সাইফদের বাড়িটা শহরের শেষ প্রান্তে। বাড়িঘর কম, গাছপালা বেশি। প্রতিদিন বিকেলে মাঠচরা পাখিদের কিচির-মিচির আর শহর ফেরা কাকগুলো কা-কা জুড়ে দেয়।
সাইফদের বারান্দার পাশে একটা খাল। খালটা শহর বেরিয়ে এসে ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে। সকালে প্রাইভেট পড়া শেষে সাইফ বই গুছাচ্ছিল। আজ তার স্কুল নেই, মতি স্যার হোমটাস্ক দিয়ে উঠে গেছেন। এমন সময় পাড়ার বন্ধু তন্ময় আর বুলু, বারান্দার পাশ দিয়ে দৌড়ে চলে গেলো। দুজনের হাতে দুটো বাটুল আর গুলতি। বুঝতে বাকি রইলো না যে, ওরা পাখির পিছনে লেগেছে। দু’চারটে পাখি না মেরে ফিরবে না। এমন সময় ছোট বোন খুকি এসে দাঁড়ালো, ভাইয়া আজ তুমি পুকুরে গোসল করবে বলেছ। সাইফ খুকিকে বললো, তুইতো সাঁতার জানিস না পুকুরে যাবি কিরে। না তুমি সাঁতার কাটবে আর আমি দেখবো। কিন্তু সাইফের মাথায় কাজ করছে তন্ময় আর বুলুর দৌড়ানো।

-নারে আজ না অন্য দিন। খুকিতো মন খারাপ করে চলে গেলো। সাইফ বইগুলো রেখে, লুকিয়ে রাখা বাটুল আর গুলতি নিয়ে দৌড়। পেছন থেকে খুকি চেঁচিয়ে বললো, আমি কিন্তু বাবাকে বলে দেব। তুমি পাখি মারতে গেছ। সাইফ দাঁড়িয়ে পড়ে খুকিকে বললো, আপু বলিস না তোকে অনেক চকোলেট কিনে দেব। এ কথা বলে বুলু আর তন্ময়ের খোঁজে বাগানে ঢুকে গেল। কিন্তু মনে মনে বাবার নিষেধটা খুঁচিয়ে উঠলো।

“কক্ষনো পাখি মারবে না” তারপরও সাইফের নেশা গুলতি বাটুল। লুকিয়ে বুলুকে দিয়ে গুলতি বাটুল কিনেছে। যদিও সাইফের নিশানা এখনও ঠিক হয়নি। তারপরও তাকে এই দুষ্টু নেশা পেয়ে বসেছে। সে পাখি মারবেই। আজ বুলু আর তন্ময়কে সাথে পেয়েছে। বাগান মাঠ পেরিয়ে পুকুর পাড়ে যেতেই, পেয়ে গেলো বুলু আর তন্ময়কে। ভারি মজা, এরই মধ্যে তারা তিন-চারটে চড়ুই আর বুলবুলি কুপোকাত করেছে। তন্ময় বললো, আজ আরো কটা মারবো, তারপর হবে পাখিভোজ, পিকনিক। রক্ত মাখা চারটে পাখি নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে ঘাসের উপর। পুকুর পাড়ের গাছগুলোতে অনেক পাখি, পুকুরে বক, ডাহুক। বুলু বলে, একটা ডাহুক মারতে পারলেই কম্ম সারা, মহাভোজ। সাইফ দু-একবার নিশানা করে একটা পাখিও মারতে পারলো না। তাই দেখে বুলু কেমন কেমন দাঁত কেলিয়ে হাসলো। সাইফ জেদ করে আবারো পাখির পেছনে ছুটলো। নিরীহ সব পাখিগুলো, তিন দুষ্টু ছেলের পাল্লায় পড়ে, জীবন দিশেহারা। একটা গাছে একঝাঁক কাক বসে মিটিং করছিলো। তন্ময় দাঁত কেলিয়ে এবার একটা কাককে নিশানা করে গুলতি ছুড়লো। নিশানা অব্যর্থ একটা কাক আহত হয়ে পাখা ঝাপটে নিচে পড়লো। দু’একবার ওড়ার চেষ্টা করেও পারলো না। তার শরীর ব্যথায় র্থ র্থ করে কাঁপছে। অন্যগুলো এমন আকস্মিক আক্রমণে উড়ে গিয়ে, আবার ঝাঁক বেঁধে ফিরে এলো। আহত কাকটির কাছে গিয়ে বুলু হেসে বললো, হ্যাঁরে তন্ময় কাকের মাংস খাবি? শুনে তন্ময় ওয়াক থু করে, হা হা করে হাসতে লাগলো। এর মধ্যে কাকের ঝাঁকটা এসে আক্রমণ করলো তাদের। তন্ময় আর বুলু পালানোর আগে পালালো সাইফ। বুলু আর তন্ময়কে কাকের ঝাঁকটা তাড়িয়ে এসে ঠোকর দেবার চেষ্টা করলো। বুলু তো ভয়ে ভ্যাঁ করে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত তিনজনই দৌড়ে পুকুর পাড়ে চলে এলো। যেখানে চারটে নিরীহ পাখি নিথর পড়ে আছে ঘাসে।

