পশুপালন

একসময় মানুষ অন্য বুনো প্রাণীদের মতোই অরণ্যচারী ছিল। তারা থাকত বনে-জঙ্গলে। পরবর্তীকালে কোনো কোনো প্রজাতির প্রাণীকে মানুষ বশ মানায়। তারা পশু পালন করতে শেখে। অনেক পশু গৃহপালিত হয়। ঐ প্রাণীগুলোও মানুষের সংস্পর্শে এসে বশীভূত হয়ে যায়। অনুগত হয়ে যায়। ঐ পশুগুলো মানুষের সাথে বাস করতে থাকে। তাদের জীবনধারণ মানুষের সাহচর্যে গড়ে ওঠে। ঐ প্রাণিকুল অরণ্যে বাস করত বাধাবন্ধনহীন অবস্থায়। সেখানে তারা অবাধে যত্রতত্র বিচরণ করেছে। বল্গাহারা হয়ে ছুটোছুটি করেছে। তারা ছিল নিয়ন্ত্রণহীন। কিন্তু পশুপালনে অগ্রগতি শুরু হওয়ার পরে তাদের বন্ধনহীন জীবনধারা বদলে গেলো। তারা তখন পরিগণিত হল মানবসমাজের একটি অংশে। একে বলা যায় গৃহপালিতকরণ।
বিভিন্ন নিদর্শন থেকে জানা গেছে যে, সম্ভবত প্রাচীন পাথরের যুগে মানুষ নানারকম স্তন্যপায়ী প্রাণীকে পোষ মানাতে চেষ্টা করেছে। এজন্য বনজঙ্গল থেকে ঐ সকল প্রাণীর শাবকদের ধরে আনত। এনে নিজেদের কাছে বন্দি অবস্থায় অনেক দিন রেখে দিত।

আদিম যুগের মানুষ প্রথম যে প্রাণীটির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে সচেষ্ট হয়, তা হল নেকড়ে। পরে মানুষ শেয়ালের সাথেও পোষ মানানোর সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়। যেহেতু এ দু’টো প্রাণী সামাজিক ছিল না তাই মানুষদের পোষ মানানোর প্রয়াস সফল হয়নি। নেকড়ে এবং শেয়ালকে পোষ মানাতে মানুষ ব্যর্থ হয়। তারা তাদের বাগে নিতে পারেনি। সুযোগ পেলেই এরা মানুষের সঙ্গ ছেড়ে দিয়ে বনে-জঙ্গলে চলে গেছে। কখনও আবার মানুষের আশ্রয়ে বন্দি অবস্থায় মারা গেছে। প্রাচীন ইউরোশিয়াতে এমন কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে যার দরুন ধারণা করা যায় যে, মানুষ একসময় শিকারের জন্যে নেকড়ের সাহায্য নিত। নেকড়ে দিয়ে তারা অন্যপ্রাণীদের ধরত।
নেকড়েরা অন্য প্রাণীদের ঘাড় কামড়ে মানুষের কাছে এনে দিত। ইউরেশিয়ার সমভূমিতে তৃণভোজী প্রাণীরা দলবদ্ধভাবে বিচরণ করত। মানুষ তখন বুঝতে পেরেছিল যে, শিকার করতে হলে অন্য প্রাণীর সাহায্য প্রয়োজন। আর এ বিষয়টিতে নেকড়ে সম্বল হতে পারে। নেকড়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তাই মানুষ তাখন নেকড়েকে পোষ মানানোর জন্য সচেষ্ট হয় এবং ফাঁদ পেতে নেকড়ে শাবক ধরে। তাদের খাইয়ে বড় করে তোলে। তারপর সেই অনুগত পশুদের সাহায্য নিয়ে শিকারে নামে।

