একটি জঙ্গলে ছিল কিছু প্রাণীর বাস। সারা দিন এটা ওটা টুকটাক শিকার ধরে, বাকি সময় নিরিবিলি বিশ্রামে কেটে যায় বেলা। সবার মধ্যে একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যেই তাদের জীবন কাটতো। সেখানে বাঘ বা সিংহ না থাকায় তাদের জীবন ছিলো স্বাধীন ও সাধারণ। তারা কেউ হিংস্র পশু দেখেনি বলে পশু-পাখিরা তাদের বাচ্চাদের গল্প শোনাতো ভয়ঙ্কর বাঘের। বাঘ যে অন্য সব পশুদের অনায়াসে শোষণ করে আর তার গর্জনে ভয়ে কেঁপে মরে সবাই, এমন ভয়াবহ গল্পে সয়লাব চারিদিক। যা শুনে শুনে পশু-পাখির ছানাপোনা শাবকেরা মনে মনে ভয়ে গুটিয়ে থাকে। তাদের ছোট্ট বুদ্ধির কল্পনায় ভয়ঙ্কর চরিত্রের বাঘের শিকার ধরা, খাওয়া, হাঁটা নিয়ে কৌতূহলের নানা চিত্র আঁকতে থাকে। একদিন জঙ্গলের কিছু পশুছানা বসে এমন ভয়ানক গল্পের পসরায় বাঘের তথ্য বিনিময়ে ব্যস্ত। এক ধূর্ত শিয়াল ওই পথে হেঁটে যাচ্ছিলো। যাবার সময় ওই গল্প শুনে তার দুষ্টু মাথায় বুদ্ধি এঁটে ফেলতে সময় লাগেনি। পরদিন সেই বুদ্ধির পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে চুক্তি করে এক কুকুরের সাথে। শিখিয়ে দেয়া অভিনয় আর কৌশল আত্মস্থ করে কুকুর গায়ে বাঘের মত রং জঙ্গলে যায়। সারা দিনে একবারও ডাক না দেয়ার অভ্যাসটুকু কুকুরটির অভিনয়ের সূক্ষ্মতা আরো বাড়িয়ে দেয়। আয়োজিত সভায় জঙ্গলের সব পশু-পাখি বাঘ দেখার জন্য হাজির হয়ে কৌতূহলের অপেক্ষা ঘোচাতে সবাই ড্যাপ ড্যাপ চোখে তাকিয়ে থাকে বাঘের মুখপানে। সুন্দর উজ্জ্বল গায়ের রংধারি বাঘ দেখে কারো মনে তেমন ভয় সঞ্চার না হয়ে জন্ম নেয় নানা প্রশ্ন। এমন রোগা পাতলা বাঘকে ভয় না করে জয় করার চিন্তা অনেকেরই, কিন্তু মনের মাঝে লুকানো কল্পনার সেই অদৃশ্য ভয় সবাইকে গ্রাস করে রাখে বলে শিয়ালের বুদ্ধিমতে রং করা কুকুরের রাতারাতি মহারাজ বনে যেতে সুবিধা হয়। সবাই তাকে মান্য করার প্রতিশ্রুতিতে শপথ নেয় মহারাজকে সবাই শিকার ধরে খাওয়ানোর। শিয়ালের ঘোষণামতে মহারাজের সাথে কারো দেখা করা বা তার আশপাশে যাওয়া এমনকি তার চলার রাস্তায় হাঁটার নিষেধাজ্ঞা কুকুরের অভিনয়ের চাপ অনেকটা কমিয়ে দেয়। বাঘের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে ধারণা না থাকায় মহারাজের জন্য ফলমূল আনার প্রতিশ্রুতি দেয় সকলে। মহারাজের খেদমতদার হয়ে সব উপহার গ্রহণের দায়িত্বটুকু শিয়াল নিজের কাঁধে তুলে নেয়। শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে জঙ্গলের পশু-পাখির সন্তান কেড়ে নেয়ার হুঙ্কার দিতে শিয়াল ভোলেনি। তাই বাঘের ভয়ে সকলে মেনে নেয় সবকিছুু।

শিয়ালের কথা মত বাঘের রাজত্ব মানতে রোজ রাজ দরবারে হাজির হয়ে যায় নানা উপকরণ। যে যার সাধ্যমত উপঢৌকন নিয়ে আসে মহারাজের জন্য। আর সে সবের মধ্যে ব্যাঙ, ছুঁচো, বেজি থেকে বাঁদর ছানা পর্যন্ত শিকার করে এনে জমা দেয়া হয়। তার সাথে অনেক ফল-মূল তো আছেই। সবার পরিশ্রমের বিনিময়ে শিয়াল বসে বসে খায় আর পরিত্যক্ত এঁটোঝুটা কুকুরকে খেতে দেয়। নির্বোধ কুকুর এতেই খুশি থাকে। মহারাজের জন্য বাড়তি শিকার ধরতে গিয়ে বনের অন্য সবার খাবারের সঙ্কট দেখা দেয় অল্প ক’দিনেই। শর্ত পূরণ করতে গিয়ে নিজের ছানার জীবন বাঁচাতে অন্যের ছানা কেড়ে নিতে হয়। এভাবে সবাই সবার ছোট্ট ছানা কেড়ে নিতে গিয়ে শত্রুতে পরিণত হয় একে অপরের। শান্তির জঙ্গলের দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। নিজেদের ভেতরে শুরু হয় বেঁচে থাকার লড়াই। বাঘের শিকার হতে চায় না বলে অন্য কাউকে শিকার বানিয়ে মহারাজের সামনে জমা করে। শক্তির বহর দেখাতে গিয়ে একে অন্যের সাথে ঝগড়া লড়াই বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। নকল বাঘের কাছে নালিশ নিয়ে এলে মাথায় গোবরে ভরা বুদ্ধি দিয়ে কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ঠিক তখনই ধূর্ত শিয়াল নিজের স্বার্থ বুঝে সমাধান দেয়।
জঙ্গলের আগের শান্তি আর নেই বলে কেবল লড়াই আর লড়াইয়ে মেতে থাকে সকলে। এমন অবস্থায় জঙ্গলের প্রবীণ কাকাতুয়া, হনুমান, হাতি, গণ্ডার, চিল, শকুন আরো কয়েকজন গোপনে শিয়াল আর নকল বাঘের উপর নজর রাখতে শুরু করে। বাঘের চালচলন, হাবভাব দেখে তারা নিশ্চিত হয়ে যায় এটা আর যাই হোক বাঘ হতে পারে না। কিন্তু প্রমাণ হাজির করা পর্যন্ত চুপ থাকাই শ্রেয়।

