হঠাৎ গরুর গাড়িটা উল্টে গেলো। আমি কী দেখেছি। না দেখিনি। আমিতো ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম থেকে জেগে দেখি আমি মাটিতে পড়ে আছি। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমার ছোট দুই বোন কাঁদছে। তারা ব্যথা পেয়েছে। গাড়িতে অনেকগুলো খড় ছিলো। সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। গাড়িতে একজনই ছিলো মুরুব্বি। সম্পর্কে আমাদের চাচা। তিনি সবাইকে সান্ত¡না দিচ্ছিলেন। গাড়িতে আমরা পাঁচজন সবাই শিশু। সবাই থ্রি, ফোর, ফাইভে পড়ি। গাড়িতে কোনো ঘড়ি ছিলো না। ১৯৫৬ সালের কথাতো। তখন সবার হাতে ঘড়ি থাকতো না। যারা বড় চাকরি করতেন শুধু তাদের হাতেই ঘড়ি থাকতো। চরণদা এর মানে কি জানো। এর মানে হলো, যিনি আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন। আরেকটু অন্যভাবে বললে সফরের সর্দার, সফরের নেতা। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, এইতো ভোর হয়ে আসছে। এখন সুবহে সাদেক। একটু পরেই ফজরের আজান হবে। গাড়িটা ধীরে চলছিলো নইলে এতক্ষণ তো আমরা পৌঁছে যেতাম।

সুবহে সাদেক শব্দটা আমরা মনে দাগ কাটলো। আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। আমার বয়স তখন সাড়ে আট বছর। শব্দটা মুখস্থ করার চেষ্টা করলাম। মনে হলো সুবহে সাদেক শব্দটা আরো দু’বার শুনেছি।
চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম, গাড়োয়ান কোথায়? বললেন, গরুগুলো ভয়ে জঙ্গলে চলে গেছে। ওগুলোকে পোস্টকোট আলোতে গিয়েছে। নামটা শুনে কষ্টের মধ্যেও আমার হাসি পাচ্ছে। শুনে খুশি হবে কী না জানি না। ঐ বয়সে আমার শুধু হাসি পেতো। হাসতাম আর খালি জিজ্ঞেস করতাম। আমার প্রশ্নবাণে অনেকেই রাগ হয়ে যেতো।
আব্বাজান রাগ হতেন না। কিন্তু আম্মাজান রাগ হতেন। বলতেন, ওরা তোমার ওপর রাগ হতেন।
গাড়ি আগের মতো চলছিল না। ডানদিকের চাকার দিক থেকে ক্যাঁ ক্যাঁ আওয়াজ আসছিলো। কেনো আওয়াজ আসছিলো, সে প্রশ্ন করার কথা বারবার মনে আসছিলো কিন্তু করছিলাম না। চরণদা চাচা আবার কি মনে করেন।

ইমামবারার পাশ দিয়ে শালবন ঘেঁষে আমরা যখন এলাজউদ্দীনের বাড়ির সামনে দিয়ে এলাম তখন ভোরের নামাজ শেষ হয়ে গেছে। নামাজিরা মসজিদ থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসছে, চাচা লাফ দিয়ে মসজিদের দিকে ছুটে গেলেন। পসকট গাড়ি থেকে আমাদের নামিয়ে দেয়ার সময় উপস্থিত আত্মীয়স্বজনদের কি যেনো বললেন। আমার বোনেরা হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো। কেউ বলছে আমাদের গাড়ি উল্টে গেছিলো, কেউ বলছে আমার পিঠে অনেক লেগেছে, কেউ পায়ে, কেউ বলছে মাথায়। স্বজনরা পসকটকে ঘিরে ফেললো, বললো কী হয়েছে বল বল। একজন আবার দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার জোবেদকে ডেকে আনলো। মসজিদের উল্টো দিকেই জোবেদ চাচার ডাক্তার খানা। কেউ কেউ পসকট চাচাকে রাগারাগি করছিলো। আমি বাধা দিয়ে বললাম, চাচার তো কোনো দোষ নাই। খাদের মধ্যে গাড়ির চাকা পড়ে গিয়েছিলো, সে কারণেই গাড়িটা উল্টে গিয়েছিলো।
বিয়ের কারণে অতদূর বেড়াতে গিয়েছিলাম।

