জগতে সব কাজেরই কৌশল আছে। নিয়ম আছে। পদ্ধতি আছে। আছে গ্রহণ ও বর্জনের ধারা। কাজের ভেতর দিয়ে জীবন গড়ে তোলে মানুষ। কিন্তু জীবন গঠনের জন্য বই পাঠের মতো কাজ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বই পড়ে শিক্ষিত হয় মানুষ। সভ্য হয় জাতি। এবং আধুনিক হয় বিশ্ব। সুতরাং বই পাঠ প্রতিদিন আহারের মতো জরুরি।
বইয়ের বুকে ঘুমিয়ে থাকে মহাকাল। ঘুমিয়ে থাকে ইতিহাস। থাকে অতীতকালের আনন্দ নিরানন্দের কৌতুক। যদি স্বপ্নের কথা বলি, আছে বইয়ের পাতায়। যদি কল্পনার কথা ধরি, জেগে থাকে বইয়ের পৃষ্ঠায়। যদি বাস্তবতার কথা বলি, তাও বইয়ের ভেতর আছে ঠাসাঠাসি। হারানো দিনের সমস্ত জমজমাট বইয়ের পাতায় পাতায়! এভাবে বই হলো সভ্যতার বেঁধে রাখা স্রোত। ভাষার শেকলে বাঁধা থাকে বইয়ের বুকে।
যারা বই পড়েন, তারা ঘটে যাওয়া জীবনের অভিজ্ঞতা পড়েন। যারা বই পড়েন তারা কালের উৎসব পাঠ করেন। যারা বই পড়েন তারা পুরনো স্বপ্নের নতুন উত্তাপ আবিষ্কার করেন।

বই পাঠ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়। এটি এমনই গুরুত্বপূর্ণ একে কোনো ভাবে অবহেলা করা চলে না। চলবে না। যে একে অবহেলা করে তার জীবন মৃতপ্রায়। তার জীবনে সৌন্দর্যের উৎসব থাকে না। আনন্দের সান্নিধ্য থাকে না। জীবনকে গভীর থেকে জানার সুযোগ থাকে না।
একটি জীবন কোনো ছোট ঘটনা নয়। কোনো সহজ লভ্য বিষয়ও নয়। নয় কোনো সস্তা দরের বিষয়। ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ জীবন। অনেক দামি জীবন। অনেক বৃহৎ জীবন। জীবনকে যথাযথ আবিষ্কার করার জন্য বই পাঠের অন্যথা নেই। জীবনকে জাগিয়ে রাখার জন্য বই জরুরি। জীবনকে এগিয়ে নেবার জন্যও বই দরকার। বইয়ের বিকল্প কেবলই বই। বইয়ের স্থলাভিষিক্ত বই ছাড়া কিছু হতে পারে না।

বইয়ের বিপরীতে বই ছাড়া আর কিছু নেই। সুতরাং বই আমাদের নিত্য নিঃশ্বাসের মতো। নিত্য খাদ্যের মতো। নিত্য পানীয়ের মতো। একে গ্রহণ করতে হবে। একে পান করতে হবে। একে সঙ্গী করে নিতে হবে।
কিন্তু যে কোনো বই কি এমন সম্মানের? যে কোনো বই কি হতে পারে নিত্য নিঃশ্বাসের মতো? নাকি হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ? এর জবাব, না। যে কোনো বই জরুরি অথবা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে কোনো বই পাঠ করার প্রয়োজনও নেই। থাকেও না। পাঠের জন্য প্রয়োজন শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ। কোন বই জীবনের জন্য প্রয়োজন! কোন বই গুরুত্বপূর্ণ! এটি বেছে নিতে হবে। আমরা আমাদের জীবনের জন্য সকল কাজ গুরুত্বপূর্ণ ভাবি না। অনেক কাজ থাকে জীবনে। প্রতিদিনও থাকে কাজের বিশাল তালিকা। কিন্তু এ বিশাল তালিকা থেকে বাছাই করি আমরা। কোন কাজটি গুরুত্বপূর্ণ বুঝি আমরা। কোন কাজটি প্রয়োজন সেটি বা সেগুলো বেছে নেই। এককথায় জীবনে অনেক কাজ থেকে প্রয়োজনীয় কাজ বেছে নিতে হয়। নেই আমরা। এ যে বেছে নেয়ার বিষয় এটি সবার জন্য প্রয়োজন। ঠিক বইও আছে অজস্র। এ অজস্র বই থেকে নিজের জন্য বেছে নিতে হবে ঠিক ঠিকটি। যথার্থ বই বাছাই করে পাঠ করার আয়োজন নিতে হবে সবার।