একদিন জঙ্গলে সত্যি সত্যি একটা বাঘ এসে গাছের তলায় শুয়ে শুয়ে আরাম করছিলো।
দূর থেকে কাকাতুয়া হাতি হনুমান গণ্ডারের দল লুকিয়ে তাকে দেখছিলো। তার চোখের গভীরতা আর চেহারার জৌলুস দেখে ভেতর থেকেই ভয়ের সঞ্চার হয়। রাসভারী বাঘের সুঠাম দেহখানার আকার আকৃতি ও তীক্ষè দৃষ্টির মাধ্যমে নিশ্চিত বাঘের প্রমাণ মেলে। এটাই সত্যিকারের বাঘ বুঝতে অভিজ্ঞদের কোন অসুবিধা হয় না। অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণের পর ভয়ে ভয়ে তার কাছে যেয়ে আলাপজুড়ে দেয়ার চেষ্টা করে। পেটের ক্ষুধা নেই বলে বাঘও ওদের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করে। ভীরু ভীরু মনে নিরাপদ দূরত্ব রেখে জঙ্গলের সব ঘটনা খুলে বলে তারা। মুহূর্তে বাঘের ভীষণ জোরে গর্জনে ভয়ে সবাই পালিয়ে যায় দূর-দূরান্তে। বাঘের হুঙ্কারে জঙ্গল কেঁপে ওঠে। ছোট পাখি ও বাঁদর ছানাগুলো গাছ থেকে ঝপাত ঝপাত মাটিতে ঝরে পড়ে। বন্য পশুরা তড়িঘড়ি করে এদিক ওদিক লুকিয়ে পড়ে। ভুবন কাঁপানো হুঙ্কার দিয়ে বাঘ আবার বলে আমি বাঘ, জাতপশু। তাই কারো শিকার করা খাবার আমি খাই না। কোন ছুঁচো, বেজিতো নয়ই। আমার যখন ইচ্ছে যাকে ইচ্ছা তাকেই শিকার করি। বাঘের বাহুতে বল আছে বলে কোন সহযোগী লাগে না। আমি নিজেই নিজের জন্য যথেষ্ট। বাঘের হুঙ্কারে গোটা জঙ্গলের পরিবেশ গম্ভীর হয়ে যায়। সমস্ত পশু-পাখি কাঁপতে থাকে ভয়ে। শিয়াল আর নকল বাঘের পালিয়ে যাবার দৃশ্যটুকু সবাই দূর থেকেই দেখে আনন্দ পায়। নতুন ভয়ের সূত্রকে উপেক্ষা করেও তারা ভণ্ড শিয়াল ও বাঘরূপী ভিতু কুকুরের পালাবার সময় পানিতে লাফ দেয়ার দৃশ্য দেখে আনন্দ পেতে ভোলে না। কুকুরের গায়ের সব রং ধুয়ে নেড়ি কুকুরের আসল চেহারা বেরিয়ে আসার ঘটনাটাও তাদের জন্য শিক্ষণীয়। আসল নকলের পার্থক্যটুকু বুঝতে বাকি থাকে না কারো। সেই থেকে জঙ্গলে স্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ করে। বাঘ শিকার ধরে ঠিকই কিন্তু যে যার মত বাঘকে এড়িয়ে বাঁচে। এখন তারা নিজের মত করে শিকার ধরে পেট ভরে খায় বলে নিজের শিকারের ভাগ কাউকে দেয়া লাগে না। নকল বাঘ আর শিয়াল ওই দিনের পর থেকে আর কোন দিন ওই জঙ্গলে ঢোকার সাহস দেখায়নি। জঙ্গলে বাঘ এসেছে ঠিকই তবু প্রাকৃতিক নিয়মে জীবন চলে সবার। আবার ফিরে আসে শান্তি। ফিরে আসে স্বাচ্ছন্দ্য। কোন শঠতার ছায়া পড়ে না তাদের জীবনে। শুধু বাঘের নজর এড়িয়ে নিজের জীবন বাঁচিয়ে রাখার কৌশলটুকু রপ্ত করে নেয় সকলে। তাদের জীবনে প্রজা হয়ে বাঁচার দায় থেকে রেহাই পায় তারা।

Share.

মন্তব্য করুন