মগের মুল্লুক পাইসে নাকি হে। প্রতি বছর একেকজনের সাথে বাটপাড়ি করবো। তুমি বাড়ি যাও। দেখি কি করবার পারি।’
কথা শুনে মতিয়র মিঞাকে কিছুটা আশ্বস্ত করা গেলো।
সন্ধ্যার দিকে বাজারে সালিশ বসানো হয়েছে আজ। বড় রকমের জটলা। ভিড় ঠেলে সাবু কিছুটা সামনে যেতে দেখলো সামির বাবা ও সামিকে। মাতবরের সাথে তার সাঙ্গপাঙ্গোরা। চেয়ারম্যান আর মাতবর কিছুক্ষণ পরপর কানাকানি করছেন। এ যেনো বিচারের নামে প্রহসন।
সামির বাবা মতিউর হাতজোড় করে বলতে লাগলো, ‘কাকা আপনের থিকা সাত হাজার ট্যাকাই নিসিলাম। হাসান মিঞা সাক্ষী আছে।’
মাতবর তার দিকে তেড়ে গিয়ে বললো, ‘মুখের কোনো সাক্ষীই চলবো না। তুমি ভিটা বন্ধক রাইখা ট্যাকা নিসিলা সত্তর হাজার ট্যাকা। এই দ্যাখো কাগজ আছে।’ বলে সবাইকে হাত উঁচিয়ে দেখাতে লাগলো।
ভিটে বন্ধক রাখার কথা শুনে যেনো আকাশ হতে পড়লো মতিউর মিঞা। সে কোনো কথাই বলতে পারলো না আর।
রহিম মাস্টার জমির দলিলের কাগজটি হাতে নিয়ে দেখলো। তিনি বুদ্ধি খাটিয়ে মতিউর মিঞাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘তুমি কার কাছ থেইকা কিনসিলা জমি, মতিয়র মিঞা?’
মতিউর মিঞা বললো, ‘ভাইজান। যুদ্ধের পরই থেইকাই তো এইহানে আমরা। বাপেরে দিসে সরকার। মূর্খ মানুষ জমির দলিল দিয়া কাম কি?’
এ কথা শুনে চারদিকে কানাঘুষা হতে লাগলো মাতবরের বিরুদ্ধে। মাতবর অসহায় হয়ে চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চেয়ারম্যান সাব আপনে কিছু কন দেহি।’
অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে চেয়ারম্যান বললো, ‘আমি কি কমু। আপনাগো গেরামের সমস্যা সমাধান মুরব্বিরাই ভালো বুঝবো।’
ঈদের ছুটিতে গ্রামে বেড়াতে আসা ব্যাংকার রশিদ টিপ্পনী কেটে বললো, ‘কাকা এইসব দলিলপত্র তো গঞ্জেই বানানো যায়। মানুষ কি আর বোকা আছে নি? গরিবের হক মাইরেন না।’
কথার রেশ না কাটতেই পুরো বাজারে হাসির রোল পড়লো। বিচারে রায় হলো, মতিউর কোনো টাকা পরিশোধ করবে না। মাতবর দশ হাজার টাকা জরিমানা দিবে হয়রানির কারণে।

৫.
পরদিন সকালে জরুরি মিটিং হলো সাবুদের বন্ধুদের মাঝে। সাবু সবাইকে শহরের সংগঠনটির কথা বললো আর কাজগুলোও বুঝিয়ে দিলো।
গ্রামের অনেক কৃষক এবার পাকা ধান তুলতে হিমশিম খাবে। সাবুরা কয়েকটা গ্রুপে ভাগ হয়ে তাদের কাজে এগিয়ে এলো।
দিনের সাথে সাথে ঘনিয়ে আসছে ঈদ। গ্রামে অনেক পরিবারই আছে যারা আয়রোজগার না থাকায় ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে না।
তাই সাবুরা সিদ্ধান্ত নিয়ে গ্রামের বিত্তবানদের কাছ থেকে টাকা তুলে জাকাত ফান্ড গড়ে তুললো। সে টাকা ঈদ উপহার স্বরূপ তুলে দিলো অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষের হাতে। সে সুবাদে এবার গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র। ঈদের আমেজ আর আনন্দ থেকে বাদ গেলো না কোনো পরিবার। যার পুরো কৃতিত্বই সাবু আর সামিদের। এ খেটে খাওয়া মানুষের তল্লাটে এভাবেই তাদের কাজ এগোতে লাগলো। সমাজের সব ব্যবধান আর শ্রেণীভেদ ভুলে গড়ে উঠলো মানবতার প্রাচীর।
একদিন সংগঠনের কাজের ফাঁকে সামি সাবুর কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘বল তো জীবন কতটুকু সুন্দর?’
সাবু একটু ভেবেই উত্তর দিলো, ‘ততটুকুই সুন্দর, যতটুকু আমরা করে নিতে পারি।’ ঠিক এভাবেই গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার প্রত্যয়ই জোগাতে লাগলো বেঁচে থাকার প্রেরণা; জীবন যেখানে যেমন, জীবন সেখানে সুন্দরের উপমা।

Share.

মন্তব্য করুন