ফিরে এসে সব ভুলে গেলাম। সাতদিন ধরে খুব আনন্দ করলাম। মজার ব্যাপার হলো, এলাকার হিন্দু, বৌদ্ধ ও উপজাতিদের প্রথমদিন খাওয়ানো হলো। কারণ ওরা দাবি করছিলো, ওরা গরুর গোশত খাবে না। একই হাঁড়িতে গরুর গোশত ও খাসির গোশত পাক করলে ওরা আনন্দের সাথে বা আমাদের সাথে খেতে পারবে না। সত্যি সত্যি তাই করা হলো। বড় মসজিদ থেকে হাঁড়ি-পাতিল, ডেকচি গ্লাস, আনা হলো। পঞ্চাশটা ছাগল জবেহ করা হলো। একেকটা ছাগলের দাম মাত্র পাঁচটাকা ছয়টাকা। ছাগল জবাই করার সময় আমাদেরকে মসজিদের সামনে যেতে দেয়া হলো না। আমরা জানতে পারলাম না কি করে জবেহ করা হয়। যখন ধোয়া কাপড়ের মেলার বাঁশের মধ্যে ছাগলগুলোকে ঝুলিয়ে রাখা হলো, তখন আমরা খুব ভয় পেয়েছিলাম। যখন ছাগলের গায়ের চামড়া খোলা হচ্ছিলো। তখনো ছোট ছোট বাচ্চারা না দেখে বাড়ির দিকে দৌড় দিচ্ছিলো। কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য। আমি কী মনে করে যেনো ঐসবের ছবি আঁকছিলোম। ছবি তোলার জন্য ঐ সময় কোনো ক্যামেরা ছিলো না।

মসজিদের পাশে প্যান্ডেল টানানো হয়েছিলো। নিচে বাঁশের ধারা দিয়ে বিছানা পাতা হয়েছিলো। বালতিতে বালতিতে ছিলো চিকন চালের গরমভাত, খাসির গোশত বুটের ডাল পেঁয়াজ মরিচের সালাদ আর চালের রঙিন জর্দা।
মজার ব্যাপার হলো, প্লেট বা বাসন কোসন কিছু নেই। সবার সামনে একফুট বাই একফুট কলাপাতা ও নানা ধরনের গ্লাস তামা কাঁসা বিভিন্ন সাইজের গ্লাস দেয়া আছে। সাথে ছিলো বিভিন্ন ধরনের জগ। পঁচিশজন করে লাইন করা হলো। প্রথমে কিছু লোক সবাইকে ভাত বেড়ে দিলো এর পিছনে কিছুলোক সবাইকে ভাত বেড়ে দিলো, এর পিছনে কিছু লোক সালাদ ও লবণ বিতরণ করলো। এর পিছন পিছন যারা এলেন তারা হাত দিয়ে বালতি থেকে গোশত তুলে তুলে লোকদের কলাপাতায় রাখছিলো। কারো কারো হাতে দু’চারটা চামচও ছিলো। ডাল ও জর্দা সবই বালতি থেকে হাত দিয়েই বিতরণ করা হলো। আমরা ঘুরছিলাম। আর দেখছিলাম। বেশির ভাগ মানুষেরই গোশত চাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো ওরা যেনো অনেকদিন খাসির গোশত খায়নি।

