ঈদ এলো। তোমরা সবাই খুব খুশি তাই না! নতুন নতুন জামা, জুতো, ঈদ উপহার। কে কতগুলো নতুন পোশাক পেয়েছো, কতগুলো উপহার পেয়েছো তাই নিয়ে হিসাব করতে বসে যাও। ঈদের দিনে কোন পোশাক পরবে তা ঠিক করতে হিমশিম খেতে শুরু করো। পোশাকের সঙ্গে জুতোর জুতসই মানান না হলে মুখ বেজার!

ঈদের দিন সকালে কী খাবার খাবে, নামাজ পড়ে এসে কী খাবে, বিকেলে কোনটা চাই, রাতের খাবারই বা কী হবে- তা নিয়ে মায়েদের ভাবনা চিন্তার, ছোটাছুটির অন্ত নেই। অন্তুর পছন্দ সেমাই তো বাবুর পছন্দ শুকনো মিষ্টি, আবার শামীমার বড্ড ওজন বাড়ার ভয়। তার খাবারটা হতে হবে একটু ভিন্ন। আবার বাবার পছন্দ বিরিয়ানি। সঙ্গে বোরহানি না হলে চলবে না। সবকিছু নিয়ে রান্নাঘরে রীতিমত দক্ষযজ্ঞ। কাবাব তো থাকতেই হবে। থাকবে খাবার শেষে পছন্দসই ডেজার্ট। ঠাণ্ডা পানি এবং কোমল পানীয় তো থাকছেই। এর মধ্যে আছে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে মেলা-হইচই। মোটকথা, সবাই যেন আনন্দে হারিয়ে যাবার খুশিতে মাতোয়ারা। আবার এরই মধ্যে বেড়াতে যাবার একটা সময় তোমাদের চাইই। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় পরিজন, প্রতিবেশী নির্বিশেষে বেড়াতে যাওয়া, সালাম দেয়া, সালামি নেয়া- সবই থাকে তোমাদের ঈদ আনন্দে।

আমাদের শৈশবের ঈদ আনন্দ কিন্তু তোমাদের মতো ছিল না। তখন না ছিল বিদ্যুৎ, না ছিল ঘরে ঘরে ফ্রিজ, এত বাহারি দোকানের মেলা। নতুন নতুন পোশাকের ব্যাপারটা ছিল আমাদের কাছে অকল্পনীয়। জামা জুতো একসাথে ভাবাই যেত না। হয় জামা, নয় জুতো। তাও আবার রাবারের জুতো। এখনকার মত হাজারো জুতো কোম্পানির রকমারি জুতো ছিল না। ছিল না রেডিমেড বাহারি জামা জুতোর পসরা। না ছিল মিঠাই মণ্ডার বাহারি দোকান। রাতব্যাপী দোকান খোলা রাখার কোনো নিয়ম ছিল না। কেননা বিদ্যুৎই ছিল না। দোকানদাররা হ্যাজাক বাতির আলোয় দোকান করতেন।

তাই বলে আমাদেরও আনন্দের কিন্তু কমতি ছিল না। আমাদের আনন্দ শুরু হতো রোজার চাঁদ দেখার মধ্য দিয়ে। রোজার চাঁদ দেখতে পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যার শুরুতে হাজির হতাম খোলা মাঠে। তারপর শুরু হতো পশ্চিমের আকাশে গরু খোঁজা। কে সবচেয়ে আগে দেখবে নতুন চাঁদ। দেখার সাথে সাথে শুরু হতো আজান দেয়া। এই আজানের শব্দ শুনে অন্যরাও শুরু করে দিত আজান। এভাবে এক জায়গা থেকে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়তো চাঁদ ওঠার খবর। তখন তো রেডিও, টেলিভিশন, খবরের কাগজের বালাই ছিল না যে চাঁদ ওঠার খবর জানবে! এখন তো তোমরা টেলিভিশন, মুঠোফোন বা ফেসবুকেই সব জেনে যাও।

রোজা শুরু হলে আরেক আনন্দ। ইফতারের আনন্দ। এখনকার মত আমাদের ইফতার কিন্তু জাঁকজমকপূর্ণ ছিল না। কাঁচা আদা-লবণ দিয়ে ইফতার শুরু হতো। এরপর ছোলামুড়ি। শরবতের বালাই ছিল না। কারণ চিনি ছিল দুষ্প্রাপ্য। আপেল, আঙুর, নাশপাতি এসবের নামও শুনিনি। গ্রামের লোকেরা এতকিছুর নামও জানতো না। তবে সপ্তাহে দু’দিন বসতো গ্রামের হাট। এদিন কপাল ভালো হলে গুরুজনেরা হাট থেকে আনতেন পেঁয়াজু বা জিলিপি। গুড়ের জিলিপি। সেদিন ইফতারটাকে অন্যরকম মনে হতো।

ইফতার যে রকমই হোক না কেন তা কিন্তু প্রতিবেশীদের বাড়িতে পাঠানোর একটা চমৎকার রেওয়াজ ছিল। আসরের নামাজের পর একটা ধামায় (টুকরি) ইফতার নিয়ে আমরা বেরোতাম পাড়ায়। পাড়ায় সবার বাড়িতে ইফতার পৌঁছিয়ে সন্ধ্যার আগেই ইফতারের জন্য বাড়িতে ফেরা। আমাদের আবার আরেকটা কাজ করতে হতো। রোজাদার ব্যক্তিদের ডেকে আনা। আমরা বাড়ির পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। শেষ বেলায় কোনো রোজাদার এ রাস্তায় গেলে তাকে ইফতারের দাওয়াত দিয়ে বাড়ির বারঘরে (বৈঠকখানা) ডেকে আনা। সেখানে থাকতো ইফতারের ব্যবস্থা। থাকতেন বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা। সবাই মিলে ইফতার করতেন। তখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে এখনকার মত দোকান ছিল না। রাস্তায় ইফতারের সময় হলে রোজাদার ব্যক্তি বিপদে পড়ে যেতেন। তাই এই ব্যবস্থা।

