‘শোন শোন ইয়া ইলাহি আমার মুনাজাত
দিও তৃষ্ণা পেলে ঠাণ্ডা পানি
ক্ষুধা পেলে লবণ ভাত॥’

এই প্রার্থনার সুর ধরেই আসত মাহে রমজান। তার আগে শাবান, রজব, মাসগুলোতে শুরু হতো রমজানকে বরণ করে নেয়ার প্রস্তুতি।
মন আজ হারিয়ে যায় সুদূর অতীতে। যখন আমি ছিলাম শিশু, ঘরে ছিলেন মা ও চারটি ভাই-বোন। যে শহরে থাকতাম তার নাম মৌলভীবাজার, কুলুকুলু রবে বইছে মনু নদীর স্বচ্ছ পানি, চার দিকে সবুজ টিলা, শ্যামল বনানী ও স্বচ্ছ নীল আকাশ। পাখির ডাক শোনা যেতো প্রায় সারা দিনই। দেখা যেতো টুপি মাথায় মুসল্লিদের আনাগোনা। আমাদের শহরটিতে সবাই ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ। তাদের অন্যতম শখ নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, ফিতরা ও মুসাফিরদের আপ্যায়ন। অন্য ধর্মের সকলের সঙ্গেই ছিলো সদ্ভাব। বৌদ্ধ হিন্দু খ্রিস্টান কোন ভেদাভেদ নেই যেন একই বৃন্তের গাঁথা কুসুম। আমরা অনায়াসেই হিন্দু বন্ধুদের বাড়ি যেতাম এবং তারাও আমাদের বাড়িতে আসতো। শবে বরাতে হালুয়া-রুটি এবং ঈদে সেমাই-ফিরনির আস্বাদন নিতো তারা। আসল কথা অত্যন্ত সহজ সরল ছিলো মানুষের জীবন। প্রাচুর্যের বাড়াবাড়ি নেই, সম্পদের প্রদর্শন নেই, মধ্যবিত্ত মানুষদের জীবনে ছিলো সেবা, দয়া ও অতিথিপরায়ণতার আতর মাখা।

মনে পড়ে ঈদের অনেক আগেই বাড়িতে শুরু হতো ঘর পরিষ্কার করা, বাগান সাফ করা, হাতের তৈরি সেমাই ও নকশি পিঠা। আম্মা তাঁর একমাত্র সহকারী রমিজা বুয়াকে নিয়ে এসব কাজ করতেন দুপুরের অবসরে। আমাদের ডাকতেন যখন বড় একটি চালকুমড়ো কেটে বরফি বানানোর প্রস্তুতি হতো। মেজো বোন নাজমা ও আমি খেজুর গাছের কাঁটা দিয়ে মোরব্বা কেচতে বসতাম। কিছুক্ষণ পর মন চলে যেতো খেলার মাঠে, যেখানে ঝুনু, রেণু, হাসনা, ইসকন, আতিক, ফারুক, হাসনু, ওরা সমবেত হয়েছে হা-ডু-ডু খেলায়। আহারে, আম্মা কেন এতো নির্দয় আজ? কেন বুঝতে চাইছেন না, আমরা আর তাঁর কাজে উৎসাহ পাচ্ছি না! অতএব, মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ছি, আর আল্লাহকে বলছি হে মাবুদ, আমার মা’র মনে একটু দয়া দাও। আমরা যে নিস্তার চাই। ছোটদের দোয়া সম্ভবত খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যায় আল্লাহ্র আরশে। একটু পরই মামণি মিষ্টি করে হেসে বললেন, তোমরা একটু নাস্তা খেয়ে খেলতে চলে যাও, তবে মাগরিবের আগে বাড়ি ফিরে এসো।
বারেবারেই স্মৃতির কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। ঈদ মানে আনন্দ এবং তারই সঙ্গে মনে আসে স্মৃতির শহর। যা প্রত্যেকের জন্যই জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রহর।
ছেলেবেলার শহর মৌলবীবাজারে মনু নদীর তীরে যাপিত জীবনে দেখেছি কুরআনের প্রকৃত প্রতিফলন। আমাদের মুরব্বিরা নিজেদের মুড়ে রেখেছিলেন কুরআনের বাণী ও নির্দেশে। পর্দা করতেন, পর পুরুষের সামনে যেতেন না, গলার আওয়াজ কাউকে শুনতে দিতেন না, এই ছিল আমার আম্মা, খালাম্মার জীবন। তাঁরা তাঁদের কুসুমের মতো সুন্দর চেহারা কখনো বাইরের লোককে দেখতে দেননি। আমাদের বাড়িতে কাজ করতেন মহিলারা, বেড়াতে আসতেন মহিলারা। আত্মীয়-স্বজন বলতে মামুরা ও ভাগ্না-ভাগ্নিরা, কখনো নবীগঞ্জ থেকে চাচারা এলে বৈঠকখানায় বসতেন। পরম সমাদরে দস্তরখানা বিছিয়ে ফুল তোলা খাঞ্চায় সাজিয়ে তাদের জন্য পাঠানো হতো নানা মুখরোচক ইফতারি, খোরমা খেজুর শসা বুট পেঁয়াজু বেগুনি পরোটা কোরমা আখনি পোলাও থেকে শুরু করে আম আনারস কলা এবং অবশ্যই অনেক লেবুর রস ও চিনি দিয়ে তৈরি শরবত। ঠাণ্ডা নয়, কারণ আমাদের শহরে তখনো বিজলি বাতি আসেনি, তাই ফ্রিজ কি জিনিস কেউ জানতো না। কখনো বাজার থেকে বরফ কিনে এনে তার কুচি দেয়া হতো শরবতে। চাচাদের সামনে বসে আপ্যায়ন করতাম আমরা ছোটরা, আম্মা তো পর্দার বাইরে আসতে পারেন না।