যার যেমন স্বভাব ঠিক স্বভাবের আলোকেই রুচি গড়ে ওঠে মানুষের। স্বভাবের আলোকেই রুচি গড়ে ওঠে সবার। একইভাবে স্বভাব অনুযায়ী মানুষের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। বৈশিষ্ট্যের ধরন অনুযায়ী মানুষ পছন্দ করে খাওয়া। পরা। এবং গড়ে ওঠে দৃষ্টি। দৃষ্টির আলোকেই পথ চলে মানুষ। চলতে চলতে দেখে যায়। যেতে যেতে দেখে। এভাবে মানুষ তার সুন্দর অসুন্দরের পার্থক্য বোঝে। বইয়ের বিষয় পছন্দের এমনই দৃষ্টি কাজ করে।
কেউ গল্প-উপন্যাস পছন্দ করে। কেউ কবিতা। কেউবা প্রবন্ধ। কেউ কেউ ফিচারধর্মী। কেউ ফের উপসম্পাদকীয়। আবার কেউ পছন্দ করে নাটক ও নাট্য সংক্রান্ত বই। অনেকেই পছন্দ করেন ইতিহাস সংক্রান্ত বই। কেউ পছন্দ করেন ভূগোলবই। কেবল মহাকাশ বিষয়ক। কেউ পছন্দ করেন সমুদ্রবিজ্ঞান। এভাবে মানুষের আগ্রহ রুচি ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বইয়ের বিষয় ও ধরন বদলে যায়।

একটি কথা এসব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সে কথাটি মনে রাখা জরুরি। যে যে বিষয়ে আগ্রহী এটি তার নিজস্ব বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্যের হয়। হবে। এবং হতেই থাকবে। কিন্তু সব বিষয়ের সব বই একজন ব্যক্তির পক্ষে পাঠ করা সম্ভব নয়। আয়ত্ত করাও দুরূহ। এখানে বুঝতে হবে- পছন্দের বিষয়ে সেরা বইগুলো পাঠ করতে হবে। একই সাথে বিষয়ের গভীরে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হবে। এবং জানতে হবে বিষয়ের ভেতর বাহির। আগাগোড়া বুঝতে হবে। অনুধাবন করতে হবে উপর নিচ।
এখন কথা হলো- এসকল বই পাঠের সহজ পথ কী? কি এর গোপন কৌশল? কিভাবে অল্প সময়ে অনেক পাঠ করা সম্ভব। অল্প পড়ে বেশি জানার কৌশলইবা কী?
সব বিষয়ে কিছু রহস্য থাকে। কিছু প্রকাশ্য। কিছু গোপন। কিছু কাছের। কিছু দূরের। সবাই সাধারণত প্রকাশ্য এবং কাছের বিষয় গ্রহণ করে। অপ্রকাশ্য এবং দূরেরটির দিকে নজর থাকে না। যারা প্রকাশ্য এবং কাছেরটি গ্রহণ করে তারা সাধারণ। অসাধারণ হতে হলে অপ্রকাশ্য এবং দূরেরটি গ্রহণ করা জরুরি। এ কারণে অসাধারণ মানুষের সংখ্যা খুবই কম। অসাধারণ মানুষেরাই সমাজে সম্মানিত। আদরণীয়। গ্রহণীয়।

