বহুকাল আগের কথা।
তৎকালীন খোরাসান দেশের ঘটনা। একসময় তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও ইরানের কিয়দংশ এবং সমগ্র আফগানিস্তান খোরাসানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সে-সময় খোরাসানের নিশাপুর ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ নগরী। ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-সংস্কৃতি, চারুকলা, স্থাপত্য শিল্প সবদিক থেকে বিকশিত। অবশ্য নিশাপুর বর্তমানে ইরানের অভ্যন্তরে। নিশাপুর থেকে আঠারো মাইল পূর্ব-দক্ষিণে একটি অখ্যাত ক্ষুদ্র অঞ্চলের নাম শাহপুর। এখানে সপ্তাহে দু’বার হাট বসে। এ অঞ্চলে একজন ক্ষুদ্র সামন্ত নরপতি বাস করেন। যার হাঁকডাক অখ্যাত এলাকার চাইতে বেশি প্রসারিত। খানে খানান শাহ কুতুব খান। নাম শুনে ভয়ে কাঁপতে থাকে শাসিত প্রজা সাধারণ।
ভারতবর্ষ থেকে বৃহত্তর খোরাসানের ভেতর দিয়ে যে পথটা ক্রমাগত আরব দেশের দিকে অগ্রসরমান, সেই পথের পাশেই শাহপুর। সৃষ্টির শুরুর দিকে আদি মানব বাবা আদম ভারতবর্ষ থেকে কাবাগৃহ তাওয়াফের জন্য হয়তোবা এই পথেই হাজারবার আরব দেশে গমন করেছেন। ভারতবর্ষ এবং মধ্য এশিয়ার অনেক দেশের কাফেলাই এই পথে যাতায়াত করে।

ফিরোজ পাশার নব পরিণীতা স্ত্রী শিরিন বানু আসন্ন শীতের আশঙ্কায় একদিন বললো, ‘ঘরের কম্বল দুটো ছিঁড়ে গেছে। শীত থেকে বাঁচতে হলে শিগগির কম্বল কিনতে হবে। আমার পোশাক-আশাকের কথা না-হয় বাদ দিলাম কিন্তু সংসারে একটা ভালো বাসনপত্র পর্যন্ত নেই।’
‘বড় কোনো কাজের আদেশ না পেলে হয়তো এখনই কোনো কম্বল কেনা সম্ভব নয়,’ নৈর্ব্যক্তিকভাবে ফিরোজ পাশা জানায়।
‘নিজে অন্যায় অপকর্ম করে ভাইবোনসহ পুরো পরিবারের ভার মাথায় তুলে নিছো। অথচ নিজের জন্য কিছুই করোনি। নিজের জন্যও তো কিছু ভাবতে হবে।’
স্ত্রীর শেষ কথায় আচমকা ধাক্কা খেয়ে ফিরোজ পাশা ঘর থেকে বের হয়ে পড়ে। তৎকালীন খোরাসানের নসরাবাদ অঞ্চলের সামন্ত নরপতি শাহ কুতুব ফিরোজ পাশাকে দেখেই উল্লাসের সাথে বলেন, ‘হ্যাঁ বীরোত্তম তোমার কথাই ভাবছিলাম। কেমন আছো। না ডাকলে তো আজকাল দরবারে আসাই হয় না। যাক ভালোই হয়েছে। জরুরি একটা কাজ করতে হবে তোমাকে।’
‘আদেশ করুন জাঁহাপনা।’
‘লুতফাবাদ অঞ্চলের লোকজন এবার খাজনা দিতে নানা টালবাহানা করছে। গত বছর খরায় নাকি ভালো ফসল পায়নি। আর তাদের দলবদ্ধ করে নেতৃত্ব দিচ্ছে একজন সাহসী তরুণ।’
‘আপনি চাইলে সেই যুবকের মাথা এখনই আপনার সামনে হাজির করতে পারি।’