এখন চারপাশে বিজ্ঞাপন ও পত্রিকায় পণ্য হিসেবে শুধু মহিলাদের ছবি। রাস্তায় বড় বড় বিল্ডবোর্ডে পণ্য হিসেবে শোভা পাচ্ছেন নারী। দেখে দুঃখ হয়, এ কোন জগতে বাস করছি আমরা। বিদেশী ছায়াছবির মরীচিকায় বাধা পড়ছে আমাদের কিশোরীরা। আব্রু হলো নারীর সৌন্দর্য, এমনটি বলেন না কেউ। শিক্ষা দিতে গিয়ে মডেল ও পণ্য কন্যা হওয়ার রাস্তায় ধাবিত করছি পুষ্প কুঁড়িসম হৃদয়কে। এ অপরাধ আমার আপনার সকলের, এ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে হবে। শেষের সেই দিনটির কথা চিন্তা করার এবং হৃদয়ে গেঁথে নেয়ার সুযোগ এই পবিত্র রমজান মাস। যিনি মৃত্যু চিন্তা করেন তিনি বিপথ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেন। সুলভে সস্তায় মোবাইল ফোনে কথা বলার ফাঁদ থেকে আত্মরক্ষা, ফেসবুকে জানা অজানা চেনা অচেনা সকলের কাছে নিজেকে তুলে না ধরা, রাত বিরাতে কম্পিউটার খুলে না বসা, এসএমএস করার ব্যাধি থেকে নিজেকে বাঁচানো এখন ফরজ হয়ে গেছে। দিন তো এক এক করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ইহকাল ও পরকালের মধ্যে দূরত্ব খুব বেশি নয়। একটি বার ভাবুন, দেখবেন নিজেকে পরিণত করতে পারবেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষায় দীক্ষিত এক মুমিন বান্দায়।

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর নাত ও হামদে তুলে ধরেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন ও আল্লাহর বাণী। এগুলো শুনলে আপনা থেকেই মনের কালি ধুয়ে মুছে যায়। শুভ্র এক আয়নার মতো ভেসে উঠে সত্যের বাণী যা যুগ যুগ ধরে মানুষের পথ দেখানোর এক সোনালি দলিল। সিরাজুম মুনীরা উজ্জ্বল প্রদীপসহ আছেন আমাদের পথপ্রদর্শক। তাই কান পেতে রই দূর থেকে ভেসে আসা সুমধুর সুরে-
‘রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ॥’
শাওয়ালের এক ফালি বাঁকা চাঁদ আকাশে উঁকি দেয়া মাত্র যে প্রিয় মুখটি হৃদয়ের পটে জ্বলজ্বল করে ওঠে, তিনি আমার মা। এবং সেই মুহূর্তে আমি বর্তমান-ভবিষ্যৎ, কর্তব্য-অকর্তব্য সব ভুলে ডুব দেই এক গভীর আনন্দ সরোবরে, যার নাম আমার শৈশব।
রমজান মাস, বিশেষ করে সিলেটের মৌলভীবাজার মহকুমার অধিবাসীদের জীবনে ছিলো পবিত্রতায় মোড়া এক পুণ্য মাস। প্রায় সব বাড়িতেই দিনে রান্নাবাড়ার পাট নেই, ছোটদের জন্য একবেলা চুলো ধরিয়ে অল্প কিছু রান্না হতো। আসল আয়োজন শুরু হতো জোহরের নামাজের পর, আম্মা সকাল থেকে কুরআন শরিফ তিলাওয়াত করছেন, দরূদ শরিফ পড়ছেন, দুপুরের পর গোসল সেরে মাথায় ঘোমটা টেনে ঢুকলেন রান্নাঘরে। সঙ্গে তারই বুয়া। ইফতারে সবার চাহিদা মতো খাবার তৈরি যতই ঝামেলার হোক ততই বুঝি আনন্দের। তাই তো খাঞ্চা ভরে ভরে রকমারি ভাজাভুজির আয়োজন। লেবুর শরবত, বেলের শরবত, বাঙ্গির শরবত, আদাকুচি, কচি শসা, কাঁচা ছোলা, বুটভাজা পেঁয়াজ, বেগুনি, আলুনি, আখনিপোলাও, খাসিকাবাব, সরু চালের জাউ, হালুয়া ফিরনি।

