মূল সড়কের দুই ধারে পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে অভিজাত এই এলাকা। রাস্তার একপাশে উত্তর খুলশী, অপর পাশে দক্ষিণ খুলশী। পাকা সড়কটি ধরে কিছুদূর এগোলে শপিংমল ‘খুলশী মার্ট’। সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় সবই পাওয়া যায়। একে তো কোয়ালিটি প্রোডাক্ট, তার ওপর দামাদামিরও ঝামেলা নেই। তাই ধ্রুব তার ছোট্ট ব্যাচেলর-সংসারের জন্য কেনাকাটার কাজটা সারে ‘খুলশী মার্ট’ থেকেই। দামাদামি, হট্টগোল, আড্ডাবাজি ধ্রুবর মোটেও পছন্দ নয়; নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে ভালোবাসে সে। তবে এখন ‘খুলশী মার্ট’ থেকেও যে সে নিয়মিত কেনাকাটা করে, তা নয়। কারণ প্রতিদিনের বাজার করার কাজটা বলতে গেলে সে বুয়ার ওপরেই ছেড়ে দিয়েছে। প্রথম দিকে খুলশী মার্টে তাকে প্রায়ই আসতে হতো। বাজারের দায়িত্ব বুয়া নেওয়ার পর থেকে এখন সে মাঝেসাঝে এখানে আসে।
আজকে ধ্রুব খুলশী মার্টের কাছেই এসেছে। বসে আছে খুলশী মার্টের পাশের একটি ফাস্ট ফুড শপ ‘ওশান ক্যাফে’তে। সঙ্গে আছে তূবা। তূবা ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে টেলিকমিউনিকেশনস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রী। জৈষ্ঠ্যের গরমে সেদ্ধ হয়ে এখানে হাজির হয়েছে দুজন। ধ্রুব ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিয়ে এখানে এসেছে আর তূবা এসেছে বাসা থেকে।

ফালুদার অর্ডার দেওয়া হয়েছে। এখানকার ফালুদা দুজনেরই খুব প্রিয়। দুজনের আরও একটি প্রিয় খাবার আছে; নিউমার্কেটের ডায়মন্ড হোটেলের গরুর মাংসের চাপ। ধ্রুব আর তূবার প্রিয় খাদ্যতালিকায় এই নগণ্য মিলের উদ্ভব হয়েছে সম্প্রতি। গরম আবহাওয়ার কারণে আজকে তারা নিউমার্কেটের ওদিকটায় গেল না, আর তাছাড়া তূবাদের বাড়ি দক্ষিণ খুলশীতে হওয়ায় এখানে আসাটা তার জন্য সহজ।

ধ্রুব চেয়ার টেনে তূবার পাশেই বসল। তূবা ধ্রুবকে জিজ্ঞেস করল, ‘গতরাতে আপনি কী জানি বলতে চেয়েছিলেন? এখন বলেন।’
তূবার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই ধ্রুব নার্ভাস হয়ে যায়, আজকে তাকে আরও বেশি নার্ভাস দেখাচ্ছে। এই মুহূর্তগুলোয় ধ্রুবর হার্টের ‘ইসিজি’ করলে রিপোর্টেও হয়তো খানিক পরপর ‘হার্ট বিট’ খুঁজে পাওয়া যাবে না! বাড়তি নার্ভাসনেস নিয়েই ধ্রুব শুরু করল, ‘তূবা, আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।’
তূবা হাসিমুখে সাহস যোগাল, ‘বলেন। আপনাকে দেখে খুব নার্ভাস লাগছে। এসিতে বসেও ঘামছেন। এত নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই। এই টিস্যুটা ধরেন।’
ফালুদা তৈরি হয়ে গেছে। ধ্রুব উঠে গিয়ে ফালুদা নিয়ে আসলো। টিস্যু দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ধ্রুব যে কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলল, তা শুনে তূবার মেজাজ পুরোপুরি বিগড়ে গেল। তূবা খেয়াল করেছে, ধ্রুব প্রথম থেকেই কেমন জানি অ™ু¢ত আচরণ করে। সে আসলে কেমন টাইপের ছেলে, তূবা আজ পর্যন্ত সেটা বুঝতেই পারেনি।

ধ্রুব এখন এমন একটা ‘ব্ল্যাঙ্ক লুক’ নিয়ে বসে আছে, মনে হচ্ছে টেলিফোন লাইনের ‘কেবল’ বা ‘তার’ চুরি করার পর লোকজন তাকে ধরে-বেঁধে এখানে নিয়ে এসেছে। আজব এক ছেলে! তার সঙ্গে তূবার মাস তিনেকের পরিচয়। আজকে ছেলেটা এমন একটা কথা বলবে, সেটা তূবা কল্পনাও করেনি। ধ্রুব মাঝেমাঝেই বোরিং টাইপের কথাবার্তা বলে। কিন্তু আজকেরটা একটু বেশিই আনএক্সপেক্টেড!
ধ্রুব তূবার কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে ফিসফিস করে বলেছে, ‘একটা বিশাল কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছি, তূবা। ব্যাপারটা কেউ জানে না। তোমাকেই শুধু জানাতে চাই। আমি প্রকৃতির একটি বড় রহস্য আবিষ্কার করে ফেলেছি। এখনও কিছু কাজ বাকি। পুরোটা শেষ হলে তোমাকে ডিটেল বলব।’ এই বয়সী একটা ছেলে কোনো মেয়ের কানের এত কাছে মুখ এনে এমন আঁতেলীয় মার্কা কথা বলতে পারে, তা আজকের এ ঘটনা না ঘটলে তূবা বিশ্বাসই করত না!
কথাগুলো বলার পর থেকে ধ্রুব হাঁপাচ্ছে। গোপনীয় কথা প্রথম কাউকে বলে ফেলার উত্তেজনার রেশ যেন তার কাটছে না! তূবা বিরক্তি নিয়েই চামচ দিয়ে ফালুদার ওপর থেকে অল্প একটু মুখে তুলে নিল। তূবা যে রেগে আছে, সেটা ধ্রুব বোঝেওনি।

