যথার্থ মধ্যবিত্ত পরিবার বলতে যা বোঝায়, তেমনি একটি পরিবারেই আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। নিত্যনৈমিত্তিক অভাব অনটন, সব ব্যাপারেই টানা-হেঁচড়া, এভাবেই সংসার চলতো আমাদের। কিন্তু উৎসবপর্ব ইত্যাদিতে আনন্দের কোনো কমতি ছিল একথা কেউ বলতে পারবে না।
পৈত্রিক ভিটা পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিবাদে। বৃটিশরা দেশটাকে অদ্ভুত রকমের ভাগাভাগি করে দিয়ে প্রস্থান করায় মানুষের যে কত সহ¯্র প্রকারের সমস্যা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। দাঙ্গার কথা না হয় বাদই দেয়া গেল। ভিটেমাটির মায়া ত্যাগ করে দেশান্তরী হওয়াটাও কি কম কষ্টের ব্যাপার!

আমার আব্বা বৃটিশ আমল থেকেই চট্টগ্রামে রেলওয়েতে চাকরীরত ছিলেন বিধায়, পাকিস্তানের পক্ষেই রায় দিয়ে আমাদের নিয়ে এলেন চট্টগ্রামে, সেই ১৯৪৭ এর ডিসেম্বরে। চট্টগ্রামের টাইগার পাস রেলওয়ে কলোনীতে আমার আগমন তিন বছর বয়সে- সেই থেকে শৈশব-কৈশোর এবং যৌবনের প্রারম্ভকাল আমার চট্টগ্রামেই কেটেছে।
রেলওয়ে কলোনীতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের বাস থাকায়, সে সময় চট্টগ্রামের সংস্কৃতির সাথে খুব একটা পরিচয়ের সুযোগ হয়নি আমার। তাই বাড়ির সামনের প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সুবাদে ফাইভ পাশ করা অব্দি চাঁটগাইয়া হাওয়ার পরশ পাওয়া হয়নি আর।
কলোনীর মানুষগুলোর সামাজিক এবং আর্থিক অবস্থান প্রায় একই মানের হওয়াতে, আমরা কখনো কোনো ব্যাপারে তেমন কোনো অসম্ভবীর কারণ খুঁজে পাইনি- মানে অমুকের পোশাক ভালো, তমুকের বাবার অত টাকা, আর একজনের এই আছে সেই আছে; এ ধরনের আলাপ আলোচনার ধারেকাছেও ছিলাম না আমরা। প্রাইমারী, এমনকি কলেজিয়েট হাইস্কুলেও আমাদের স্কুল ড্রেসের বালাই ছিল না। তাই বলে কেউ কিছু ফুটানী করে জমকালো দামি পোশাক পরে স্কুলে আসতো না।
বাসায় খাওয়াদাওয়ার তেমন বাহার না থাকলেও বৈচিত্রের অভাব ছিল না। শাকসবজি ভাজিভর্তা। ডিম, কুঁচোমাছ থেকে শুরু করে মুরগি, গরু সবই চলতো। কিন্তু নিয়ম করে। পরিমাণ মত।