তন্ময় বললো, এই চারটে পাখি দিয়েই ভোজ করি চল। বুলু বললো, না হবে না। আরো পাখি দরকার। চল পুকুরের ওই পাড়টা দেখি। তিনজনই উল্টো পাড়ে গিয়ে দেখলো, দুটো ডাহুক পাখি। দুটোকেই শুয়ে নিশানা করলো বুলু আর তন্ময়। গুলতি খেয়ে উল্টে পড়লো একটা, অন্যটা কোনো মতে ঝোপের মধ্যে উড়ে গিয়ে লুকিয়ে গেল। বুলু চেঁচিয়ে বললো, সাইফ যা, দৌড়ে গিয়ে পাখিটা নিয়ে আয়। তুইতো কোন কাজই পারিস না। সাইফ দৌড়ে গিয়ে দেখলো, ডাহুক পাখিটা র্থ র্থ করে কাঁপছে। তার চোখ দুটো কেমন করুণ ভাবে তাকিয়ে আছে। সাইফ ওর পাখাটা ধরে তুলে আনলো। তার হাতে পাখির র্থ র্থ কাঁপুনি অনুভব করছিলো। বুলু দৌড়ে এসে একটা ব্লেড বের করে। সাইফ পাখিটার গলা ধরে ছিলো। জবাই করার সময় পাখিটা শেষ ঝাপটা দিলো আর অমনি ব্লেডটি পিছলে লাগলো সাইফের হাতে। সাইফ পাখিটা ছেড়ে দিয়ে চেপে ধরলো হাতের আঙ্গুল। রক্ত বেরিয়ে এলো চির চির করে। তন্ময় এসে চেপে ধরে বললো, বুলু তোর পকেটে যে কাপড়টা আছে ওটা বের কর। বুলু পকেট থেকে একটা ন্যাকড়া বের করলো। সাইফের আঙ্গুল পেঁচিয়ে খুব শক্ত করে বেঁধে দিলো তন্ময়। সাইফ দেখলো তার হাতের আঙ্গুলগুলো থর থর করে কাঁপছে, ঠিক আহত পাখিটার মতো। মনে মনে তার খুব কষ্ট হতে লাগলো। বুঝলো আহত পাখিদের কতো কষ্ট। বুলু আর তন্ময়কে বললো, আমরা বোধ হয় ভুল করছি রে। পাখিদের গুলতি মারা বাদ দে, চল ফিরে যাই। তন্ময় আর বুলুরও মন খারাপ হয়ে গেল। তিনজনই মৃত পাখিগুলো হাতে নিয়ে ফিরে এলো। কিন্তু সাইফ খুব ভয় পেয়ে গেল। হাতকাটা নিয়ে বাবা মার সামনে মুখ দেখাবে কি করে? সাথে বুলু আর তন্ময় দুজনই গেল সাইফের বাসায়। সাইফের বাবা খুব করে ধমকে দিলেন। ধমক খেয়ে বুলু, তন্ময় আর সাইফ কান ধরে শপথ নিলো। আজ থেকে গুলতি বাটুল ফেলে দেব। আর পাখিদের পেছনে ছুটবো না।

Share.

মন্তব্য করুন