মনের কথাগুলো বলতে পেরে এখন ধ্রুবকে নির্ভার মনে হচ্ছে। হাসিমুখে সে গপগপ করে ফালুদা খাওয়া শুরু করেছে। তূবা গলার স্বর কড়া করে জিজ্ঞেস করল, ‘শুধু কি প্রকৃতি নিয়ে পড়ে থাকলে হবে? সংসার-টংসার কিছু করবেন না?’
এবার ধ্রুব যে উত্তরটা দিল, সেটা শুনে তূবার মেজাজ আরও চড়ে গেল। ধ্রুব শুধু বলল, ‘আমি তো দুই নাম্বার।’
‘দুই নাম্বার মানে কী! হোয়াট ডু ইউ মিন বাই দুই নাম্বার?’
বোঝাই যাচ্ছে তূবার রাগ একেবারে এভারেস্টের চূড়ায় উঠে গেছে। ধ্রুব বেচারাও ভয় পেয়ে গেছে। আমতা আমতা করে ধ্রুব উত্তর দিল, ‘আমি বাবা-মার দুই নাম্বার সন্তান। আমার একটা বড় বোন আছে। সে এখনও বিয়ে করেনি। আব্বা-আম্মা বলেছে আপুর বিয়ের পর আমার বিয়ে দেবে।’
এই ছেলের কথা শুনে তূবা হাসবে না কাঁদবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। কথা বলতে তূবার আর একটুও ইচ্ছা করছে না।

২.
আশরাফ সাহেব রিমোট চেপে বারবার টিভি চ্যানেল বদলাচ্ছেন। দেশি-বিদেশি সব চ্যানেলে একই খবর! সিএনএন চ্যানেলে ‘ট্রুপার নেভিগেশন স্যাটেলাইট’-এর সাহায্যে বাংলাদেশের দুর্গম এলাকায় কিছু একটা দেখানোর চেষ্টা চলছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে সেটার সম্প্রচারও বন্ধ হয়ে গেল। টিভিপর্দায় ভেসে উঠল:
ঝবপঁৎরঃু অষবৎঃ!
গরষরঃধৎু ঝঃড়ঢ়ঢ়বফ ঞধৎমবঃ-ঙনলবপঃ ঞৎধহংসরংংরড়হং!

এখন রাত সাড়ে এগারটা। ঘণ্টাখানেক আগে ঢাকায় এক দফা ভূমিকম্প হয়ে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কম্পন থেমে গেছে। বাসার সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ড্রইং রুমে জড়ো হয়েছে। আশরাফ সাহেব তার একমাত্র ছেলের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু ধ্রুবর মোবাইল বন্ধ!
আশরাফ সাহেব ধ্রুবর বাড়িওয়ালার মোবাইল সেটে কল করলেন। রিং হচ্ছে, কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না। আবার কল করে সবসময় পাওয়াও যাচ্ছে না। নেটওয়ার্ক বিজি দেখাচ্ছে। ভূমিকম্প হওয়ায় সবাই মোবাইলে কথা বলছে; এ কারণে ‘কল কনজেশন’ হচ্ছে।
টেলিভিশন চ্যানেলগুলো থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো: রাঙামাটির বিলাইছড়ি নামের প্রত্যন্ত এক এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে। আকাশ থেকে নেমে আসা আগুনের কুণ্ডলী নাকি একটি পাহাড়ের ওপর আছড়ে পড়েছে। অধিবাসী চাকমা উপজাতিরা বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা ও টিভি চ্যানেলকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এ খবর জানিয়েছে। তাদের একজন নাকি স্বচক্ষে আগুনের কুণ্ডলী পড়তে দেখেছে। তবে এ ব্যাপারে সরকারের কোনো বক্তব্য এখনো পাওয়া যায়নি। সংবাদিকরা স্থানীয় ইউএনও-কে ফোন করে তাঁর মোবাইল বন্ধ পাচ্ছেন। সেখানে সরকারি অফিসে ফোন করেও কাউকে পাওয়া যায়নি। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং মধ্যভাগে রিখটার স্কেলে ৩.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্পের স্থায়ীত্ব ছিল মাত্র দুই সেকেন্ড। পার্বত্য এলাকাগুলোতে দুটি পাহাড় ধসের ঘটনাও ঘটেছে। সাংবাদিক ও উদ্ধারকর্মীরা এখনো ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারেন নাই। তাই প্রকৃত ঘটনা, হতাহতের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাব্য পরিমাণ সম্পর্কে এখনো কোনো ধারণা করা সম্ভব হয়নি।
ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে আশরাফ সাহেবের মাথায় অন্য কোনো চিন্তা ঢুকছে বলে মনে হয় না। ভূমিকম্পের পর এই মুহূর্তে বাসার সবাইকে নিয়ে বিল্ডিং থেকে বের হয়ে সামনের ফাঁকা মাঠটায় গিয়ে দাঁড়ানো উচিত। কিন্তু এখনো তিনি এসব ভাবেননি। এলাকার সব লোক সামনের মাঠে এসে জড়ো হয়েছে। অন্যদিকে তার স্ত্রীও ছেলের চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছেন। বেচারীর চোখ-মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। আর তার মেয়েটা অর্থাৎ ধ্রুবর বড় বোন গম্ভীর মুখে সোফায় বসে আছে। কাজের মেয়ে ভূমিকম্পের সময় চিৎকার করতে করতে দৌড়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। কোথায় গেছে, কে জানে!