এইটাকেই টানা-হেঁচড়া বলি আমি। সবই হচ্ছে, কিন্তু হিসেব করে। আহা, আর একটু পেলে খুব ভালো হতো। এটাই ছিল জীবনের আনন্দ। ভাইবোনদের মধ্যে ভাগাভাগিটা যে কী আনন্দের!
বাবা আব্দুস সালাম শৌখিন মানুষ ছিলেন। শখের শেষ ছিল না তাঁর। সাধ্য কম, কিন্তু সবই করতেন তারমধ্যে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ঠিকই চালিয়েছেন। স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন মেয়েদের জন্যে, ক্লাবের আজীবন সাধারণ সম্পাদক, মাছ ধরা, পাখি শিকার, ব্রিজ চ্যাম্পিয়ন, কাচ্চি বিরিয়ানীর পাকা রাঁধুনী, বাগানের শখ, পোশাক-আশাকে ছিমছাম ইত্যাকার জিনিসে আব্বাকে সত্যিই একজন শৌখিন মানুষই বলা যায়।
তাঁর একমাত্র পুত্র হিসেবে মনমানসিকতাটা অনেকটা সেরকমই ধারণ করতে পেরেছি বোধকরি। খাওয়া-পরা সবকিছুতেই একটা রুচিশীল ব্যাপার ছোট থেকেই অনুসরণ করার চেষ্টায় ছিলাম। হয়তো এখনো বিদ্যমান সেই চেষ্টা।
আব্বা নিজের পোশাকের ব্যাপারে যেমন ফিটফাট ছিলেন, ছেলের ব্যাপারেও তাই। বছরে দু’একটা প্যান্ট বা শার্ট কপালে জুটতো। তাতেই খুশি। আমার পছন্দের রঙ ছিল শাদা অথবা আকাশি, কিংবা ছাই রং। এর থেকে গাঢ় কোনো রঙের কাপড় আমাকে কেউ পরাতে পারেনি কখনো। একবার এক ঈদে আম্মা খুব পছন্দ করে আমাকে না দেখিয়ে আমার জন্যে একটি গোলাপী রঙের পাঞ্জাবী বানিয়েছিলেন। সে নিয়ে কী কেলেঙ্কারী! কান্নাকাটি, হৈ-চৈ। আমি কিছুতেই পরবো না সে জামা। মেয়েদের জামা কেন কিনেছে আমার জন্যে! হাসি পাচ্ছে, কত বিচিত্র সব কড়কড়া রঙের পাঞ্জাবী আর টি-শার্ট পরছি এখন। জীবনটা এমনই।

এই দ্যাখো, ধান ভাঙতে শিবের গীত শুরু করেছি। বলবো ঈদের কথা, আর বলছি কিনা রঙিন কাপড় নিয়ে কান্নাকাটির গল্প। তবুও ওই ঈদের কথাই চলে এলো। সারা বছর কিছু পাই না পাই, দুই ঈদে দু’টো জামাকাপড় বাঁধা ছিল। কখনো কখনো নতুন জুতোও জুটতো। আব্বা সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন রিয়াজুদ্দিন বাজারে বাটার দোকানে। ব্যস, হয়ে গেল! বাটার দোকান মানে তো সেই নটিবয় যত! হায় কপাল, ওটাই কিনতে হতো।
আর জামাটা বানিয়ে দিতো আমাদের এক বিহারি খলিফা। কাপড়টা এনে আমার হাতেই দিতেন আব্বা- যা বানাতে দে খলিফার কাছে।
তারপর প্রায় প্রতিদিন ধর্না পড়তো খলিফার দরবারে। সে যত আগেই কাপড় দেয়া হোক জামা পেতাম চাঁদ রাতে। এই ছিল খলিফা! নাম তার মনে পরে না আর।

প্রথম রোজা কত বছর বয়সে রেখেছি আজ আর মনে নেই। তবে সে বয়সে যেদিন রোজা রাখতাম, সেদিন বাসায় বিশেষ ইফতারের আয়োজন হতো। আব্বা বাজার থেকে নানান ফল আনতেন আমার জন্য। তবে মজার ব্যাপার ছিল একটা, রোজা রাখি আর না রাখি সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজটা পড়তাম দলবেঁধে পাড়ার মসজিদে। বিকেলে খেলাধূলা শেষে সাফসুতরো হয়ে মাথায় টুপি লাগিয়ে চলে যেতাম মসজিদে। আব্বা মাঝেমধ্যে নিষেধ করলেও শুনতাম না।
কেন যেতাম? ইফতারীর লোভে। বিভিন্ন বাসা থেকে নানান পদের ইফতার আসতো মসজিদে। সেগুলো ককটেল করে মুসল্লিরা রোজা ভাঙতেন। এটার প্রতি ছিল আমাদের লোভ। বসে যেতাম সবার সাথে খাঁটি মুসল্লীর মত। তারপর কোনরকমে ফরজটা পড়েই এক দৌড়ে বাড়ি। জানি সেখানে আমার ইফতার রাখা থাকবেই।
ঈদের ভোরে আমাদের আগে ওঠার প্রতিযোগিতা চলতো। বন্ধুরা দলবেঁধে বেরোতাম ফুল কুড়োতে। মৌসুমের উপর নির্ভর করতো, কী ফুল পাওয়া যাবে তখন। নিজেদের তো ফুলের বাগানই ছিল। এছাড়াও খুঁজে আনতাম নানান ফুল। বসার ঘর সাজাতাম ফুল দিয়ে। এরপর গোসল নিয়ে হৈ-চৈ। শীতের ঈদে মহা ঝামেলা। আব্বা ধরে নিয়ে গায়ে পানি ঢেলে দিতেন। তারপর কাঁপাকাঁপি, দলাইমলাই, আমার চিৎকার। এখন মনে পড়ে সব।
পাজামা পাঞ্জাবিই ছিল ঈদের পোশাক। কখনো বোনাস পেতাম প্যান্ট-শার্ট। বড় দুই বোন এবং দুলাভাইরা তো গিফট্ করতেনই। আম্মাও মাঝেমধ্যে তাঁর লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে একটা কাপড় কিনে দিতেন।