রাজার ইশারা পাওয়ামাত্র ছুটে চলে ফিরোজ পাশা। যেমন ইঙ্গিত, তেমন সঙ্গীত। একজন উদীয়মান প্রতিবাদী যুবকের অকালপ্রয়াণ। প্রজাদের কাছে রাজার পাওনা আদায়ে আর কোনো বাধা থাকে না। ভবিষ্যতে নিশ্চিত উদরশূন্য থাকতে হবে জেনেও প্রজারা জানের ভয়ে জমিদারের ধার্যকৃত কর পরিশোধ করতে বাধ্য হয়।
ফিরোজ পাশার ভাগ্যে জোটে একশত স্বর্ণমুদ্রা। পেয়ে যায় স্ত্রী তার বায়নাকৃত কম্বল, রেশমি চুড়ি এবং জরিদার পোশাক। আর সাময়িক স্বাচ্ছন্দ্য। ফিরোজ পাশা, পাশা ফিরোজ। রাজা বলেন, বীরোত্তম ফিরোজ। কেউ বলে জল্লাদ, কেউ বলে খুনি, কেউ বলে দস্যু। সেই সামন্ত জমিদারের নিকট নন্দিত হলেও সবার কাছেই সে নিন্দিত। এমনকি প্রিয়তমা স্ত্রীসহ পরিবারের অন্যান্য স্বজন তার কৃতকর্মকে মেনে নিলেও মনে মনে অপছন্দ করে।
ফিরোজ পাশা প্রাথমিকভাবে মানুষ হত্যার কার্যক্রম শুরু করে সেই সামন্ত নরপতির ইঙ্গিতের মাধ্যমেই। পরবর্তীতে জীবননাশ করতে গিয়ে মনে হয়েছে, এক খুনের জন্য যে দণ্ড, দশ খুন করলেও সেই একই শাস্তি। তারপর অর্থের প্রয়োজনে। কিংবা স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটলেই অবলীলাক্রমে দুনিয়া থেকে পথের কাঁটা সরিয়ে ফেলতে দ্বিধাবোধ করেনি। এভাবে নরবধ তার একটা নেশায় পরিণত হয়। কখনো ডাকাতির ছলে, কখনোবা গৃহের অদূরবর্তী অপস্রিয়মাণ মহাসড়কে পথচারী কাফেলায় দস্যুবৃত্তির ছলে।

একসময় অযৌক্তিক মনুষ্য জীবনহানির তালিকা দ্বিতীয় অঙ্কের বৃহত্তম সংখ্যায় গিয়ে ঠেকে। বনের ধারে শিকারের জন্য অপেক্ষমাণ ফিরোজ পাশা নরবধের সংখ্যা গুনতে গুনতে গৃহিণীর চিমটি কাটা পীড়াদায়ক কথাটি মনে পড়ে যায়। আচানক তার বোধোদয় হয়। একটু অনুশোচনা জাগে। আমি কী করছি! কোথায় করছি! কার জন্য করছি, কেন করছি। আমার অপরিণামদর্শিতার কারণে তো কত মাতা-পিতা পুত্রশোকে পাগল। কত বোন তার ভাইয়ের আদর থেকে বঞ্চিত। কত অবুঝ শিশু পিতার ¯েœহ-যত্ন থেকে বঞ্চিত হয়ে অকালে ঝরে পড়ছে। কত স্ত্রীকে স্বামীর ব্যবধানে যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়ে নিরাশায় বৈধব্যবরণ করতে হচ্ছে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে দ্রুত ঘরে ফেরে ফিরোজ পাশা। জিজ্ঞেস করে স্ত্রীকে এবং অন্যান্য স্বজনকে ‘আমার অন্যায়ের এবং এ পাপের দায়ভার তোমরা কি নেবে?’
‘আমরা তো তোমাকে বলি না, কোনো অন্যায় বা পাপ করতে। আমরা চাই তুমি উপার্জন করো।’ সবার কাছ থেকে একই উত্তর পাওয়া যায়
সকলের সমার্থক প্রত্যুত্তরে তার চেতনা ফিরে আসে। তৎক্ষণাৎ সে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। দিগি¦দিকশূন্যভাবে পথে ছুটতে থাকে। সামনে একজন আগন্তুক ভদ্রলোককে পেয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা ভাই এই এলাকায় কি কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি আছেন?’ একজন জ্ঞান-প্রবরের নাম বলে পথ বাতলে দেন পথচারী ভদ্রলোক। হাঁটতে হাঁটতে নির্দেশিত দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