৩.
ধ্রুব থাকে চট্টগ্রামের গুলশানখ্যাত এলাকা দক্ষিণ খুলশীতে। দুই নম্বর রোডের শেষ মাথায় ঢালু রাস্তার আগে ডানে ঢুকে গেলে যে বাড়িটি দেখা যায়, সেই বাড়িতেই ভাড়া থাকে সে। বাড়িটির দোতলায় থাকে ধ্রুব। দোতলায় রয়েছে চারটা রুম। একদম ভেতরের দিকের মাস্টারবেডটা সে থাকার জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছে। একা থাকে বলে তার ফ্ল্যাটে সবসময়ই থাকে পিনপতন নিস্তব্ধতা!
ছোটবেলা থেকেই ধ্রুব কোলাহল বা আড্ডাবাজি সহ্য করতে পারে না। শব্দে তার মনোযোগে চিড় ধরে। সবসময়ই কোনো-না-কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে সে। জীবনে কখনো আড্ডাবাজি পছন্দ না করার কারণে তার কাছের বন্ধু বলে কেউ নেই। পারতপক্ষে মানুষের আলোচনার মধ্যেই সে থাকে না। গান-বাজনাও খুব একটা উপভোগ করে বলে মনে হয় না। সব মিলিয়ে বইপাগল-আঁতেল-রসহীন এক মানুষ!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিওলজিতে (ভূ-তত্ত্ববিদ্যা) মাস্টার্স করেছে ধ্রুব। জিওলজি নিয়ে পড়াশোনা করলেও মূল ট্র্যাকের বাইরের বিভিন্ন বিষয়েও তার জ্ঞান রয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে গবেষণার প্রতি তার প্রবল আগ্রহের কারণে। পার্বত্য ভূমিরূপ নিয়ে পিএইচডি-র গবেষণার জন্য বছরখানেক আগে সে চট্টগ্রামে এসেছে। এখানে এসে সে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে খণ্ডকালীন শিক্ষকতার সুযোগ পেয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি লালখান বাজারের মোড়ের কাছে, আর সে থাকে এই দক্ষিণ খুলশীতে।

এক কাজের বুয়াকে মাসের প্রথমেই সে টাকা দিয়ে রাখে। বুয়ার বাসা ঝাউতলা বাজারের কাছে। প্রতিদিন বুয়া ঝাউতলা বাজার থেকে যা যা প্রয়োজন, কিনে নিয়ে আসে। তারপর রান্না করে রান্নাঘরেই খাবার রেখে চলে যায়। খিদে পেলে ধ্রুব রান্নাঘর থেকে রান্না করা খাবার নিজের রুমে নিয়ে যায়; খাওয়া শেষে থালাবাসন আবার রান্নাঘরে রেখে দেয়। ধ্রুব নিজের রুমে ছিটকিনি দিয়ে রাখলেও ফ্ল্যাটের মেইন দরজাটা কখনো বন্ধ করে না। আসলে দরজা বন্ধ করার চিন্তাটা সবসময় মাথায় রাখা এবং সময় নিয়ে দরজা বন্ধ করা- এই ব্যাপারগুলো তার পছন্দ নয়। আবার বুয়া এসে দরজা বন্ধ পেলেও আরেক ঝক্কি!
আজকে ভূমিকম্পের সময় ধ্রুব বাসাতেই ছিল। ভূমিকম্পের পরপরই নিচে নেমে এসেছে। এই বাড়িটির সামনে বেশ অনেকখানি ফাঁকা জায়গা আছে। বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটেরাও নিচে নেমেছে। সবাই ফাঁকা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে। ধ্রুব নিচে নামলো। সেখানে তূবাও সেখানে আছে।
তূবাই ধ্রুবর কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘শুনেছি, একবার মৃদু ভূমিকম্প হলে তারপর বড় ভূমিকম্পের আশংকা থাকে!’
‘কিন্তু আজকে আর কোনো ভূমিকম্প হবে না।’ ধ্রুব খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথাটা বলল।
একটা মানুষ ভূমিকম্প নিয়ে জোর দিয়ে কথা বলছে, এটা খুবই হাস্যকর। তবে তূবার কাছে ব্যাপারটা নতুন নয়। এই ছেলের সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে এমন উদ্ভট টাইপের কথা শুনতে শুনতে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
‘তাহলে নিচে নেমে এলেন যে?’ তূবা জানতে চাইল।

‘তোমার সঙ্গে দেখা হবে সেজন্য।’
‘দেখা তো হলো। এবার রুমে গিয়ে আবার বইপত্র নিয়ে বসেন।’
তূবার কথায় মনে হলো ধ্রুব খুব খুশি হয়েছে। হাসিমুখে সে সত্যিসত্যি দোতলায় চলে গেল। এতে তূবা মোটেও অবাক হলো না। আসলে অবাক হওয়া ব্যাপারটাই আপেক্ষিক। আমাদের চারপাশে অবাক হওয়ার মতো অনেক কিছুই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। কিন্তু মানুষ সবকিছুতে অবাক হয় না। যেগুলো ঘটার ফ্রিকোয়েন্সি খুবই কম, শুধুমাত্র সেগুলোতেই মানুষ অবাক হয়। ধ্রুবর পাগলামি এতটাই ফ্রিকোয়েন্ট যে তা আর তূবাকে অবাক করে না!