পরের কয়েকদিন গরুর গোশতসহ মেহমানদারি করা হয়েছিল। এবং যতই দিন যাচ্ছিলো ততই উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হচ্ছিলো। এটা দেখে আমার ওই ছোট্টকালে খুব খারাপ লাগছিলো। প্রশ্নও করেছিলাম অনেককে।
কয়েকদিন পর ফিরে এসেছি আবার দেবীগঞ্জে। অল্প অল্প শীত পড়েছে। আমাদের বাসাটা ছিলো কাঠের মঞ্চের উপরে। সিঁড়ি বেয়ে রুমে ঢুকতে হতো। পাটাতনের নিচে এক মানুষ পরিমাণ ফাঁকা জায়গা ছিলো। আমাদের বাড়ির চারিপাশে ছিলো ঘন জঙ্গল।
একপাশে ছিলো ছোট একটি রাস্তা। যে রাস্তাটা পাথরের তৈরির বড় রাস্তার সাথে সংযুক্ত ছিলো। আব্বার পিয়ন মকবুল চাচা বলতেন তোমাদের ঘরের নিচে বাঘ, শূকর, শৃগাল বন্য বিড়ালসহ নানারকম পশু আশ্রয় নিতো রাতে মকবুল চাচা কেরোসিন তেলের ফাঁকা টিন পেটাতেন। প্রতি রাতেই পেটাতেন। উনি ক্লান্ত হয়ে গেলে অফিসের আরেক পিয়ন আলাউদ্দীন চাচা টিন পেটাতেন। তারা বলতেন টিন পেটালে বাঘ এদিকে আসতো না। ছুটির দিনে আমরা তিস্তা নদীতে গোসল করতে যেতাম।
আব্বার পিয়ন দুই চাচাই আমাদের সাথে থাকতেন।
নদীর পানি ছিলো আয়নার মতো পরিষ্কার।
নদীর তলদেশে ছিলো পাথরে বোঝাই। কত সুন্দর পাথর। মনে হতো কারা যেনো প্ল্যান করে পাথর জমা করে রেখেছে। আমরা বড় রাস্তার পাশে স্বচ্ছ পানিতে গোসল করতাম। আমাদের ঠিক উল্টো দিকে বাঘ-বাঘিনী ও বাঘের বাচ্চারা গোসল করতো। ওপার থেকে ওদের গোসলের দৃশ্য আমরা দেখতে পেতাম। বাঘ-বাঘিনীরা সাঁতরিয়ে আমাদের দিকে আসার জন্য চেষ্টা করতো। কিন্তু মাঝখানে নদীর খরস্রােতার জন্য আসতে পারতো না। স্রােতের মধ্যে পড়ে গেলে অনেক দূর চলে যেতো। বাগের বাচ্চারা চিৎকার করতো। ঐসব দেখে আমরা আনন্দে আপ্লুত হতাম। আমরা ভাই-বোনেরা কেউ দুষ্ট ছিলাম না। আমরা বাঘদেরকে ভয় পেতাম। মকবুল চাচা ও আলাউদ্দীন চাচা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমাদের যাতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হয় সেসবদিকে তারা খুব খেয়াল রাখতেন। স্থানীয় অধিবাসীরা ছিলো অধিকাংশই নৃ-গোষ্ঠী। তারা বন জঙ্গলেই থাকতো। তাদের ছেলে মেয়েদের কেউ কেউ দুষ্ট ছিলো। তারা ঢিল ছোড়ার চেষ্টা করতো। নদীতে মাছ মারতো, বাঘেদের একদম ভয় পেতো না। কিন্তু ওদের মুরুব্বিরা ওদের শাসন করতো। মাঝে মাঝে মাছও পাওয়া যেতো। খুব পরিষ্কার ঝকঝকে মাছ।

স্কুলে যেতাম মকবুল চাচার ঘাড়ে চেপে। মকবুল চাচা বলতেন, আমি আরবি ঘোড়া আর তুমি বাঙালি রাজপুত্র। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পায়ে চলা পথ ধরে দুই মাইল দূরে পাঠশালায় যেতে হতো। জঙ্গলের যে পাশ দিয়ে খুব সন্তর্পণে আমরা যেতাম যে পাশটিকে বলা হতো বাঘঝাড়। অর্থাৎ বাঘের জঙ্গল। একদিন খুব মজা করে যাচ্চি হঠাৎ বাঘের বাচ্চার চিৎকার শুনতে পেলাম। মকবুল চাচা চুপ করে একটা মোটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে গেলে। আমাকে একটি গাছের ডালে তুলে দিলেন, নিজেও উঠলেন। উঠে উঁচু আরেকটি ডালে আমাকে বসিয়ে দিলেন। পকেট থেকে দূরবীন দিয়ে চারদিক দেখতে লাগলেন। চারদিক থেকে আওয়াজ আসতে ছিলো বাঘের আওয়াজ ও মানুষের চিৎকার।
২০-২৫ জন সাঁওতালনী লাইন ধরে দাঁড়িয়ে গেলো। সবার হাতে বড় বড় দা। বাঘ, বাঘিনী ও বাঘের বাচ্চারা দৌড়াতে দৌড়াতে এদিকে আসছিলো। সাঁওতালনীরা চিৎকার করে ওদেরকে ধাওয়া করলো। কী প্রচণ্ড চিৎকার টিন, ঢোল আরো কত কিছুর আওয়াজ উচ্চকিত হলো। বাঘেরা দৌড়ে পালালো। আমরা গাছ থেকে অনেক পরে ধীরে সুস্থে নেমে আসলাম। সাঁওতালনীদের সাথে দেখা হলো।