প্রায় দশ হাজার বছর পূর্বে ইউরোপের অরণ্যচারী মানুষ তাদের খাদ্যের জন্য নানারকম তৃণভোজী প্রাণিকুলের ওপর নির্ভর করত। তারা শিকার করত বলগা হরিণ, লাল হরিণ, বুনো গুরু, মোষ, বুনো ঘোড়া।
সেসময় পশ্চিম এশিয়ার প্রধান খাদ্য ছিল ভেড়া, ছাগল, বলগা হরিণ, গাধা। যে দু’টো বুনো প্রাণীকে বশ মানিয়ে প্রথম গৃহপালিতের পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল তারা, তা হল- ছাগল এবং ভেড়া।
প্রায় নয় হাজার বছর আগে এটি ঘটে। এরপর গৃহপালিত প্রাণী হয় গরু, মোষ এবং শূকর; সবচাইতে শেষে হয় ঘোড়া। পাঁচ হাজার বছর আগে ইউক্রেনে এটি ঘটে। ইউক্রেন ছিল তৃণাচ্ছাদিত অঞ্চল। যেসকল প্রাণী গৃহপালিত হয়েছে তারা কখনও নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলকে নিজেদের বাসভূমি বলে মনে করেনি। তারা বাস করত দলবদ্ধভাবে। তাদের খাদ্যতালিকা ছিল বিশাল। খাদ্য হিসেবে বিশেষ বিশেষ উদ্ভিদদের ওপর নির্ভর করত না। ভেড়া আর ছাগল ছিল মূলত পাহাড়ি এলাকার প্রাণী। তারা বিভিন্ন দলের সাথে মিলেমিশে থাকত। তাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল সর্বদা খাদ্যের অন্বেষণ। তাদের সবধরনের ব্যস্ততা ছিল শুধুমাত্র খাবার সংগ্রহের দিকে। অনেক প্রাণী গৃহপালিত হওয়ার পর তাদের শারীরিক পরিবর্তন ঘটেছে। গৃহপালিত প্রাণীরা সবসময় তাদের পালক মানুষকে অনুসরণ করেছে। তাদের খাদ্যে অভ্যস্ত হয়েছে। তাদের আচার আচরণে অভ্যস্ত হয়েছে।

যখন মানুষ শিকারির মত জীবন-যাপন করত, তখন তারাও মানুষের সঙ্গী সাথী হিসেবে শিকারী হয়েছে। যখন মানুষ চার দেয়ালের মাঝে এসেছে তখন তারাও সেই পরিবেশের সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
মানুষ শুধুমাত্র শিকারের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। কারণ সবসময় শিকার পাওয়া যেত না। শিকার সবসময় সহজলভ্য ছিল না। কোনোদিন হয়ত হরিণ পাওয়া গেল। আবার কোনদিন বুনো মোষ। এভাবে খাবার জুটত। অন্য কোনো দিন হয়ত কোনো প্রাণীকেই আর শিকারের জন্য পাওয়া গেল না। অথচ মানুষের খিদে তো প্রতিদিনই পায়। খিদের জ¦ালা ভীষণ জ¦ালা। তখন মানুষ পোষমানা পশুদের খেত। এভাবে পোষমানা পশুরা মানুষের উপকারে আসত। পোষমানা কুকুর মানুষকে অনেক সাহায্য করত। শিকারি মানুষের ডেরার পাশে বুনো কুকুরেরা ঘুরত উচ্ছিষ্টের জন্য। তাদের একটি স্বভাব মানুষদের কাছে ভালো লাগত। মানুষের ডেরার কাছে কোনো হিং¯্র জন্তু এলে কুকুরেরা চিৎকার করে তখন মানুষদের সাবধান করে দিত।
এদিকে শিকারী মানুষেরা এই ধরনের উপকার পেয়ে খুশি হত। মানুষ অনুভব করল, কুকুরের সাহায্যে তার উপকার হবে। মানুষ তাই আগ্রহ নিয়ে কুকুরকে পোষ মানালো। কুকুরই হচ্ছে প্রথম গৃহপালিত প্রাণী। মানুষের আবাসস্থল পাহারা দিত কুকুর। কুকুরের ঘ্রাণশক্তি বেশি। এটি তার বৈশিষ্ট্য। সে কারণে বনে-জঙ্গলে খুব সহজেই শিকারকে খুঁজে বের করতে পারে এবং সে ছুটে গিয়ে শিকারকে ধরে ফেলে। এর ফলে মানুষ তখন সহজেই পশু শিকার করতে পারে। ধারাল অস্ত্র দিয়ে পশুকে মেরে, গলা কেটে এবং চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে মাংশ বের করে। মাংশ আর চামড়া রাখে নিজের জন্য। নাড়িভূড়ি দেয় পোষা শিকারী পশুকে। বুনো জন্তুকে এভাবে ধীরে ধীরে মানুষ পোষ মানিয়েছে।