৪.
আশরাফ সাহেব রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে ঘনঘন চ্যানেল বদলাচ্ছেন। তিনি টিভির সামনে বসে থাকলে বারবার চ্যানেল বদলানোর এই ব্যাপারটাই বেশি উপভোগ করেন। আজকে অবশ্য উদ্বিগ্ন হয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করছেন। কিন্তু কোনো চ্যানেলেই চট্টগ্রাম শহরের খবর পাচ্ছেন না। ইতিমধ্যে কয়েকটি চ্যানেলে বিশেষজ্ঞ ধরে এনে ‘টক শো’ শুরু করে দেওয়া হয়েছে। আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা নিজ নিজ মতামত জাহির করতে ব্যস্ত। একটি টক শো অনুষ্ঠানের এক বক্তা হানড্রেড পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিয়ে বলে দিলেন যে পৃথিবীতে এলিয়েন নেমেছে! আন্তর্জাতিক মহল এখনো কেন শুয়ে-বসে আছে, কেন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলছে না- এ নিয়ে তিনি ভীষণ চিধিÍত।
অনুষ্ঠানের আরেক বক্তা এটাকে উল্কাপাত বলে মত দিলেন। শুধু মতামত দিয়ে তিনি ক্ষান্ত হলেন না, পৃথিবীর ইতিহাসে আগে যেসব উল্কাপাতের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর ওপর পাতিদীর্ঘ বক্তব্যও পেশ করে ফেললেন। বোঝাই যাচ্ছে, উল্কা নিয়ে ভদ্রলোকের ব্যাপক পড়াশোনা। এতদিন পর সেই জ্ঞান জাহির করার সুযোগ পেয়ে বেচারা নিজেকে কিছুটা হালকা করে নিচ্ছেন। তাই তার মুখে খুশিখুশি ভাব ফুটে উঠেছে। বাস্তবিকই উল্কাপাত হলে সেটা যে একটি সিরিয়াস ইস্যু, এটি আপাতত তার মাথায় নেই!

তৃতীয় বক্তা এতক্ষণ বেশ গম্ভীরভাবে বসেছিলেন। কথা বলার সুযোগ পেয়ে তিনি আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন। তখনও কেউ ঘুণাক্ষরে বুঝতে পারেনি যে এত গাম্ভীর্য নিয়ে মানুষটি এমন হাস্যকর একটি মত দিবেন। তাঁর মতে, কোনো কৃত্রিম উপগ্রহ, রকেট বা প্লেন সেখানে পড়েছে! স্বাভাবিকভাবেই কেউ এ কথার কোনো মূল্য দিল না। কারণ পৃথিবীর এমন কোনো বস্তু বা সরঞ্জাম বিধ্বস্ত হলে এতক্ষণে অবশ্যই জানাজানি হয়ে যেত। তাছাড়া এসব বস্তু বিধ্বস্ত হলে তা কখনোই বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ভূমিকম্পের সৃষ্টি করে না।
সবচেয়ে ভয়ংকর চিন্তাটি করেছেন যে বিশেষজ্ঞ, তিনি বসেছেন সবার বামে। তাঁর ধারণা, দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা চালিয়েছে কোনো দেশ এবং এই বিষয়টা এখনও কেউ বুঝে উঠতে পারেনি! অন্য কোনো দেশ এ অঞ্চলে নতুন কোনো অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়ে থাকতে পারে বলে তিনি অভিমত দিলেন। এই বিশেষজ্ঞের চারিত্রিক গাম্ভীর্যের কারণে তাঁর মতামত নিয়ে আলোচনা চলতে থাকল।

আলোচনা আর ভালো লাগছে না। আশরাফ সাহেব চ্যানেল বদলালেন। একটি চ্যানেলে লাইভ প্রোগ্রাম হচ্ছে। আজকের অতিথিকে সবাই ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনাটি নিয়ে প্রশ্ন করছে। তিনিও সবজান্তার মতো মুখভঙ্গি করে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। হঠাৎ এক দর্শক টেলিফোন করে অতিথিকে বলে বসলেন, ‘ভাই, যদি কিছু মনে না করেন একটা প্রশ্ন করতে চাই।’
‘অবশ্যই। বলুন, কী জানতে চান?’ অতিথির মুখে টানটান হাসি।
‘আপনার মতো একটা চীজরে এরা কত টাকা দিয়ে ভাড়া করছে? আমি এদের আরও বেশি …।’
দর্শকটির কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোনলাইন কেটে দেওয়া হলো।
আশরাফ সাহেবও চ্যানেল বদলালেন। নতুন এই চ্যানেলে এলিয়েনের সাজে সজ্জিত হয়ে কয়েকজন নৃত্য পরিবেশন করছে। নাচটি আগে কোনো অনুষ্ঠানে প্রচার করা হয়েছিল। এখন পরিস্থিতির কারণে পুনঃপ্রচারিত হচ্ছে। নাচ দেখতে আশরাফ সাহেবের বরাবরই বিরক্ত লাগে। তিনি চ্যানেল বদলালেন।
এবারের চ্যানেলে এক তরুণ কবি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করছেন,
‘ওগো পরগ্রহী,
ওগো সুহাসিনী এলিয়েন,
ওরে আমার এলু,
আমি এসেছি সমুদ্র তীরে,
আজ তোমাকে ঘিরে …।’
কবিতার লাইনগুলো শোনামাত্রই আশরাফ সাহেবের মেজাজ বিগড়ে গেল। তিনি টিভি বন্ধ করে দিলেন। মোবাইল ফোন নিয়ে ধ্রুবকে আবার কল করলেন। ফোন বন্ধ। তিনি বেশ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠছেন। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল দেশে, পুরো পৃথিবীর টনক যেটাতে নড়ে উঠেছে, সেখানে তার ছেলে নিজের খবর জানানোর জন্যও তো একবার ফোন করতে পারে!
আশরাফ সাহেব জানেন যে তার আঁতেল ছেলের মাথায় পড়াশোনা ছাড়া কিছুই ঢোকে না, তাই তিনিও তাকে দুনিয়াদারি নিয়ে বকাঝকা করেন না। ছেলে তার নিজের ভুবন নিয়ে থাকে। সমাজের কোনো উপকার করতে না পারুক, ক্ষতি তো করে না! আজ যদি তার ছেলে বড় কর্মকর্তা হয়ে প্রতিদিন ঘুষ খেয়ে ধেইধেই করে নাচতে নাচতে এসে গলা জড়িয়ে ধরত, তাতে কি তার খুব ভালো লাগত? দুর্নীতিবাজ-ঘুষখোরগুলোই দেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করছে। তার ছেলে কিছুটা অসামাজিক বটে; কিন্তু মানুষ হিসেবে ভালো। তাই বলে বেশি খামখেয়ালিপূর্ণ হওয়াটাও ভালো না।