বড় চৌকিতে দস্তরখান বিছিয়ে সব সাজানো হয়েছে। আমরা ছোটরা বিকেল থেকেই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছি। তর সয় না যেন, কখন আজান দেবে, এতো দেরি করেন কেন মুয়াজ্জিন সাহেব, ঘড়ির কাঁটা যেন নড়ছে না, ভাবতে ভাবতে হঠাৎ শুনি আম্মার মধুর কণ্ঠ। ‘কইগো সোনামণিরা, ইফতার খেতে এসো।’ রাতে তারাবি পড়তে যেতেন বড়ভাই পাড়ার মুসল্লিদের সঙ্গে। সন্ধ্যে রাতে ভাত খাওয়ার ইচ্ছে কারও থাকতো না, সেহরির জন্য আম্মা করতেন স্পেশাল মেনু। মোরগ মুসাল্লাম বা খাসির কোরমা, সঙ্গে পরোটা ও গরম ভাত। রাত তিনটায় উঠে খড়ির চুলো জ্বালিয়ে ভাত রান্না হতো, তরকারি গরম করা হতো। আমি ও আমার ছোট বু-যার বয়স হয়েছে মাত্র নয় বছর, প্রায়ই বায়না ধরতাম রোজা রাখার। তখন গ্রীষ্মকাল প্রচণ্ড গরম, সূর্য অস্ত যায় দেরিতে, ছোট শিশুকন্যাদের শান্ত করার জন্য মা বের করলেন এক বুদ্ধি। ‘ঠিক আছে তোমরা রাতে উঠে সবার সঙ্গে সেহরি খাও। সকালে আটটার সময় কলসিতে রোজাটাকে রেখে একটু নাস্তা খাও। আবার কলসির মুখ থেকে রোজাকে নিয়ে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করো। দুইটার সময় রোজাটাকে কলসিতে রেখে অল্প ভাত সালুন খেয়ে নাও। এরপর একেবারে মাগরিব পর্যন্ত আর কিছু না। এক ঢোক পানিও না’। সত্যি মামণি তুমি বড্ড ভালো, মায়ের গলা জড়িয়ে উল্লসিত দুই বোন।

শবে কদরের রাতে দু’হাতে লতাপাতা ফুল চাঁদ তারা সুরুজসহ কতো নকশা করে মেহেদি পরা হতো। কার হাতের রঙ কতো গাঢ় হয়েছে তাই নিয়ে সে কী হইচই। রাত জেগে ইবাদত করার প্রতিযোগিতা হতো। কে পাঁচশো বার সুবহান আল্লাহ্ পড়েছে। কে সাতশো বার লা ইলাহা পড়েছে, কার তাসবিতে দরূদ শরিফ জপেছে হাজার বার, কী উত্তেজনা! একশো রাকাত নফল নামাজ পড়লে অনেক সওয়াব হয়, সে খবরও জানা। তবে শবে-কদরে আম্মা ছোটদেরও আসল রোজা রাখতে দিতেন। সেটি একটি বড় ব্যাপার এবং সে দিন ইফতার হতো মহা ধুমধামে। রোজায় বাড়ি বাড়ি ইফতারি আদান প্রদান হতো। মেয়ের জামাইকে খাঞ্চা ভরে ভরে ইফতারি পাঠানো হতো। বেয়াই বাড়িতেও খুব যত্নসহকারে ইফতারি পাঠানো হতো।
আমার বড় মামু সৈয়দ মোস্তফা আলী তার কর্মস্থল থেকে মানি অর্ডারে টাকা পাঠিয়ে দিতেন, তাতে লেখা থাকতো, ‘¯েœহের বোন খানম, তোমার ও বাচ্চাদের ইফতারের জন্য কিছু টাকা পাঠালাম। বোন, তোমরা ভালো থাকো, খুশি থাকো, এই দোয়া। ইতি, বড় ভাই সাহেব।’

