রমজানের ছুটিতে নানাবাড়িতে যাচ্ছে আবির। আবিরের নানাবাড়ি শেরপুর জেলায়। আর ওদের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায়। আবির এবার ক্লাস এইটের ছাত্র। এই প্রথম একা একাই যাচ্ছে নানাবাড়িতে।
বাসস্ট্যান্ড থেকে শেরপুরের বাসে উঠলো আবির। সময় কাটাতে একটা উপন্যাসের বই নিয়ে বসলো।
কিছুক্ষণ পর তার পাশে একজন বয়স্ক মানুষ এসে বসলো। গল্পে এতটাই বুঁদ হয়ে ছিল আবির তার দিকে আর তাকালো না।
বাস ছেড়ে দেওয়ার সময় পার হয়ে গেলো কিন্তু বাস ছাড়ার নাম গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে না। একটু বিরক্ত হলো মনে হয় পাশের লোকটা। আবিরের উপন্যাসটা প্রায় শেষের দিকে। উপন্যাসটা ঐতিহাসিক ঘটনানির্ভর। পাশের লোকটা মনে হয় আবিরের বইটার নাম দেখতে চাচ্ছে। আবির তাই সামনের পৃষ্ঠা বের করলো। বইটা বিখ্যাত ঔপন্যাসিক নসীম হিজাযীর লেখা। নাম ‘সীমান্ত ঈগল’।
অবশেষে বাস ছেড়ে দিলো। আবির এবার লোকটাকে খেয়াল করে দেখলো। আবিরের কেন যেন মুখটা চেনা চেনা লাগছে। লোকটার দাড়ি আছে বড় বড়। এই কারণেই হয়তো সে মনে করতে পারছে না।
আবির আবারো বইয়ের দিকে নজর দিলো। বাসের ঝাঁকুনিতে বই পড়া হচ্ছে না দেখে আবির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রাস্তার আশপাশে ক্ষেত, বাড়ি-ঘর দেখতে লাগলো। বাস কচ্ছপগতিতে এলেঙ্গা এসে থামলো। আবিরের মনে হলো লোকটাকে জিজ্ঞেস করতে যে, তাকে সে চিনে কিনা। কিন্তু লোকটাকে কিছু বলার আগেই লোকটা বাস থেকে নেমে গেল। মনে হয় তার গন্তব্যে তিনি পৌঁছে গেছেন!
বাস আবারো ছাড়লো। এবার একটু দ্রুত চলছে বাস। যখন বাস মধুপুর পৌঁছল তখন আবিরের মনে পড়লো, যে লোকটা তার পাশে বসেছিল সে তো তাদের ভুলোমনা স্যার! আসল নাম জয়নাল স্যার। আবির ক্লাস সিক্স পর্যন্ত যে স্কুলে পড়েছে সেখানে গণিতের শিক্ষক ছিলেন তিনি। আগে তার দাড়ি ছিল না। এই জন্যই তাকে আবির চিনতে পারেনি।
জয়নাল স্যারকে সবাই ভুলোমনা স্যার বলে ডাকতো।
তার কারণ অবশ্য অনেক। স্যার অনেক মজার মজার কাণ্ড ঘটাতেন। তার মধ্যে থেকে কয়েকটা ঘটনা আবিরের চোখের সামনে ভাসতে লাগলো।
একবার স্যার বাসা থেকে সরাসরি এসে ক্লাসে ঢুকলেন। ক্লাসের সামনে বসা ছাত্ররা প্রথমে হেসে দিলো। তারপর সবাই হেসে দিলো ব্যাপারটা দেখে। স্যার কিছু বুঝতে না পেরে একটু রাগি ভাব নিয়ে বললেন, ‘কিরে হাসছিস কেন তোরা?’
তখন আবিরদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় তানভীর বললো, ‘স্যার আপনার জুতা!’
স্যার এবার নিজের জুতোর দিকে তাকিয়ে দেখলেন। নিজেও অবাক হয়েছেন। তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে তিনি নিজের জুতা না পরে তার মেয়ের জুতা পরে এসেছেন!
আরেক দিনের ঘটনা। স্যারের বাসার সামনের গলিতে আবিরদের হোস্টেল। আবির প্রাইভেট পড়ে হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সময়টা শুক্রবার সকালের দিকে। স্যার হয়তো দোকানে গিয়েছিলেন চা খেতে। আবির দেখলো স্যার পত্রিকা মুখের সামনে মেলে ধরে পড়তে পড়তে আসছেন। আবির সালাম দিয়ে বললো, ‘স্যার কোথায় যাচ্ছেন?’
স্যার পত্রিকা থেকে মুখ তুলে বললেন, ‘কেন! বাসায় যাচ্ছি!’
আবির মুচকি হেসে বললো, ‘স্যার আপনার বাসাতো ফেলে রেখে এসেছেন।’
স্যার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বাসার দিকে রওনা হলেন। আবিরের কাছে আজ অবাক লাগেনি স্যারের কাজটা। জয়নাল স্যার ভুলোমনা এটা সারা স্কুলের সবাই জানে। আর বাসা ভুলে অন্য গলিতে ঢুকে পড়া তার প্রায় প্রতিদিনের রুটিন বলা চলে। তিনি বলেন, তিনি নাকি গণিতের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতে করতে অন্য গলিতে ঢুকে যান। আর প্রতিবার কেউ না কেউ তাকে বাসার ঠিকানা মনে করিয়ে দেয়।
অনেকে আবার তাকে আবিরদের স্কুলের আইনস্টাইন বলতো।
ভুলোমনা স্যার যেমনই হোক তিনি ছাত্রদের সাথে মিশে যেতে পারতেন। তিনি যখন অবসর নিলেন তখন ক্লাসের এমন কোন ছাত্র ছিলো না যে কাঁদেনি। আবিরও সেদিন কেঁদেছিলো। স্যারের চোখেও সেদিন জমা হয়েছিল অশ্রুর ফোঁটা। এরপরে কেটে গেছে চারটি বছর। আজ হঠাৎ স্যারকে দেখেও কিছু বলতে পারেনি আবির। স্যারও কি তাকে চিনতে পারেননি? নাকি ইচ্ছে করেই কিছু বলেননি? নাকি তার কথা ভুলে গিয়েছেন?….
এসব ভাবতে ভাবতেই আবির গন্তব্যে এসে গেল। আর কিছু ভাবার সময় পেল না সে। স্মৃতিগুলোও মনের কোণে লুকিয়ে গেল। হয়তো আবারো বের হয়ে আসবে অন্য কোনো মুহূর্তে!

Share.

মন্তব্য করুন