তারপর কাক্সিক্ষত জ্ঞানী ব্যক্তির সন্ধান মেলে। আশান্বিত হয়ে প্রশ্ন করে, ‘জনাব, আপনার কাছে এসেছি এক বিশাল সমস্যা নিয়ে। এ পৃথিবীতে আমি অনর্থকভাবে ৯৯ জন ব্যক্তির জীবননাশ করেছি। আমার কি কোনো মুক্তির পথ আছে?’ জ্ঞানী ব্যক্তিটি জানায়, ‘তুমি খুনি, বিশ্বখুনি। ধারাবাহিক ঘাতক। তোমার কোনো মুক্তি নেই।’
‘মুক্তিই যদি না থাকে, তাহলে পাপের ভয় কেন? এমন জ্ঞানের নিকুচি করি।’ এই বলে অত্যন্ত হতাশ হয়ে একটানে কোমরে রক্ষিত কোষবদ্ধ তরবারি বের করে ফেলে। নিঃশঙ্কচিত্তে সেঞ্চুরি পূরণ করে।
আশাভঙ্গ হয়ে বিফল মনোরথে পুনরায় গৃহের বিপরীত দিকে ক্রমাগত অগ্রসর হতে থাকে। এমন সময় হঠাৎ পথে এক বুজুর্গ ব্যক্তিকে দেখে কী ভেবে আশা-নিরাশার দোলাচলে থেকে যথাযথ সালাম জ্ঞাপনপূর্বক তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘হে সম্মানিত ব্যক্তি, আমি আমার এ ক্ষুদ্র জীবনে বিশাল পাপের বোঝা বহন করে চলেছি। আমি একশত মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছি। আমি সৎপথে ফিরে যেতে চাই। মুক্তি পেতে চাই।’
‘তোমার পাপ ও মুক্তির মাঝে কে বাধা হতে পারে! অবশ্যই তুমি মুক্তি পাবে। সৃষ্টিকর্তা কাউকে বিমুখ করেন না। এ স্থান ভালো নয়। এখানে থাকলে আবার তোমার ভুল হতে পারে। আমার পরামর্শ হলো, এখান থেকে তুমি সোজা নিশাপুুর চলে যাও। সেখানে দেখবে একটা বিশাল ধর্মীয় পীঠস্থান। যার একাংশে জ্ঞানী ব্যক্তিগণ ধর্মীয় বিষয় নিয়ে গবেষণারত, অন্যাংশে আগ্রহী শিক্ষানবিসগণ জ্ঞান অন্বেষণরত এবং অপারাংশে কিছু ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার ধ্যানজ্ঞান এবং ক্ষমা প্রার্থনায় মশগুল। তুমি অবশ্যই শেষোক্ত স্থানে যাবে। সেখানে গিয়ে সবার সাথে সৃষ্টিকর্তার গুনগান এবং ক্ষমাপ্রার্থনা কর। তুমি সন্দেহাতীতভাবে ক্ষমাকৃতদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’

‘ধন্যবাদ সম্মানিত ব্যক্তি। আপনার ওপর সৃষ্টিকর্তার করুণা বর্ষিত হোক।’
কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন শেষে ফিরোজ পাশা জোরকদমে নিশাপুর অভিমুখে চলতে থাকে। সত্যপথ প্রাপ্তির প্রত্যাশায়। ক্ষমা মার্জনা পাবার অভিপ্রায়ে। অন্তরের গহিনে আশার আলো জ্বলে ওঠে তার। ক’দিন ধরে আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে আশা-নিরাশার দোলাচলে থেকে শারীরিকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়েছিল সে। তবু সৎপথে ফিরে যাওয়ার প্রত্যয়ে মুক্তির আকাক্সক্ষায় ত্বরিতপদে এগোতে থাকে সে। দ্রুত পথ চলতে চলতে একসময়ে ক্লান্তিতে পা অবসন্ন হয়ে পড়ে তার। তবু মনের ভেতর যে প্রদীপ জ্বলে উঠেছে তা দমন করা কার দুঃসাধ্য! প্রায় ন’মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সে একবারে নিশ্চল ও নিস্পন্দ হয়ে পড়ে। দুর্বলতা ও শক্তিহীনতায় আচানক মাটিতে পড়ে যায় সে। অল্পক্ষণের ভেতরে তার প্রাণবায়ু নির্গত হওয়ার উপক্রম হয়। ভাবে, আর বুঝি নিশাপুর যাওয়া হলো না। আর বুঝি মুক্তিপ্রাপ্তি কপালে জুটলো না। তারপরও শুয়ে বুকে হামাগুড়ি দিয়ে এবং ক্রলিং করে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। এক সময় সত্যি সত্যি হাত-পা অবশ হয়ে পড়ে এবং ক্রমশ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
ফিরোজ পাশা মারা যাবার পর তার বিদেহি আত্মা সংগ্রহ করার জন্য আকাশ থেকে দু’জন স্বর্গীয় দূত নেমে আসেন। শান্তির দূত বলেন, ‘ভালো হবার প্রত্যাশায় সংসার স্বজন সবকিছু ফেলে কৃতকর্মের অপরাধে হৃদয়ের গভীরে তার যে ভাবান্তর সৃষ্টি হয়েছে, যেভাবে সে কল্যাণের জন্য, করুণাপ্রার্থী হওয়ার জন্য, এতদূর ছুটে এসেছে তাতে সে স্বর্গেই যাবে।’
অপর দিকে দণ্ডদানের দূত বলেন, ‘সে সারাজীবন পাপাচারে কাটিয়েছে, শত প্রাণহানি ঘটিয়েছে, সুতরাং নরকের শাস্তি তার অনিবার্য প্রাপ্য। এ সাজা থেকে তার মুক্তি নেই।’

