গহীন জঙ্গলের শেষ মাথায় ছিল এক ভয়ঙ্কর ডাইনীর আস্তানা। বাড়িটির বাইরে থেকে দেখে কেউ বুঝতেই পারতো না যে এখানে একটা রহস্যময় জায়গা আছে। তবে হ্যাঁ শুধু একজন জানতো। সে হলো ছোট্ট আর নীল একটা প্রজাপতি। আলো ফোটার সাথে সাথে দু’পাখা কাঁপিয়ে শুরু হোত তার দুরন্ত ওড়াউড়ি। বনান্ত পেরিয়ে ঝর্ণার ধার দিয়ে, একেবারে পাহাড়ের ওধার পর্যন্ত ছিল তার যাওয়া-আসা। বন-পাহাড়ের সবাই এই দুরন্ত প্রজাপতিটিকে চেনে, জানে। ওর মতো এতো ছোটোছুটি আর…আর খবর জোগানের নেশা এ অঞ্চলের আর কারো নেই।
পাশের গাঁয়ের ছোট্ট ছেলে-মেয়েরা এই বনে পাতা কুড়াতো। ঝাড়– আর বস্তা নিয়ে রোজ বনে আসে ওরা। ঝরা পাতা আর খড়কুটো কুড়িয়ে ওদের দিন কাটে। প্রজাপতিটির সাথে ভাব হয়ে যায় ছেলে-মেয়েগুলোর।
ঐ রহস্যময় বাড়ির বাইরেও পড়ে থাকতো প্রচুর ঝরা পাতা আর শুকনো খড়কুটো। সবকিছুই দেখতো প্রজাপতিটা। খেয়ালও করতো। মাঝে-মাঝে সাবধানও করে দিতো সবাইকে। যে বিশ্বাস করতো শুনতো কথা, যারা ওর কথা বিশ্বাস করতো না তারা হেসে উড়িয়ে দিতো।

একদিন বাচ্চাগুলো ঝর্ণার পানি খেতে এসে দেখলো অনেকগুলো শিশুহরিণ পানিতে খেলা করছে পাহাড়ের ধার ঘেঁষে। ঝোপ-ঝাড়ে দলবেঁধে খেলা করছে ঝাঁক ঝাঁক গঙ্গা ফড়িং। অতিথি পাখিরা সারিবদ্ধ হয়ে উড়ে যাচ্ছে পাহাড়ের ওপার দিয়ে। চলে যাচ্ছে সমুদ্রের ওধারে।
বাচ্চাগুলো মুগ্ধ হয়ে ওদেরকে দেখে আর খুশিতে হাততালি দেয়। ওদের সাথে আনন্দে ভাগ নেয় প্রজাপতিটিও। কিন্তু সে এটাও জানে যে এই আনন্দই সবকিছু নয়।
সুযোগের অপেক্ষায় আছে সেই ডাইনী। এর আগেও বহু ঘটনা ঘটেছে। যারাই না জেনে ডাইনীর আস্তানার কাছাকাছি এসেছে তাদের আর কোন খবর পাওয়া যায়নি। সবাইকে বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে নীল প্রজাপতিটি। সবই টের পায় ডাইনী। সে বুদ্ধি খুঁজতে থাকে কি করে প্রজাপতিটিকে জব্দ করবে? কারণ এই চঞ্চলপাখা প্রজাপতিই একমাত্র জানে এই ডাইনির অবস্থানের রহস্য। জানে অতীতের ঘটনা। আর এই ডাইনীর জন্যেই প্রজাপতি আজ একা। স্বজনহারা।
ভাবতে ভাবতে কাজলকালো চোখ দু’টো ভিজে আসে ওর।
সেদিন ছিল বসন্তের এক বিকেল।
আকাশের মেঘেতে যেমন রঙের মেলা, তেমনি বনের একপ্রান্তে বিশাল ফুলের বাগান। নানান রঙ্গের বাহারী ফুলে ছেয়ে গেছে চারিদিক।
কখন আর কেমন করে এতো বড় বাহারি ফুলের বাগান এলো এই বনে… ?
হাজার রকমের লতাপাতা আর রঙিন ফুলে যেন ছেয়ে গেছে বনময়। আর…আর এক অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধে মৌ মৌ করছে চারিদিক।