ছেলের চিন্তায় আশরাফ সাহেব বেশ বিচলিত হয়ে উঠেছেন। বড় কোনো দুর্ঘটনাও তো হতে পারে; কিন্তু তেমন চিন্তা তিনি কিছুতেই মনের মধ্যে আনতে চান না। ছেলেটা ঠিকঠাক সুস্থ থাকলেই হলো- মনে মনে আল্লাহ্র কাছে শুধু এই প্রার্থনাই করছেন।
হঠাৎ আশরাফ সাহেবের মোবাইল বেজে উঠল। ধ্রুবর ফোন। আশরাফ সাহেবের রাগে ফেটে পড়ার কথা; কিন্তু তিনি খুব শান্তভাবে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই ঠিকঠাক আছিস তো বাবা?’
‘হ্যাঁ আব্বু, কিন্তু কী হয়েছে? ঠিক থাকার কথা জিজ্ঞেস করছ যে!’
‘কেন এত বড় ভূমিকম্প হলো, তুই টের পাসনি?’
‘আসলে ওটা …।’
ধ্রুবর কথা শেষ হওয়ার আগেই আশরাফ সাহেব তার স্ত্রীর কাছে মোবাইল সেট দিলেন। ধ্রুবর মা তার ছেলের সঙ্গে কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন। ফোন বন্ধ করে রাখায় ধ্রুব আম্মার কাছে খানিক বকা হজম করল। আসলে মোবাইল সেট ধ্রুবর কাছেই ছিল; কিন্তু তাতে যে চার্জ ছিল না সেটা সে রুমে ফিরে গিয়ে খেয়াল করেছে।

৫.
ভূমিকম্পের পরদিন বিকেল বেলা। বাইরে ঠা ঠা রোদ পড়েছে। ধ্রুব নিজের রুমে গবেষণার কাজ করছে। বাইরের গরমের হলকা রুমের ভেতরের পরিবেশও অস্বস্তিকর করে রেখেছে। এত কিছুর পরও রুমের ফ্যান চলছে না। আসলে ধ্রুব খেয়ালই করেনি যে ফ্যানটা বন্ধ। ঠাণ্ডা-গরম বা ক্ষুধা-তৃষ্ণার অনুভূতিগুলো তাকে খুব একটা বিচলিত করে না; বরং কেউ মনে করিয়ে দিলে সে বিরক্ত হয়। তিনবেলার জায়গায় একবেলা খাওয়ার সিস্টেম থাকলে সে কাজের জন্য আরও বেশি সময় পেত। ঘুমের ব্যাপারটা না থাকলে তো আরও ভালো হতো। লাইফের ওয়ান-থার্ড নষ্ট হয়ে যায় ঘুমের কারণে!
ধ্রুবর রুমের দরজায় কেউ একজন টোকা দিচ্ছে। বিরতি দিয়ে দিয়ে দুটো করে টোকা। নিশ্চয়ই তূবা এসেছে। এখানে তূবা ছাড়া কেউ আসে না। আর সে এভাবেই দরজায় টোকা দেয়। তবে এবার তূবা বেশ কয়েক সপ্তাহ পর এল। ধ্রুব উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল।

‘আপনার আবিষ্কার সম্পর্কে জানতে চলে এলাম।’ ধ্রুবর মতো কোনো ভূমিকা ছাড়াই কথাটি বলল তূবা। তূবার কথায় ধ্রুব বেশ আগ্রহী হয়ে উঠল। গবেষণার বিষয়ে কেউ জানতে চাইলে বা গবেষণা নিয়ে কোনো কথা বললে তার ভালো লাগে। সে একটা চেয়ার টেনে তূবাকে তার গবেষণার টেবিলের কাছে বসতে দিল। তারপর টেবিলের ওপর রাখা অদ্ভুত যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে সোৎসাহে বলল, ‘আমি এই যন্ত্রটা তৈরি করেছি।’
তূবা যন্ত্রটির দিকে ভালোভাবে খেয়াল করল। ছোট ছোট পাইপের টুকরা খাড়া করে একটা হার্ডবোর্ডের ওপর আটকানো। ইনপুটের জন্য কিছু বাটনও যন্ত্রটিতে দেখা যাচ্ছে। তার পাশে একটা ডিসপ্লে ইউনিটও আছে। তাছাড়া নানারকম আইসি, মোটর, একটি বড়সড় ‘রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অসিলেটর’ বিক্ষিপ্তভাবে হার্ডবোর্ডের ওপর বসানো। সেসব যন্ত্রাংশ কেবল দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। যন্ত্রটির অ্যাপিয়ারেন্স দেখে তূবার মোটেও পছন্দ হয়নি; কিন্তু সেটা সে ধ্রুবকে বুঝতে দিল না। আগ্রহ নিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কী কাজে লাগে?’