ঈদের দশ বারো দিন আগে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই শুরু হতো আরেক ব্যস্ততা। এখনকার মতো সেমাই, লাচ্ছা এসব বাজারে পাওয়া যেতো না। বাড়ি বাড়ি মা চাচীরা হাতে সেমাই বানাতেন। নানান ধরনের রকমারি বাহারি সেমাই। একেকটার একেক নাম। কোনোটা মিহিন, কোনোটা মোটা, কোনোটা দেখতে চালের মতো। ধুম পড়ে যেত সেমাই বানানোর। বাড়ির আঙিনায় পাটি পেতে তার উপর কাপড় বিছিয়ে সেমাই শুকোতে দেয়া হতো। মুশকিল হতো কাক-শালিকেরা দলবেঁধে এসে চড়াও হতো সেমাই এর ওপর। আমাদের লাঠি হাতে পাহারা দিতে হতো কাকতাড়ুয়ার মত।
এভাবেই শেষ হতো রোজা। শেষ রোজার সন্ধ্যায় আমরা সবাই ছুটতাম খোলা মাঠে, যেখান থেকে পরিষ্কার ভাবে আকাশ দেখা যায়। সবাই পশ্চিম আকাশে তাকিয়ে। হঠাৎ হয়ত শোনা গেল আজানের আওয়াজ। ব্যস শুরু হলো হৈ হৈ রৈ রৈ। ঈদের হৈ হৈ রৈ রৈ। তোমরা তো টেলিভিশনের “রমজানের ঐ রোজার শেষে” গান শুনে ঈদের বার্তা পাও।

ঈদের দিন ভোরে ফজরের নামাজের আজানের সাথে সাথে ঘুম থেকে ওঠা। সবাইকে সালাম ও ঈদ মোবারক জানানো। বাড়ির গরু-ছাগলগুলোকে বের করে তাদের খাবার দেয়া। সবশেষে গোসল। তোমরা শুনলে অবাক হবে, কোনো সাবানের বালাই ছিল না তখন। কলাগাছ পুড়িয়ে ছাই তৈরি করে সেই ছাই দিয়ে কাপড় কাচা হতো। একধরনের মাটি পাওয়া যেত সাদা রঙের। সেটা দিয়ে আমরা গোসল করতাম। তোমরা তো এখন শ্যাম্পু ছাড়া গোসল করতে চাও না।

গোসল শেষে বাড়ির সবাই (মহিলারা ছাড়া) বসতাম খেতে। মুড়ি, সেমাই ছিল প্রধান খাবার। অসীম তৃপ্তি নিয়ে অমৃতের মতো খেতাম আমরা সে খাবার। এরপর ঈদের জামায়াতে যাওয়ার প্রস্তুতি। আগের বছরের কেনা শার্ট, পাজামা আম্মা সযতেœ তুলে রাখা স্যুটকেস থেকে বের করে দিতেন। কেমন একটা সুবাস (ন্যাপথলিনের) বেরোত শার্ট পাজামা থেকে। কাপড় পরা হলে ওজু করে আবার মায়ের কাছে। তিনি চোখে সুরমা লাগিয়ে দিতেন, গায়ে আতর মাখিয়ে দিতেন। মায়ের আদরের ছোঁয়া নিয়ে আমরা হাজির হতাম ঈদগাহে। সেখানে আরেক হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড!

তখন ঈদগাহ ছিল কয়েক গ্রাম নিয়ে। বিভিন্ন গ্রামের আত্মীয় পরিজন আসতেন ঈদের জামায়াতে। দেখা হতো। সালাম বিনিময়, কোলাকুলি এ যেন বেহেশতি দৃশ্য। তারপর নামাজ শেষে আবারও একই দৃশ্য। যে যার বাড়ির দিকে যাত্রা করতেন। ধীরে ধীরে ঈদগাহ ফাঁকা হয়ে যেতো। আমরা বাড়িতে ফিরে সালাম করতাম বড়দের। সমবয়সীদের সাথে কোলাকুলি। দুপুরে সবাই মিলে একসাথে খেতে বসা। এদিন অবশ্যই একটু ভালো রান্না হতো। সবাই মিলে তৃপ্তি ভরে ভাগাভাগি করে খাওয়া মা চাচীদের সে রান্না।
আমাদের ঈদে প্রাচুর্য ছিল না। তার সুযোগও ছিল না। কিন্তু হৃদ্যতা ছিল, ভালোবাসা ছিল। ছিল সহমর্মিতা। প্রাচুর্য তোমাদের সহমর্মিতা কেড়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে মূল্যবোধকে। তোমাদের ঈদ আনন্দকে সীমিত করে দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া আর টেলিভিশনের বাক্সে। সেখানে নেই জীবনের ছোঁয়া। আছে কৃত্রিমতা। তোমাদের ঈদে সবকিছু ছাপিয়ে ফিরে আসুক সেই মূল্যবোধ, সহমর্মিতাসহ জীবনের জয়গান।

Share.

মন্তব্য করুন