প্রজাপতিটি তখন খুবই ছোট। অনেক কিছু দেখলেও বুঝতো না। নতুন উড়তে শিখলে যা হয়। মনের আনন্দে দু’পাখা মেলে কোথায় কোথায় যে উড়ে বেড়াতো।
মা অনেক বকতো। বলতো কোনদিন যে হারিয়ে যাবি পথভুলে। আর বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে পাবি না।
মায়ের কথা শুনে হাসি পেতো ওর। ভাবতো পথ আবার হারায় কি করে ? মাঠ ঘাট বন প্রান্তর সবই তো ওর ভীষণ চেনা। আর হারালেই বা কি? অনেক উঁচুতে উঁঠে ঠিকই খুঁজে নেবে ওর বাড়ি ফেরার পথ।
আসলে সেই সময় একেবারেই ছেলেমানুষ ছিল সে।
ঠিক কি হয়েছিল সেদিন ?
ঐ মিষ্টি সুবাসের রঙিন বাগানে জমতে লাগলো শত শত রঙিন প্রজাপতি। প্রস্তুতি চলছিল যেন কোন এক মহোৎসবের। সবাই অর্থাৎ সব প্রজাপতিরা যেন নেশার মতো পান করছিল অজস্র ফুলের মধু।
সে যেন এক অন্য রকম এক ছবি…।
দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো, অন্ধকার হয়ে এলো চারিদিক। ঘরে আর ফেরা হলো না সেই শত শত প্রজাপতিদের। দূরে ছিল এই নীল প্রজাপতিটা। সন্ধ্যায় দলের অন্য সব প্রজাপতিদের ঘরে ফিরে না আসায় খুব চিন্তিত হলো সে। একাকী খুব ছটফট করতে লাগলো সারা রাত। পরদিন খুব ভোরেই বনের শেষ প্রান্তে চলে এলো উড়ে উড়ে। নাহ্ কেউ কোথাও নেই। কিন্তু সেই বাহারী ফুলের বাগান কোথায়? কোথায় সেই ঝাঁক ঝাঁক প্রজাপতিদের ফুলের মধু খাওয়ার উৎসব? আস্তানায়ও তো ফেরেনি কাল কেউ…।
কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে পারে না নীল প্রজাপতি…! কিন্তু ওকি ! দূরে একটা বড় জাল পড়ে আছে…! অনেকটা বনের বাইরে ।