কৃষিকাজ

পুরুষেরা যেত পশুশিকার করতে। আর মেয়েরা যেত ফলমূল সংগ্রহ করতে, শেকড় বাকড়ের খোঁজ করতে। মেয়েরা একটা ব্যাপার লক্ষ্য করল। খাদ্যশস্যের বীজ যদি মাটিতে পড়ে তবে একটা ঘটনা ঘটে। নদী তীরের পলিমাটিতে যদি বীজ বোনা হয়, তাহলে তা থেকে একসময় লকলকিয়ে চারা গজায়। চারা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে গাছ হয়। সে গাছ আবার বুনো মাঠের তুলনায় অনেক শক্তপোক্ত। ফসলের শীষ হয় বড় ধরনের। দানা হয় ভারী। যেখানটায় বীজ বোনা হয় সেখানে ফসল ফলে। একসাথে অনেক শীষ পাওয়া যায়। একটা একটা করে শীষ খুঁজতে হয় না। এরকম সম্ভাবনায় মানুষ খুশি হল।
পলিমাটিতে ফসলের বীজ পুঁততে লাগল। এতে ফসল ভালো পাওয়া যেত। পাখিরা এসে ফসল খেয়ে ফেলে না। একটি নির্দিষ্ট জায়গাকে বাছাই করে মানুষ বীজ ফলানোর জন্য বীজ বুনত। এভাবে সৃষ্টি হল কৃষি জমির। মানুষ পশুপালন করতে শিখল। চাষাবাদ করা শিখল। এর ফলে মানুষের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হল। তার জীবনে প্রাচুর্য আসে। স্বচ্ছলতা দেখা দেয়। কিন্তু পাশাপাশি ঘর গেরস্থালির কাজও অনেকটা জটিল হয়ে যায়। তার প্রত্যাহিক কাজের পরিমাণ যেড়ে গেল। তাকে নিয়মিতভাবে শিকারে যেতে হচ্ছে। পশুপালন করতে হচ্ছে। ফসল পাওয়ার জন্য জমি চাষ করতে হচ্ছে। পাথর ঘষে উন্নত হাতিয়ার বানাতে হচ্ছে। মাটি ছেনে নিয়ে পাত্র তৈরি করতে হচ্ছে।

হাঁড়ি-পাতিল বানাতে হচ্ছে। মানুষের এখন মনে হল, এতসব কাজ একলাটি না করে পাড়া প্রতিবেশির সাথে একসাথে মিলেমিশে করলে আরো বেশি ভালো হয়। গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে করলে অনেক সুবিধা হয়। প্রচুর কাজ সহজেই করা যায়। এছাড়া বড় গোষ্ঠী হয়ে থাকাটাও অনেক নিরাপদ। তখন গোষ্ঠীতে কার কী ধরণের কাজ তাও নির্ধারিত হল। সকলের মাঝে দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হল। কাজের বন্টন হল। শিকার করে আনা পশুর মাংশের ভাগ বাটোয়ারাও হল। কার ভাগে কতটা অংশ পড়বে, তা নির্ধাতি হল। কাজের ধরণ অনুযায়ী কেউ অর্ধেক পেত, কেউ কম পেত।