‘আমি এই যন্ত্রের নাম দিয়েছি অনুনাদী বাঁশি। গতকালকে যে ভূমিকম্প হয়েছিল, তা এই অনুনাদী বাঁশিরই সথষ্টি।’
‘মানে?!’ তূবা একেবারে আকাশ থেকে পড়ল! বলে কী ছেলেটা!
‘মানে এই যন্ত্র দিয়ে অনুনাদ সৃষ্টি করে মাটির তলের শিলাস্তরগুলোকে ভয়ংকরভাবে নাড়াচাড়া করা যায়; এভাবে ভূমিকম্প সৃষ্টি করা যায়।’
তূবার মুখ থেকে কোনো কথা বেরোচ্ছে না। ধ্রুব খুব স্বাভাবিকভাবে ব্যাখ্যা করে চলল, ‘তুমি বোধ হয় জানো যে ভূ-ত্বকের তিনটি স্তর আছে: অশ্মমণ্ডল, গুরুমণ্ডল ও কেন্দ্রমণ্ডল। একেবারে ভূ-পৃষ্ঠের কাছে রয়েছে অশ্মমণ্ডল, তারপর গুরুমণ্ডল এবং সবশেষে কেন্দ্রমণ্ডল।’
‘হ্যাঁ, এটা জানি, স্কুলে থাকতে পড়েছিলাম।’
‘ভেরি গুড! তারপর শোনো, ভূ-ত্বকের গুরুমণ্ডল স্তরটির ঠিক পরেই অর্থাৎ কেন্দ্রমণ্ডলের বাইরের পরিধিতে উত্তপ্ত খনিজ তরলে, কঠিন শিলার বিশাল বিশাল স্তর ঝুলন্ত সেতুর মতো ঝুলে রয়েছে। শিলাস্তরগুলো পাউরুটির স্লাইসের মতো দেখতে। প্রতিটি বিশালাকৃতির শিলার স্লাইসের জায়গায় জায়গায় রয়েছে শিলা দিয়েই গঠিত বীম আকৃতির কাঠামো যেগুলো গুরুমণ্ডলের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আটকে থাকে।’

তূবার বিস্ময় এখনো কাটেনি। বিস্ময় নিয়েই তূবা বলল, ‘কিন্তু এত ছোট্ট একটা যন্ত্র দিয়ে ভূমিকম্প কিভাবে ঘটানো সম্ভব?’
ধ্রুব খুব আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘সেই ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং! তুমি নিশ্চয়ই স্কুলে এটাও পড়েছিলে যে প্রতিটি ঝুলন্ত বস্তুর একটা নির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক থাকে। যেমন: ঝুলন্ত সেতু। ঝুলন্ত সেতুর ওপর দিয়ে কোনো সৈন্যদল মার্চপাস্ট করে গেলে সেতু ভেঙে পড়তে পারে। সৈন্যদলের চলার ছন্দের কম্পাঙ্ক যদি ঝুলন্ত সেতুর প্রাকৃতিক কম্পাঙ্কের সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে অনুনাদ সৃষ্টি হয়। সে সময় সেতু ভয়াবহভাবে দোলার ফলে অনেক ক্ষেত্রে ভেঙে পড়ে।’
‘এগুলো তো পড়েছিলাম, এখন মনে পড়ছে। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে ভূমিকম্পের সম্পর্ক কী?’
তূবার আগ্রহ দেখে ধ্রুব ব্যাখ্যা করায় আরও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল, ‘অন্যসব ঝুলন্ত বস্তুর মতো মাটির নিচের ঝুলন্ত শিলার স্লাইসগুলোরও দৈর্ঘ্য অনুযায়ী রয়েছে একটি করে নির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক। এই কম্পাঙ্ক মানুষের শ্রাব্যতার উচ্চসীমারও অনেক ওপরে। আমার এই অনুনাদী বাঁশি আমি মেঝেতে স্পর্শ করে অতি উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ উৎপন্ন করি। যেহেতু কঠিন পদার্থের মধ্য দিয়ে শব্দ সবচেয়ে দ্রুতগতিতে চলাচল করে, তাই উৎপন্ন শব্দ অতি দ্রুত ভূ-ত্বকের অশ্মমণ্ডল, গুরুমণ্ডল পার হয়ে ওই ঝুলন্ত শিলার স্লাইসে পৌঁছে যায়। তারপর আড়াআড়ি পথ অতিক্রমের সময় যখনই এমন ঝুলন্ত শিলা পায় যার প্রাকৃতিক কম্পাঙ্ক উৎপন্ন শব্দের কম্পাঙ্কের সমান, তখনই অনুনাদের সৃষ্টি হয়। অনুনাদের কারণটা আমি একটু আগেই বলেছি, সেটা হলো: কোনো ঝুলন্ত বস্তুর প্রাকৃতিক কম্পাঙ্ক আর তার ওপর প্রয়োগকৃত বলের কম্পাঙ্ক সমান হলে অনুনাদ বা রেজোন্যান্স সৃষ্টি হয় এবং ঝুলন্ত বস্তুটি প্রচণ্ড বিস্তারে দুলতে থাকে, এমনকি ভেঙেও পড়তে পারে। এক্ষেত্রেও ঝুলন্ত শিলাস্তর প্রচণ্ড বিস্তারে দোলা শুরু করে। অনেক ক্ষেত্রে নিজে তো ভেঙে পড়েই, আশেপাশের শিলার স্লাইসগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে বা ভেঙে ফেলে। ফলে ভূ-ত্বকে ভূমিকম্প হয়।’