কিছুতেই বুঝতে পারছে না নীল প্রজাপতি। মন খারাপ করে একা একাই বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগলো সে। এক সময় পাতা কুড়ানো বাচ্চারাও আসলো খড়ি কুড়োতে।
আর, আর ওদের সাথেও আজ খেলতে ইচ্ছে করলো না ওর। ঝর্ণার ধার ঘেঁষে হরিণগুলো খেলা করছে…। কুয়াশা মাখা সবুজ পাহাড়ের ওপারটার অনেকটা দেখা যায়…। তার উপরে নীল আকাশে … মেঘের আনাগোনা আর কিছু …?
নাহ্।
আর কিছু ?
আর কিছু তো যায় না দেখা…।
কতো !
আর কতো ওপরে উঠবে নীল প্রজাপতি ?
কতো খুঁজবে তার আপনজনদের?
নাহ্, আর যেন পারে না সে।
আনমনে কোথায় যেন উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছিল নীল প্রজাপতিটি।
এমনি সময় কে যেন ওর নাম ধরে ডাকলো দূর থেকে।
থমকে গেল নীল প্রজাপতির উড়ে চলা। আবার, আবার, আবারো ডাকলো কে যেন।
বলল-
: একটু পেছন ফিরে সবচেয়ে উঁচু গাছটার কাছে এসো। আমি সেখানে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি কিছু বলবার জন্যে।
: কিছু বলবার জন্যে ?
: আমাকে! কে তুমি?
কাছে এসোই না। বলছি।
বিস্মিত নীল প্রজাপতি।
বলল-
: কাছে আসবো ? আর কতো কাছে ?
: কোথায় তুমি ? আমার সাথে ছলনা করছো না তো ?
অপর কণ্ঠ বলল-
: আরে না রে না। তোমার মতো এতো লক্ষ্মী আর সুন্দর নীল প্রজাপতির সাথে কি কেউ ছলনা করতে পারে ?
: সত্যি ?
: হ্যাঁ। এইতো এসে গেছো এই যে এখানে। নীল প্রজাপতি দেখলো বনের সব চেয়ে উচুঁ গাছের ডালে ঘনপাতার আড়াল থেকে ওকে ডাকছে একটি বয়স্ক বড় জাতের অদ্ভূত এক পাখি। নাম যার ব্যঙ্খমী।
নীল প্রজাপতি কাছে আসতেই ঝট করে ওকে পাতার আড়ালে লুকিয়ে দিল ব্যঙ্খমী।
একটু যেন ভয় পেল প্রজাপতি…।
বলল-
: কি করছো ?
ব্যঙ্খমী বলল-
: পাতার আড়ালে লুকিয়ে পড়ো না হলে ডাইনী তোমায় দেখে ফেলবে-
: ডাইনী !
ব্যঙ্খমী বলল-
: হ্যাঁ ডাইনী। সেই গোপন এবং গুরুত্বপূর্ণ খবরটা দেয়ার জন্যে এখানে ডেকেছি তোমাকে।
নীল প্রজাপতি বলল-
: বল তাড়াতাড়ি আমার আর তর সইছে না।
একবার চারদিকে খুব সাবধানে দেখে নিল ব্যঙ্খমী।
তারপর বলল-
: জানো তো এই দুষ্টুু ডাইনী এই অঞ্চলের প্রজাপতির বংশটাকে শেষ করে দিয়েছে।
: শেষ করে দিয়েছে!
বিস্মিত নীল প্রজাপতি।
ব্যঙ্খমী বলল-
: সেদিন ছিল বাসন্তী বিকেল। ডাইনী তার আস্তানার পাশে তৈরী করলো কৃত্রিম বাগান। যাতে ছিল মিষ্টি সুগন্ধে ভরা হাজারো জাতের ফুল। আর সেই গন্ধে এ অঞ্চলের সমস্ত প্রজাপতি ঐ যাদুর বাগানের ফুলে বসেছিল মধু খেতে।
তারপর?
: তারপর সেই ফুলের মধু খেয়ে ওদের আর ওঠা হয়নি। ডাইনী কৌশলে পুরো বাগানের ওপর সূক্ষè জাল ফেলে দিয়েছিল।
: বলো কি!
: হ্যাঁ এবং সেরাত্রেই হাজার হাজার প্রজাপতি আর ফুলের পাপড়ি মিশে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেলো জালের ভেতর। আমার মা লুকিয়ে প্রজাপতিদেরকে বাঁচাবার জন্যে জালটা খুলতে গিয়েছিল। কিন্তু পারেনি।
: তারপর ?
: তারপর আরকি ! ধরা পড়ে বন্দী হয়ে গেল ডাইনীর কাছে।
: আর ডাইনী কি করলো জানো ?
: কি করলো ?
: সেই ফুল আর প্রজাপতিদের গুড়ো মেশানো ধূলোতে ডুব দিয়ে হয়ে গেল অণ্য এক প্রাণী। সে ইচ্ছে মতো নিজের রূপ পরিবর্তন করতে লাগলো। কেউ ডাইনীর এই চালাকির কথা জানতো না। যার কারণে সে সবাইকে তার জ্বালে ফাঁসাতো।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো ব্যঙ্খমীর কথা শুনতে শুনতে কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল নীল প্রজাপতি, বুঝতে পারলো-
ঠিক এই কারণেই তার বাবা-মা আপনজনরা এবং এই অঞ্চলের সব প্রজাপতিরা নিখোঁজ হয়ে গেছে।
ব্যঙ্খমী বলল-
: ভাগ্যিস তুমি সবার সাথে ছিলে না।
তা না হলে…
প্রজাপতি কম্পিত কণ্ঠে বলল-
: তুমি আমাকে বল ব্যঙ্খমী, কি করলে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
: দুঃখে ভারাক্রান্ত ব্যঙ্খমীর মনটাও। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল-
: একটা উপায় আছে…
: আছে !
খুশিতে লাফিয়ে উঠলো নীল প্রজাপতি।
ব্যঙ্খমী বলল-
: ডাইনী আগুনকে খুব ভয় পায়। ওর আস্তানার চারিদিকে যদি আগুন লাগিয়ে দেয়া যায় আর তাও করতে হবে দিনের বেলায়। কারণ দিনের বেলায় সে ঘুমায়। আর রাতে থাকে জেগে। একটু যেন চিন্তিত হোল ব্যঙ্খমী।
বলল-
: কিন্তু কি করে সম্ভব ?
নীল প্রজাপতি ততোক্ষণে ভেবে নিয়েছে কি করতে হবে।