মানুষ এভাবে একত্রে বসবাস করার ব্যবস্থা চালু করল। গোষ্ঠীতে যে ব্যক্তি বিজ্ঞ বলে বিবেচিত হত তাকে গোষ্ঠীপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত করতে হত। তার বুদ্ধি পরামর্শ মত কাজগুলো সম্পন্ন হত। তার নির্দেশ কার্যকরী হত। শিকারের সময় পরিবারগুলো একত্রিত হত। তারা ধারণা করত, এভাবে একসাথে হত। তারা ধারণা করত এভাবে একসাথে থাকলে তাদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। সমবেতভাবে কাজ করলে ফল লাভ বেশি হয়। চাষাবাদের জন্য প্রয়োজন হত স্থায়ী সহযোগিতার।

ফসল ফলানোর জন্য জমির প্রয়োজন। অনেক সময় জমি পাওয়ার জন্য জলাভূমি শুকানো হত। জলাভূমি থেকে পানি নিষ্কাশন করা হত। নদীতে বন্যা এলে মাঠের ফসলের ক্ষতি হয়, ফসল ভেসে যেত। পানিতে তলিয়ে যেত। যে কারণে বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাঁধ দিতে হত। এসব কাজেও ছিল সমবেত প্রচেষ্টার।
ক্ষুধার তাড়নায় মানুষ তার ডেরা বারবার বদল করতে বাধ্য হয়েছে। যে স্থানে অধিক সংখ্যক জন্তু জানোয়ার পাওয়া যেত সেখানে যেতেই আগ্রহ প্রকাশ করত মানুষেরা। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণেও মানুষ স্থাানান্তর করেছে।
প্রায় ১৮ হাজার বছর আগে পৃথিবী থেকে বরফ যুগ বিদায় নিল। বরফ ধীরে ধীরে গলতে শুরু করল। পৃথিবীতে তখন স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পেল উষ্ণতা। হিম যুগের অবসান ঘটল। সে সময় পৃথিবী ঢাকা পড়ে গিয়েছিল শাদা বরফে। কোথাও সবুজের চিহ্নমাত্র ছিল না। জীবনের চিহ্ন ছিল না। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে বরফের আচ্ছাদন সরে যাবার ফলে পৃথিবীর বুকে আবার নতুন করে জেগে উঠল প্রাণের স্পন্দন। প্রাণ সৃষ্টি হল।

সজীবতা ফিরে আসে। গাছপালা গজিয়ে ওঠে। চারপাশ ছেয়ে যায় বন-জঙ্গলে। বরফ তখন উত্তর দিকে সরে গেছে। যে সকল জীবজন্তু শীতল আবহাওয়ার সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছিল তারাও তখন উত্তরের দিকে সরে যেতে থাকে। এসময় বিশাল প্রাণী হাতির পূর্বপুরুষ ম্যামথরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। শিকারের প্রয়োজনে মানুষ ঐসব পশুদের অনুসরণ করত। এভাবে অনুসরণ করতে গিয়ে অনেক সময় তাদেরকে জলাশয় পার হতে হয়েছে। মানুষ তখন কাঠের গুঁড়ি দিয়ে ভেলা বানাতে শিখেছে। নৌযান-ডিঙি তৈরি করতে শিখেছে।
তাই তারা অনায়াসে জলাশয় পেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। পশু শিকারের জন্য হাতিয়ার প্রয়োজন। মানুষ চেয়েছে নতুন ধরণের হাতিয়ার উদ্ভাবন করতে। মানুষ দেখল, কোনো বৃক্ষের সরল ডালকে যদি বাঁকিয়ে নেয়া যায়, তাহলে তাতে বেশ শক্তি সঞ্চার হয়। সেটা প্রয়োজনে কাজে লাগানো যায়। তখন ডালকে বাঁকিয়ে তার দু’প্রান্তে ছিলা পরিয়ে ধনুক তৈরি করল তারা। সেই ধনুক থেকে তীর ছুঁড়ে শিকার করত। এভাবেই শুরু হয় এবং বেঁচে থাকার প্রয়োজনে মানুষ এগিয়ে যেতে থাকে নতুন নতুন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে।।

Share.

মন্তব্য করুন