দু’জনের ভেতরে যুক্তিতর্ক চলতে থাকে। ইতোমধ্যে সেখানে অন্য আরেকজন স্বর্গীয়দূত বুজুর্গবেশে উপস্থিত হন। এবং উভয়ের যুক্তি পরামর্শ মনোযোগ সহকারে শোনেন। শেষে বলেন, ‘আপনাদের উভয়ের আপত্তি না থাকলে আমি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে একটি সমাধান দিতে চাই। গ্রহণযোগ্য হলে মেনে নেবেন।’
যুক্তিপূর্ণ এ কথায় উভয়ে রাজি হয়ে যান। এ সময় ছদ্মবেশধারী বুযুর্গ বলেন, ‘আপনাদের উভয়ের কথাই যুক্তিপূর্ণ এবং উভয়েই সঠিক। তবু এর একটা সমাধান হওয়া আবশ্যক।’
এরপর তিনি আবার বলেন, ‘বাস্তবিক পক্ষে লোকটি ছিল সিরিয়াল কিলার। সে পাপ বা অন্যায় করেছে সত্য। আবার সে হৃদয়ের মর্মপীড়ায়, করুণা প্রার্থনার মানসে পুণ্যাত্মা ব্যক্তিদের সাহচর্য লাভের প্রত্যাশায় মনের আবেগে কল্যাণের পথে অগ্রসরমান ছিল। সুতরাং এক্ষনে এর সমাধান একটাই- পাপিষ্ঠ ব্যক্তিটি প্রকৃত বুযুর্গ ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণের পর যেখানে তার মনের সম্পূর্ণ পরিবর্তন আসে, সে-স্থান থেকে তার মৃতদেহ পর্যন্ত যে দূরত্ব এবং নিষ্প্রাণ দেহ থেকে নিশাপুরের ধর্মীয় পীঠস্থান পর্যন্ত দূরত্ব যদি সমানও হয়, তবু তার আত্মা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। তাকে ভালো হওয়ার উদ্যমে অবশ্যই অর্ধেকেরও বেশি পথ পাড়ি দিতে হবে। কেননা সে ভয়ঙ্কর অপরাধী।’
এ কথায় দণ্ডদানের দূত খুশি হন। শান্তির দূতের মন একটু খারাপ হলেও যৌক্তিক বিষয়টি মেনে নেন। তারপর তিনজন একসাথে উভয়দিকে পরিমাপের মানদণ্ড মাপকাঠির মাধ্যমে মাপা শুরু করেন। একবার, দুবার, তিনবার মাপেন। প্রত্যেকবারই দেখা যায়, প্রাণহীন দেহ থেকে নিশাপুরের পীঠস্থান পর্যন্ত একহাত দূরত্ব কম। অর্থাৎ করুণা প্রার্থনার দিকে একহাত অগ্রগামী। পূর্বে উভয়ের গ্রহণকৃত সিদ্ধান্তের সমাধান মোতাবেক স্বর্গের দূত ফিরোজ পাশার বিদেহী আত্মা গ্রহণ করে।

পুনশ্চ : পবিত্র মুসলিম শরীফের একটি হাদিস (হাদিস নং- ২৪৫৮) এর ছায়া অবলম্বনে।

Share.

মন্তব্য করুন