সব ব্যাপারে আব্বাকে অনুসরণ করতাম আমি। কাপড়টি ইস্ত্রী করা হতে হবে, জুতো পালিশ করা হবে (নিজেই করতাম) এবং চুলও পরিপাটি করে আঁচড়াবো। আহারে, কোথায় গেল আমার সেই মাথাভরা চুল! হাঁটাচলাসহ সবই আব্বার মত চেষ্টা করতাম আমি।
ঈদের পোশাক পরা হলে আতরটা আব্বা লাগিয়ে দিতেন নিজ হাতে। দুই কানে দু’টুকরো তুলো গুঁজে দিতেন, আতর মাখানো। টুপি পরতাম, কিস্তি টুপি। একবার আবদার করেছিলাম কালো টুপির জন্য। একটা জিন্না ক্যাপ কিনে দিয়েছিলেন আব্বা। বহুদিন পরেছি সেটা।
এরপর বেরোতাম মসজিদের উদ্দেশ্যে। বাড়ির কাছেই আমবাগান জামে মসজিদ। বোগলে একটা করে, জায়নামাজ নিয়ে বাপ-ব্যাটা বেরিয়ে পড়তাম নামাজের উদ্দেশ্যে। সবচেয়ে বিরক্তের ব্যাপারটা ছিল খোতবাটা। কিছুই বুঝতাম না। বলেই চলতেন হুজুর। উহ্, কখন শেষ হবে আর মোনাজাত করবে।
মোনাজাত শেষ হতেই দৌড়। তখন আর আব্বার কথা মনে থাকতো না। এক দৌড়ে বাড়ি। জায়নামাজ রেখে মাকে সালাম। তারপর একটু সেমাই মুখে দিয়ে আবার দৌড়- বন্ধুদের উদ্দেশ্যে। এবার শুরু হতো পাড়া বেড়ানো। কলোনীর প্রায় সব বাড়িতেই যাওয়া হতো দল বেঁধে। কে কী রকম সেমাই রাঁধলো সেটাই আমার দেখার উদ্দেশ্যে ছিল।

তবে ঈদির ব্যাপারটা তখন চালু ছিল না। তারপরও দু’চারজন আত্মীয়-স্বজন বাড়ি এলে সিকিটে আধুলিটে কপালে জুটে যেত। তাতে আনন্দটা বেড়ে হয়ে যেত কয়েকগুণ বেশি।
এখন ঈদের আনন্দটা আমার বেড়ে যায়, যখন নাতি-নাতনীরা এসে সালাম করেই হাত বাড়িয়ে দেয়। ছোট নোটে ওদের মন ভরে না, আমারও না। একটি করে বড় নোট হাতে পড়লেই ওদের মুখগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
স্বার্থক হয় আমাদের ঈদ। ঈদ তো আরবি শব্দ। অর্থ হচ্ছে উৎসব। আনন্দ না হলে আর কি উৎসব হয়? ছোট-বড়, ধনী-গরীব সবার ঘরে প্রতিবার ঈদ যেন আনন্দ হয়ে দেখা দেয়, আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের কাছে এটাই আমার প্রার্থনা।

Share.

মন্তব্য করুন