তূবা হাঁ করে খানিকক্ষণ ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে রইল। কী ভয়ংকর একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছে ছেলেটা! ধ্রুব বলে চলল, ‘কোয়েক ক্যাচার নেটওয়ার্ক বা কিউসিএন বা ভূমিকম্প নিরূপক নেটওয়ার্ক দিয়ে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। কিন্তু বুঝতেই পারছ, এক্ষেত্রে ভূমিকম্পের উৎপত্তির প্রক্রিয়া শুরুর সময় এবং ভূমিকম্প সংগঠিত হওয়ার সময়ের ব্যবধান খুবই কম। তাই “কোয়েক ক্যাচার নেটওয়ার্ক” দিয়েও এই ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হবে না।’
তূবা ধ্রুবকে বলল, ‘আপনার এই আবিষ্কারের কথা যদি আমেরিকা বা বড় কোনো দেশ জানতে পারে, তাহলে আপনাকে নির্ঘাত নিজেদের দখলে নিয়ে নেবে। আপনার এই যন্ত্রটা তো পারমাণবিক বোমার চেয়েও ভয়ংকর অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগানো যায়। যেকোনো দেশই এটা তৈরির কৌশল হাতে পেতে চাইবে!’
‘তূবা, তুমি যতটা কল্পনা করছ, এই যন্ত্রটির ব্যবহারিক পরিধি কিন্তু তার চেয়েও লক্ষ-কোটি গুণ বিশাল!’
‘ঠিক বুঝলাম না! একটু বুঝিয়ে বলেন।’

‘তুমি জানো যে গ্রহ, উপগ্রহ, এমনকি গ্যালাক্সিসহ মহাবিশ্বের সবকিছুই ঝুলন্ত বস্তু। এবং আমার ধারণা পুরো মহাবিশ্বটাও ঝুলন্ত! তাই ঝুলন্ত গ্রহ-নক্ষত্রের যেমন একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক আছে, তেমনি সমগ্র মহাবিশ্বের নিজেরও একটি সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক কম্পাঙ্ক আছে। কোনোভাবে যদি সেই কম্পাঙ্ক জেনে যাওয়া যায় এবং এই অনুনাদী বাঁশি দিয়ে একই কম্পাঙ্কের শব্দ সৃষ্টি করা যায়, তাহলে পুরো মহাবিশ্বের গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র-ধূমকেতু ইত্যাদি যাবতীয় বস্তু ভয়ংকর অনুনাদের ফলে দুলতে থাকবে। এক মহাজাগতিক বস্তু আরেকটির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে অকল্পনীয় ধ্বংসলীলার সৃষ্টি করবে। সোজা কথায়, পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই ধ্বংস হয়ে যাবে!’

ধ্রুব তার কথার সঙ্গে যোগ করল, ‘তবে আমার বিশ্বাস, মহাবিশ্বের সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক কম্পাঙ্ক এত বেশি বড় হবে যে তা কোনো অনুনাদী বাঁশি তৈরি করে উৎপন্ন করা সম্ভব হবে না।’
কথাগুলো বলে ধ্রুব খ্বু আগ্রহ নিয়ে তূবার দিকে তাকাল। কিন্তু তূবার মুখটা বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছে। সে বেশ ভারী গলায় বলল, ‘অনুনাদী বাঁশি এত ক্ষতিকর জেনেও আপনি কেন এটা তৈরি করলেন?’
‘আমি আসলে ভেবেছিলাম থিওরিটিক্যালি সম্ভব হলেও অনুনাদী বাঁশি দিয়ে কোনো-না-কোনো কারণে প্র্যাকটিক্যালি ভূমিকম্প ঘটানো সম্ভব হবে না। আমার নিজের কাছেও ব্যাপারটা ভীষণ অবাক লাগছে, সত্যিই ভূমিকম্প ঘটানো সম্ভব হয়েছে!’

এসব শুনে তূবা আরও গম্ভীরভাবে বলল, ‘আপনি কি মানুষের কল্যাণ চান?’
হঠাৎ এমন প্রশ্নে যেকোনো মানুষই অবাক হয়ে যাবে। কিন্তু ধ্রুব অবাক হলো না। কারণ ছেলেটা এমনই। কখন কী বলতে হয়, কখন কী করা উচিত- এসবে তার ধারণা ও উৎসাহ নেই। সে হাসিমুখে বলল, ‘হুমম’।
‘তাহলে আমার জন্য আপনাকে একটা স্যাক্রিফাইস করতে হবে।’
‘কী?’
তূবা গলাটাকে আরও গম্ভীর করে বলল, ‘অনুনাদী বাঁশিটা ধ্বংস করে ফেলতে হবে।’
‘কী বলছ!’
ধ্রুবর খুব মন খারাপ হয়ে গেল। ছেলেটা রাগতে শিখেনি। কিন্তু কোনো কষ্ট পেলে তার মন খুব খারাপ হয়ে যায়। সে মৃদুস্বরে জানতে চাইল, ‘কিন্তু কেন তুমি এটা বলছ, তূবা?’

‘আমি চাই না মানুষ আপনাকে ঘৃণা করুক। পারমাণবিক বোমা যিনি তৈরি করেছিলেন, তাকে কে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে? অথচ এডিসনকে আমরা আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি! আমি চাই না, আপনাকে কেউ ঘৃণাভরে স্মরণ করুক। বাবা-মায়েরা সন্তানদের নিয়ে হেসেখেলে আনন্দে দিন কাটাচ্ছে, এর চেয়ে বড় স্বর্গীয় দৃশ্য আর কী হতে পারে! কিন্তু কোনো আবিষ্কারের জন্য সবাই যদি আতঙ্কে দিন কাটায়, তাহলে তা আবিষ্কার করাই উচিত না। আপনার এই আবিষ্কারের জন্য মানবজাতি নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে; এমনকি মহাবিশ্ব পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। প্লিজ আপনি মানুষের কল্যাণে কাজ করুন।’
তূবার কথাগুলো শুনে ধ্রুবর ভালো লাগল। প্রকৃতির এক বিচিত্র রহস্য আবিষ্কার করে ধ্রুব এতটাই উচ্ছ্বসিত ছিল যে গভীরভাবে অন্য দিকগুলো ভাবেনি। তূবা ঠিকই বলেছে। ধ্বংসাত্মক অনুনাদী বাঁশিটাই ধ্বংস করে ফেলতে হবে। ধ্রুব জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে অনুনাদী বাঁশিটা এখন কী করব?’
‘বাঁশিটা আপনি ফেলে দেবেন। দুই নম্বর রোড দিয়ে আসার পথে যে কাটা পাহাড়টা আছে, তার অপর পাশে এখনও ঘন জঙ্গল। সেখানে সাপ ও শেয়ালের ভয়ে কেউ যায় না। আপনি বাঁশিটা সেই জঙ্গলে ফেলে দেবেন। আমিও যাব আপনার সঙ্গে। আজকে সন্ধ্যার পর আমি আর আপনি কাটা পাহাড়ে উঠব। তারপর আপনি নিজের হাতে এই যন্ত্রটি জঙ্গলের দিকে ছুড়ে মারবেন।’
ধ্রুব দ্বিধাহীনভাবে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

