চোখ বন্ধ করো। আমাদের চতুর্পাশটা নিয়ে একটু ভাবা যাক। সমুদ্রসৈকত থেকে ঘুরে আসার কল্পনাটাও করা যায়। অথবা ধরো রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান কিংবা সিলেটের যেসব পাহাড়ে আমরা বেড়াতে গিয়েছি সেসব জায়গাতেই কল্পনার ডানা মেলে আরেকবার ঘুরে আসি, যতদূর কল্পনা করা যায়। দূরের আকাশ। রাতের আকাশে জ¦লজ¦লে তারা, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি এবং আরও আরও যা কিছু ভাবা যায়। এক কথায়, আমাদের টেবিলের উপর সাজানো বই-খাতা, ল্যাপটপ, চশমা এবং পানির বোতল থেকে শুরু করে সমগ্র সৃষ্টি জগৎ নিয়েই আমরা ভাবতে পারি। ভাবার ভেতর, কল্পনা করার ভেতর এক ধরণের আনন্দ আছে। কল্পনা কেবল দেখা জিনিশ নিয়ে নয়, অদেখা জিনিশ নিয়েও বানিয়ে বানিয়ে কল্পনার জগৎ সাজানো যায়। জানো বোধহয়, এক মনীষী বলেছিলেন, ‘কল্পনাই জ্ঞান।’ দুনিয়ায় অনেক জিনিশই আবিষ্কারের আগে তা কল্পনাজাত ছিলো। কল্পনার পথ ধরেই সত্যটা সামনে এসেছিলো।
জগতের ক্ষুদ্র-বৃহৎ সব জিনিশই সৃষ্টি হয়েছে এক ধরণের কণা দিয়ে। তোমার হাতের কলমটা থেকে শুরু করে আকাশের তারাটা পর্যন্ত। এবার বুঝি একটু ধাক্কা লাগলো! হা হা, এটাই সত্য। কালো জিনিশটা, শাদা জিনিশটা, শক্ত জিনিশটা, নরম জিনিশটা, সব সব। সবই সৃষ্টি হয়েছে ওই কণা দিয়ে। হয়তো ভাবছো, আস্ত একটা লোহার পাত কেবলমাত্র কণা দিয়ে কেমন করে তৈরি হতে পারে? খুবই ভালো প্রশ্ন। ধরো, এ মুহূর্তে তোমার হাতে একটা রুটি রয়েছে। এই রুটি তুমি মাংশের ঝোলে ডুবিয়ে তুমি খাচ্ছো! কিন্তু রুটিটা তৈরি হলো কেমন করে? খেয়াল করো, রুটি তৈরি হওয়ার আগে রুটির উপাদান ছিলো খুব ছোট ছোট মিহি ধরণের চালের গুড়ো। ওই চালের গুড়োই পানিতে ভিজিয়ে একধরণের খামি তৈরি করে সেই খামির ছোট ছোট দলা বেলন দিয়ে বেলে সুন্দর এই রুটি তৈরি করা হয়েছে। তাহলে রুটি তৈরি হলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আটার কণা দিয়ে।

তেমনিভাবে বিমান বা হেলিকপ্টার থেকে একটি বালুর মাঠের দিকে তাকালে দেখবে, সেটা একটা বিস্তৃত প্রান্তর। কিন্তু তুমি যখন কাছে নেমে আসবে তখন দেখবে ওগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য বালুকণা। এই বালুকণা দিয়েই তৈরি হয়েছে এই বিশাল প্রান্তর। এভাবে প্রত্যেক জিনিশ, যা অন্য জিনিশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের, এগুলোর সবই সেই কণা দিয়ে তৈরি হয়েছে। অবশ্য এই কণাগুলো কিন্তু বালুর মতো অতো বড়ো নয় মোটেই। এতো ছোটো যে তাকে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও দেখা যাবে না। বরং একটা বালুর মাঠে যতগুলো বালু আছে তারও চেয়ে বেশি কণা আছে ওই একটা বালুর ভেতরই! সমস্ত দুনিয়ার সমুদ্রে যত পানি আছে, এক গ্লাস পানিতেই আছে তার চেয়ে বেশি কণা। ভাবো, কত ছোটো কণার কথা বলছি তোমাদের। এরকম কণা দশ কোটিকে একসঙ্গে পাশাপাশি সাজালে তা লম্বায় আধ ইঞ্চির বেশি হবে না। এরকমভাবে সারা দুনিয়ার সমস্ত জিনিশ তৈরি হয়েছে যে কণা দিয়ে তারই নাম পরমাণু।
এবার প্রশ্ন হতে পারে, পৃথিবীর সবকিছুই একই জাতের পরমাণু দিয়ে তৈরি কিনা। না, তা নয়। তবে পৃথিবীর প্রায় নিরানব্বই ভাগ জিনিশই তৈরি হয়েছে মাত্র ডজনখানেক পরমাণু দিয়ে। ও হ্যাঁ, মোট পরমাণুর সংখ্যা তো বলা হয়নি। তোমাদের কী ধারণা, সমস্ত জগতের কোটি কোটি জিনিশ, অগণন, অসংখ্য জিনিশ তৈরি হতে নিশ্চয় লক্ষ লক্ষ জাতের পরমাণুর দরকার পড়েছে! না, তা কিন্তু নয়। এখনও পর্যন্ত পরমাণুর সংখ্যা হলো মোট ১০৩ তিন জাতের। এদেরই ডজন খানেকের কথা বলছিলাম, যা দিয়ে কিনা জগতের নিরানব্বই ভাগ জিনিশই তৈরি হয়েছে। দুনিয়ায় এত নানান ধরনের জিনিশ থাকার কারণ হলো, মাত্র কয়েক জাতের পরমাণুকেই বহুভাবে সাজানো যায়। মাত্র তিনচার রঙের সুতো দিয়ে যেমন অসংখ্য রকমের নকশা তৈরি করা যায়। এও ঠিক তেমনি ব্যাপার।
আচ্ছা, যে পরমাণু কিনা এতই ছোট, তা কি আদৌ আছে? এরকম প্রশ্ন কি হতে পারে না? আর যদি থাকেওবা, তাহলে আমরা তা কেমন করে জানলাম?