বই পাঠেরও রয়েছে কিছু প্রকাশ্য কৌশল। কিছু অপ্রকাশ্য বা গোপন কৌশল। প্রকাশ্য কৌশল আমরা সকলেই জানি। বই পেলেই পাঠ করার একটি নিয়ম তো আছেই। এখানে পছন্দ অপছন্দও কাজ করে। করবে।
কিন্তু আমরা বলতে চাই গোপন কৌশলের কথা। গোপন কৌশলটির প্রথম ধাপ হলো- পছন্দের বিষয়ে সেরা বইটি অথবা বইগুলো বাছাই করা। এর মধ্যে বিষয় নিয়ে মৌলিক বইটি প্রথমে পাঠ করা। এ পাঠ কোনোভাবেই হালকা পাঠ হবে না। গভীর পাঠ যাকে বলে তা-ই করতে হবে। পাঠ করতে করতে বিষয়ের কিছু মৌলিক দিক মুখস্থ করে নিতে হবে। মুখস্থ একবার করেই বসে থাকলে চলবে না। একে মনে রাখার জন্য আওড়াতে হবে বারবার। স্মৃতিতে নকশা করে নিতে হবে। এভাবে যখন মৌলিক দিকগুলো মুখস্থ হয়ে যাবে। ঠিক তার সাথে ও বিষয় সংক্রান্ত নতুন বইয়ের নতুন তথ্য যোগ হতে থাকবে। ঠিক সাগরে নদী সংযুক্ত হওয়ার মতো। যে স্রোত নিজেকে সমুদ্র বানিয়ে নিতে পারে। তার কাছে নদীরা বিপুল বেগে ধেয়ে আসে। জ্ঞানেরও এমনই পর্যায় রয়েছে। নিজেকে একবার জ্ঞানের স্রোতে সাগর বানিয়ে নিতে পারে যদি কেউ, তার কাছে জ্ঞানের নদীরা ছুটে ছুটে আসবে।

গোপন কৌশলের আরেক ধাপ হলো, একটি বিষয়ে গভীরতা অর্জন করা। প্রতিটি বিষয়ে ভাসা ভাসা জ্ঞানের চেয়ে একটি বিষয়ে ঠাসাঠাসা জ্ঞান অর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এ কৌশলের আরেকটি দিক, যে বিষয়ে পাঠ করবে- সেটি অবশ্যই যেনো আগ্রহের বিষয় হয়। এমন বিষয় যাকে চলতে ফিরতে অনুভব করা যায়। কিংবা করা হয়!
তারপর হলো- পাঠের বিষয়টি ভালোবাসার হতে হবে। প্রেমের জায়গা থেকে পাঠ করতে হবে। এবং একে মনের গহিন থেকে পোষণ করতে হবে।
গোপন কৌশলের আরেক ধাপ হলো, বইয়ের পৃষ্ঠায় থাকা বাণীর সাথে নিজস্ব চিন্তার মিশেল দিতে হবে। দেখা থেকে, ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে এবং খুঁজে পাওয়া বাস্তবতা থেকে যোগ করতে হবে।
গোপন কৌশলের অন্য ধাপ হলো, বইয়ের সাথে প্রজ্ঞা যোগ করে নিতে হবে। পৃথিবীতে প্রজ্ঞার চেয়ে বড় কোনো শিক্ষক নেই। বড় কোনো পুস্তক নেই। গুরুত্বপূর্ণ কোনো রচনা নেই। বই পাঠের সাথে প্রজ্ঞা জড়িয়ে নিলে জ্ঞানের যে চেহারা দাঁড়ায় তার সাথে পৃথিবীর কোনো জ্ঞানের তুলনা চলে না।

এ কৌশলের সর্বশেষ ধাপ হলো- প্রকৃতির গোপন রহস্যের সাথে বইয়ের রহস্যকে মিলিয়ে নেয়া। প্রকৃতি পাঠ করা বই পাঠের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ প্রকৃতিরই অংশ। প্রকৃতির ভেতর জগৎ আর জীবনের ভেতর জগৎ খুবই ঘনিষ্ঠতায় জড়িয়ে মুড়িয়ে একাকার। নিজেকে যেমন বুঝতে হবে। প্রকৃতিকেও বুঝতে হবে তেমনই। প্রকৃতি নামক বইটি গভীর ভাবে পাঠ না করলে জগতে কোনো মানুষই পাঠের গোপন রহস্য সম্বন্ধে জানবে না। আর যিনি প্রকৃতির রহস্য জানবেন না তিনি কখনও প্রজ্ঞাবান হবেন না। একইভাবে সত্যটি হলো, প্রজ্ঞা ছাড়া বই পাঠের গোপন রহস্য রপ্ত করাও যাবে না।
তবে এর সবকিছুর জন্য দরকার একচ্ছত্র ধ্যান। নিরন্তর সাধনা। অখণ্ড ভালোবাসা। এবং জীবনকে জীবনের দিকে উঁচিয়ে ধরার সংশয়হীন স্বপ্নের পতাকা। যে পতাকা কেবলই জীবনের গহিন থেকে উড়তে থাকে।

Share.

মন্তব্য করুন