একদিন পাতা কুড়োনো বন্ধুদের ডাকলো।
বলল-
: দিনের বেলায় পুরো বনের পাতা জড়ো করতে হবে ডাইনীর আস্তানার চারিদিকে। দিনে ডাইনী ঘুমিয়ে থাকে ছোট্ট একটি ইঁদুরের রূপ ধরে। কেউ তাকে আর খুঁজে পায় না।
ঝর্ণার ধারে পানি খেতে আসা হরিণগুলোও এগিয়ে এলো এই অভিযানে। বনের খড়কুটোগুলো জড়ো করে, মুখে করে টেনে নিয়ে এলো নির্দিষ্ট জায়গায়। বনের বহু পশুপাখি যেতে যেতে কোথায় যে হারিয়ে যেতো কেউ-ই বুঝতে পারতো না। জানতো না ডাইনীর আস্তানার খবর। ব্যঙ্খমী না বললে নীল প্রজাপতিও জানতে পারতো না কোনদিন।

পরদিন সূর্য ওঠার অপেক্ষায় থাকলো সবাই। এক সময় রাতের অন্ধকার পার করে আলো উঁকি দিল। রাতের কালচে মেঘ সরে পূব আকাশে ছড়িয়ে পড়লো সোলানী আভা। সে আভা ছড়িয়ে পড়লো পাহাড়ের চূড়ো আর পুরো বনময়। ঝিলমিল করে উঠলো চারিদিক। সবচেয়ে উঁচু গাছের মগডালে বসে ব্যঙ্খমী চোখ রাখলো চারিদিকে। দেখলো-
নীল প্রজাপতির নেতৃত্বে গুটি গুটি পায়ে এগুচ্ছে সবাই। ডাইনীর আস্তানায় দিকে জড়ো করতে লাগলো-সব কিছু।
যতো খড়কুটো আর শুকনো ঝরাপাড়ায় স্তুপ।
তারপর…।
তারপর ঠিক তখন দুপুর। সূর্য একেবারেই মাথায় উপরে।
সবাই জানলো ডাইনী দিনে ঘুমায়। এবং সে আগুন ভয় পায়। যেন তার মৃত্যুদূত। তারপর খুব সাবধানে পাতা কুড়ানো বাচ্চারা আগুন ধরিয়ে দিল ডাইনীর আস্তানার চারদিকে।
আর…দেখতে দেখতে সে আগুন ছড়িয়ে পড়লো সারা বনময়…। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো সবকিছু। ধোঁয়ায় ঘোলাটে হয়ে গেল চারিদিক-আগুন জ্বালানো সেই কালো ধোয়া যেন আকাশকেও ছুঁয়ে গেল। বহুক্ষণ জ্বললো সেই আগুন। আবার শান্ত হয়ে গেল চারিদিক। তারপর সবাই মিলে ঝর্ণার পানি ছিটিয়ে দিল আগুনের ছাইগুলোর ওপর।

তখন গোধূলি লগ্ন।
সন্ধ্যার কিছু আগে-চারিদিকে অন্য এক আলো যেন ছড়িয়ে পড়লো সোনালী আভার মতো। হঠাৎ আলোয় ঝলকানির মতো এক আনন্দের ঢেউ এসে লাগলো বনে।
সবাই দেখলো ডাইনীর আস্তানায় ওখান থেকে রঙিন আলো ফুটে উঠেছে। আর তারপরেই অসংখ্য রঙিন প্রজাপতি বেরিয়ে উড়তে উড়তে ছড়িয়ে পড়লো পুরো বনময়। সবাই বুঝলো ধ্বংস হয়ে গেছে ডাইনীর অস্তিত্ব।
আবার গাছে গাছে পাখিরা নীড়ে ফিরে এলো। প্রজাপতিরা আবার বেরহোল ফুলের মধুর খোঁজে।
আর হরিণ ছানাগুলো আবার সেই ঝর্ণার পানিতে রোজকার মতো পানি খেতে আসবে।

ব্যঙ্খমীর মা ফিরে এলো সেই উঁচু ডালে-তার ব্যঙ্খমীর কাছে। আর সেই নীল প্রজাপতি? বনের পাতা কুড়োন ছোট্ট বন্ধুরা করে ফেললো যেন বিশ্বজয়। ছোট-বড় সে যেই হোক না কেন সৎসাহস, নিষ্ঠা, একাগ্রতা আর সৃষ্টিকর্তার প্রতি অগাধ বিশ্বাস সবাইকে লক্ষ্যে পৌঁছুতে সাহায্য করে।

Share.

মন্তব্য করুন