এ ব্যাপারটি জানার পথ মোটেও কিছু সহজ ব্যাপার ছিলো না। কয়েকশো বছর ধরে বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করেছেন, নানারকম বস্তুতে তাপ দিলে তা থেকে কী ফল পাওয়া যায় সে বিষয়ে। কোনটা ফোঁস করে জ¦লে ওঠে, ভেজা আবহাওয়ায় কোনো কোনো জিনিশে কেনই বা মরচে ধরে, কিংবা কোনো জিনিশ ফেলে রাখলে তা পচে মাটিতেই বা কেন মিশে যায়, ইত্যাদি। কার কী গুণাগুণ, কী রকম পরিবেশে কী ফল পাওয়া যায় তা নিয়ে, নানারকম জিনিশ নিয়ে বিজ্ঞানীদের এই পরীক্ষা চলছিলো। এই পরীক্ষাকেই বলা হয় রসায়ন।
একসময় রসায়নবিদরা তাঁদের পরীক্ষার ফলাফল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সিদ্ধান্ত করলেন যে, পরমাণু নামের ছোট ছোট কণার অস্তিত্ব রয়েছে। এই পরমাণু না থাকলে বিজ্ঞানীদের অনেক আবিষ্কারেরই কোনো ব্যাখ্যা বের করা যেত না। ১৮০৩ সালে সালে জন ডালটন নামের একজন ইংরেজ রসায়নবিদ প্রথম আধুনিক পরমাণু তত্ত্বের প্রবর্তন করেন। যদিও প্রাচীন গ্রীকদেরও এক ধরনের পরমাণু তত্ত্ব ছিলো।

এরপর দেড়শো বছরে বিজ্ঞানীদের সব পরীক্ষাতেই এই তত্ত্বেও সমর্থন পাওয়া গিয়েছে। কাজেই পরমাণু দেখা না গেলেও আজ তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহের আর কোনো সুযোগই নেই। এই পরমাণুরই অন্য নাম অ্যাটম।
এবার তোমরা হয়তো ভেবেই বসেছো, পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট জিনিশই বোধহয় এই পরমাণু। না, আসলে তাও নয়। ১৮৯০ সালের পর বায়ুশূন্য জায়গা দিয়ে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালিয়ে কতকগুলো পরীক্ষার ফলাফল থেকে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, পরমাণুর চেয়েও ছোট কণিকার অস্তিত্ব আছে। আসলে সব পরমাণুই এইসব অতি কণিকা দিয়ে তৈরি। এই অতি কণিকার নাম দেয়া হলো অতি পারমাণবিক বা মৌল কণিকা।
আজ এ পর্যন্ত থাকুক। তবে পরমাণু নিয়ে আলাপ এখানেই শেষ নয় কিন্তু। যে জিনিশ দিয়ে জগতের সবকিছুই তৈরি, তা নিয়ে এত সহজেই আলাপ শেষ হতে পারে না। পরম বিস্ময়ের এই পরমাণু নিয়ে তোমাদের কৌতূহল হচ্ছে নিশ্চয়। হ্যাঁ, এখন তাহলে তোমরা পড়তে লেগে যাও। হতে পারে, তোমাদেরই কেউ কেউ হয়তো পৃথিবীবাসীর জন্য নতুন কোনো বিস্ময়ের খবর নিয়ে আসছো।

Share.

মন্তব্য করুন