ঈদের আয়োজনের প্রস্তুতি পনেরো রমজান থেকেই আরম্ভ হতো। আম্মার প্রধান কাজ আমি, ছোট বু ও বুবুমণির জন্য লেস লাগানো ফ্রিল’ দেয়া লাল-নীল গোলাপি সার্টিনের ফ্রক ও সালোয়ার তৈরি করা। সেলাই মেশিনের ঘড় ঘড় শব্দকে মনে হতো হারমোনিয়ামের সাত সুরের মতো মধুর। বন্ধুদের সবার কাছ থেকে জামাগুলো লুকিয়ে রাখা হতো, কেউ যেন জানতে না পারে ঈদে আমরা কেমন জামা পরবো। অন্যরাও তা-ই করতো, গোপন করার আপ্রাণ চেষ্টা।
বড় মামু, মাইজম মামু, হুরু মামু (সৈয়দ মোস্তফা আলী, সৈয়দ মর্তুজা আলী, সৈয়দ মুজতবা আলী) তিনজনের ¯েœহ একটু বেশি করে বইতো আমাদের জন্য। একই সঙ্গে তিনটি শহর থেকে ফ্রকের কাপড়। রঙিন ফিতা ও আম্মার জন্য সরু পাড়ের ধবধবে সাদা শাড়ি আসত।

রোজার দিনগুলোতে ধর্মকথা শুনতে হতো মুরব্বিদের কাছে। নবীজীর (সা.) জীবনী, খলিফাদের কাহিনী শোনাতেন তারা। হাজী মোহাম্মদ মুহসীন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনকথা শোনাতেন। বাল্যশিক্ষায় পড়তাম, ‘সদা সত্য কথা বলিবে’, ‘কাহারো মনে দুঃখ দিবে না’, ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ’, ‘দরিদ্রকে দান করিবে’, ‘নিরন্নকে অন্ন দিবে।’ এসব নীতিকথা।
বিজলি বাতি ছিলো না আমাদের মহকুমা শহরে। কলের পানি ছিলো না। মোটর গাড়ি ছিলো না। ছিলো মনু নদীর কুলু কুলু ধ্বনি, বাঁশের পাতার শরশর শব্দ, রাতের আকাশে মিটিমিটি তারা, বনের ঝোপে জোনাকির আলো। আর ছিলো পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়-অনাত্মীয় অগুনতি মানুষের পরস্পরের জন্য অনাবিল অফুরন্ত নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।
সোনারঙে মোড়া দিনগুলোতে আমরা ছিলাম বড় সুখে। চাওয়া কম ছিলো বলেই পাওয়াটা ছিলো বড় আনন্দের। সিগারেটের খালি বাক্স, চকোলেটের রাংতা, দিয়াশলাইয়ের বাক্স কুড়িয়ে পেলেই মনে হতো সাত রাজার ধন মাণিক পেলাম বুঝি।
রান্নাঘরে প্রায়ই দেখতাম ময়দা দিয়ে সেমাই, নারকেলের চিঁড়ে, চালের গুঁড়োর পাপড় তৈরি করা হচ্ছে আসন্ন ঈদ উৎসবকে মনে করে।

খাঁটি ঘিয়ের কোর্মা পোলাও কালিয়া জর্দা খুসবুতে দশদিক ভরে তুলতো, আমরা প্রতি প্রত্যুষে গোসল করে নতুন কাপড় পরে আম্মাকে সালাম করে গলা জড়িয়ে ধরতাম। তাঁর মুখে ফোটা হাসিকে মনে হতো ঈদের চাঁদের মতই ¯িœগ্ধ। আজও প্রতিটি ঈদে প্রতিটি উৎসবে মনের মানস সরোবরে ডুব দিয়ে অনায়াসে খুঁজে পাই আমার জান্নাতবাসী জননীকে।

Share.

মন্তব্য করুন