৬.
ধ্রুব এবং তূবা দক্ষিণ খুলশীর কাটা পাহাড়ের মাথায় উঠে এসেছে। উঠতে বেশ সময় লাগে, কিন্তু ওঠার পথ খাড়া না হওয়ায় কষ্ট কিছুটা কম হয়। আকাশে হালকা হলুদ রঙের বিশাল চাঁদ, সচরাচর এমন চাঁদ দেখা যায় না। চাঁদটা শুক্লপক্ষ বা কৃষ্ণপক্ষের না বলে হলদেপক্ষের বললেও খুব একটা ভুল হবে না! কাটা পাহাড়ের মাথায় উঠলে দূর থেকে শহরের বেশ খানিক অংশ দেখা যায়। তবে শহরের কোনো কোলাহল বা শব্দই এখান পর্যন্ত আসে না। এখানে শুধু শোনা যায় ঝিঁঝি পোকার ডাক আর মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাক।
বাতাসের তোড়ে গরম বোঝা যাচ্ছে না ততটা। নির্জন এই পাহাড়টাকে শহরের বুকে এক টুকরো স্বর্গও বলা যেতে পারে। ধ্রুবকে দেখে মনে হচ্ছে সে একটা মিশনে এসেছে। মিশন সাকসেসফুল হলে এখান থেকে চলে যেতে পারলে বাঁচে। পরের দিকনির্দেশনার জন্য সে তূবার দিকে তাকাল। তূবা মৃদুস্বরে বলল, ‘কী সুন্দর একটা জায়গা! এখানে না আসলে কোনোদিন টেরও পেতাম না!’

‘এখন কী করব? অনুনাদী বাঁশি কি ফেলে দেব?’
‘দিন, ফেলে দিন। নিচের ওই দিকটার জঙ্গল অনেক ঘন মনে হচ্ছে। যত জোরে পারেন, ওই দিকে ছুঁড়ে মারেন।’
ধ্রুবর কমনসেন্স একটু কম হলেও গায়ে ভালোই জোর! অনুনাদী বাঁশিটা সে অনেক দূরে ছুঁড়ে মারতে পেরেছে। পাহাড়ের নিচে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা ঘন জঙ্গলের মধ্যে পড়েছে সেটা। হয়তো কয়েক বছর পর এই জঙ্গল কেটে জনবসতি তৈরি হবে। তখন কেউ হয়তো অনুনাদী বাঁশিটি খুঁজে পাবে। মজার খেলনা ভেবে খেলার চেষ্টা করবে। খেলতে না পেরে সেও হয়তো ফেলে দেবে অন্য কোথাও। বা হয়তো ভাঙারির দোকানে যন্ত্রটা বেচে, সেই টাকায় কটকটি কিনে খাবে!
তূবা এবং ধ্রুব কাটা পাহাড়ের ওপরে ঠিক মাঝখানের খোলা সমতল জায়গায় বসল। তূবার মনে ভীষণ আনন্দ। ধ্রুব আজকে যত বড় স্যাক্রিফাইস করল, একজন মানুষ নিজের চেয়ে পৃথিবীর অন্যসব মানুষকে অনেক বেশি ভালো না বাসলে, তত বড় স্যাক্রিফাইস করা সম্ভব না!

তূবা বলল, ‘একটা মজার ব্যাপার জানেন?’
‘কী?’
‘শুনেছি ভূমিকম্পের পর কেউ কেউ বলেছে, আকাশ থেকে নাকি আগুনের কুণ্ডলী পড়েছে। কত সহজে কত দ্রুত অলীক কাহিনি তৈরি হয়ে যায়! সেখানকার লোকেরা এবং তাদের বংশধরেরা যুগ যুগ ধরে সেই কাহিনি শুনে কত কী কাণ্ড করবে!’
‘আমি শুনেছি টেলিভিশনেও নাকি আন্দাজে অনেকে অনেক কথা বলেছে!’
তূবা ধ্রুবকে বলল, ‘আপনার আপুর বিয়ে কবে? আর আপনি বিয়ে করবেন কবে?’
‘তোমাকে না বলেছি, আমি দুই নাম্বার।’
‘আপনি আসলেই একটা দুই নাম্বার!’
তূবা কথাটি বলামাত্রই দুজনে একসঙ্গে শব্দ করে হেসে উঠল। সেই হাসির শব্দ যেন ছড়িয়ে পড়ল দূর থেকে দূরান্তে। দুঃখ-কষ্টের এই পৃথিবীতে এমন অনাবিল আনন্দের ছোট ছোট মুহূর্ত আছে বলেই মানুষের বেঁচে থাকার আগ্রহ অটুট থাকে!

Share.

মন্তব্য করুন