মকবুল চাচা ওদেরকে জিজ্ঞেস করে যা জানলেন, তা হলো বাঘঝাড় কাটতে কাটতে বাঘের বাচ্চার মাথা কেটে গেছে। তাই নিয়ে এতো হুলস্থুল হয়ে গিয়েছিলো।
স্কুলে এই নিয়ে বেশ গাল গল্প হলো। কেউ ভয় পেলো, কেউ বাঘ মারতে চাইলো। কেউ দল বানাতে চাইলো বাঘ মারার জন্য।
সাঁওতালনীদের যুদ্ধের এই ঘোরের মধ্যেই একদিন গভীর রাতে বন্দুকের গুলিতে এবং বাঘের আকাশটা চিৎকারে আমাদের সবার ঘুম ভেঙে গেলো। সেদিন মকবুল চাচার খুব জ¦র ছিলো, তিনি আর টিন পেটাতে পারেননি ফলে গভীর রাতে বাঘ আমাদের বাসার নিচে অবস্থান করেছে। বাঘ আসার আগমনের সংবাদ দিতো কেউ নামের একটা জন্য। কেউ এর চিৎকার শুনে সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের বুলবুল চাচা অনেক বড়সড় টর্চলাইট দিয়ে বাঘ এসেছে কী না দেখছিলেন। টর্চলাইটের আলো গিয়ে পড়ে বাঘের চোখে। বাঘ হুঙ্কার দিয়ে লাফ দিয়েছিলো।

কখনো কখনো পালকিতে চড়ে স্কুলে গিয়েছি, চার পাঁচজন মিলে একসাথে। কী মজার ব্যাপার তাই না! ঝড় বৃষ্টির মধ্যে আমরা বর কনে সাজতাম। অনেক সময় লাগতো স্কুলে যেতে। এখন সেসব কথা মনে পড়েলে চোখে পানি এসে যায়। যারা পালকি বহন করতো, তাদের বলা হতো বেহারা। তারা ঝড় বৃষ্টির ভিতরে ছাতা ব্যবহার করতো কিন্তু তা কোনো কাজে লাগতো না, ওরা নানারকম গান গেয়ে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করতো।
স্কুলটি ছিলো টিনের। উপরে টিন। চারিপাশে বাঁশের বেড়া ও টিন। প্রচণ্ড ঝড় হচ্ছিলো। স্কুলের দুই পাশ ভেঙে পড়েছিলো। আমরা সবাই টিচারদের কমনরুমে জড়ো হয়ে বসেছিলাম। দলবেঁধে কেউ কেউ গিয়েছিলো। স্যারেরা আমাদেরকে মাঝে ইউনিসেফ থেকে প্রোটিনযুক্ত বিস্কুট, প্রোটিনযুক্ত দুধ গায়ের সাবানও আয়োডিনের ছোট্ট শিশি প্রোজেক্ট করতেন।

হঠাৎ বিকট একটা শব্দ হলো। কেউ কেউ অনেকগুলো সাপকে দৌড়াতে দেখলো। বরফে জড়ানো একগুচ্ছ মরা সাপ বারান্দার সামনেই পড়ে রইলো। এ সময়ে বরফের খণ্ড শিলও পড়ছিলো।
স্যারেরা অদ্ভুত গল্প শোনালেন। বললেন, কুচবিহারের পাহাড়ে যেসব সাপ ছিলো তাদেরই একটা গ্রুপ ঝড় বাদলে পড়ে ভাসতে ভাসতে আমাদের স্কুলে এসে পড়েছে। বৃষ্টিতে বরফ গলে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে এ ধরনের কথা প্রথমে এবার শুনলাম।
এর কিছুদিন পরেই আব্বাজান বদলি হয়ে ঠাকুরগাঁয়ে এলেন। আসার আগে এক বিকেলে দেখছি কিছু লোক চিৎকার করতে করতে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যাচ্ছে ডোমারের দিকে। তাদের হাতে প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন এইসব। তাতে লেখা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। মুখে মুখেও তারা এই ধরনের আওয়াজ করছিলো। পরে জেনেছিলোম একেই বলে স্লোগান।

Share.

মন্তব্য করুন