নতুন শ্রেণী, নতুন সবকিছু এক অন্যরকম অনুভূতি। খুশিও ছিলাম অনেক কেন-ই বা হবো না, সমাপনী পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার পর একটি ভালো বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। পরিবারের সবাই আমার ফলাফলে সন্তুষ্ট ছিলেন।
তারিখটা ঠিক মনে নেই। বোধহয় তখন ছিল মার্চ মাস। শীতকাল চলে গেছে। শুরু হয়েছে বসন্ত। সকালে আমি ঝটপট করে জেগে হাত-মুখ ধুয়ে গোসল করে ফেলেছি। দিবা শাখায় পড়ি তো তাই যথাসাধ্য দ্রুততার সাথে দুপুর বারোটার মধ্যে কাঁধে ব্যাগ আর টিফিন বাক্স নিয়ে বাবার সাথে চলে যেতাম। একদিন ক্লাস করছিলাম মাফরুহা আপার। সবাই তাকে চায়না মিস বলে ডাকে। তিনি গণিত শিক্ষিকা। তিনি ঐদিন ‘তথ্য ও উপাত্ত’ অধ্যায় পড়াচ্ছিলেন। তখন হঠাৎ এক বড় আপু এলেন আর বললেন, তোমরা কারা কারা পহেলা বৈশাখের জন্য গান গাইতে চাও?
অল্প কয়েকজন উঠে দাঁড়ালো। তাদের সঙ্গে আমিও দাঁড়ালাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম,
– আপু, গান দলীয়ভাবে হবে নাকি এককভাবে?
– দলীয়ভাবে গান শেখানো হবে। শিগগিরই যেতে হবে হলরুমে সেখানেই গান শেখানো হবে।
অতঃপর ম্যাডামের সম্মতি নিয়ে প্রস্থান করলাম। আপু আমার আগেই চলে গেলেন। আমি তো নতুন ছাত্রী, বেশি কিছু চিনি না। তারপরও অনেক খোঁজাখুঁজির পর গেলাম গান শেখানোর জায়গায়। দেখলাম নীলিমা আপু, ফারিহা, নাবিলা আমার বান্ধবী ও আরও কয়েকজন বেঞ্চে বসে আছে। ঐটা ছিল আমাদের স্কুলের প্রশাসনিক ভবন। অতঃপর, আমি দেখলাম নীলিমা আপু অন্য এক বড় আপুর সাথে কথা বলছেন। আমি বললাম, আপু তোমরা এখানে কী করছো?
– আমি গান শেখাবো। আর ইনি হচ্ছেন অয়মি আপু। ইনি কবিতা আবৃত্তি শেখাবেন।
– তাহলে আমি কবিতা আবৃত্তিতে নাম দিতে পারবো? অয়মি আপু বললেন, হ্যাঁ পারবে। এই যে এখানে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারাও নাম দিবে। ২১ ফেব্রুয়ারিতে যারা কবিতা আবৃত্তি করেছিল তাদের তুমি ডেকে নিয়ে আসবে এবং বলবে এইবার পহেলা বৈশাখের আবৃত্তিতে অংশ নিতে। ঠিক আাছে?
– আচ্ছা, আমি ওদের ডেকে নিয়ে আসছি।
অতঃপর, আমি আদিবা, সুমাইয়া, অনন্যা আর সিনথিয়াকে নিয়ে এলাম। অয়মি আপু বললেন, আমি তোমাদের গান ও কবিতা একসাথে হলরুমে শিখাবো। নীলিমা আপু বললেন, অয়মি আপু ঢাকা বিভাগে কবিতা আবৃত্তিতে প্রথম স্থান লাভ করেছে। এ কথা শুনে আমি ভাষাহীনভাবে চেয়ে আছি।
আমাদের সকলে একসাথেই গান ও আবৃত্তির প্র্যাকটিস হতো। আর যারা আবৃত্তি করবে তারা ষষ্ঠ শ্রেণির এবং যারা গান গাইবে তারা সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণীর ছিল। সবাই আমাদের থেকে সিনিয়র ছিল। তাই আমরা তাদের বড় আপু বলে ডাকতাম। আমাদের টিফিন টাইমের সময় প্র?্যাকটিস মাঝে মধ্যে ক্লাস চলাকালীন সময়ে করানো হতো। একদিন রওশন আরা ম্যাডাম, মাহমুদা ম্যাডাম, আজমিয়ারা ম্যাডাম এলেন। তারা এসে বললেন, সবাইকে একরকম লাল-সাদা শাড়ি পরতে হবে। এই কথা শুনে আমি হয়ে গেলাম হতবাক। আমি বললাম, না আমি পরতে পারবো না, আমি কখনো শাড়ি পরি নাই। তারপরে আজমিয়ারা মিস বললেন, তুমি আরো পাঁচ বছর এই স্কুলে পড়বে, এবার শাড়ি যদি না পরো তাহলে অন্যসময়ও তো পরতে পারবে না। তাই এবার পরো। সামিয়া আপু বলল, হ্যাঁ আমিও ক্লাস সিক্স থেকে শাড়ি পরছি। ফারিহা বলল, না আমিও পারবো না, আমি ফ্রক পরবো। আমিও ফারিহার সাথে বললাম, আমিও ফারিহার সাথে ফ্রক পরবো। শাড়ি না পরার কারণে ফারিয়া তার নাম কেটে দিয়েছিল। কিন্তু আমি ভাবলাম, না এতদিন ধরে প্র্যাকটিস করছি আর একদম শেষ পর্যায়ে এসে নাম কাটা তা ঠিক হবে না। আমি বললাম, আমি শাড়ি পরবো।
অবশেষে পহেলা বৈশাখের দিনটি চলে এলো। চলে এলো পহেলা বৈশাখ ১৪২৬। সকাল ছ’টার সময় উঠে আমি ঝটপট স্নান করে শাড়ি পরিধান করে, সাজসজ্জা করে সকাল আটটায় স্কুলে পৌঁছে গেলাম। আমি স্কুলে আমার বাবার সাথে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা ছিল সকাল ন’টায়। বাবার সাথে স্কুলে গিয়ে দেখলাম কালবৈশাখী ঝড়ের পানিতে স্কুলের মাঠ ভরা। আমি মনে মনে ভাবলাম, এটা কি গতকালের বৃষ্টির পানির জন্য হয়েছে, তাহলে অনুষ্ঠান কোথায় অনুষ্ঠিত হবে? দেখলাম সবাই একে একে হলরুমে প্রবেশ করছিল। তাই আমিও রুমে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ করা মাত্রই দেখলাম হলরুম অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল। আর দেখলাম আমার দলের মাত্র দুইজন এসেছে। সুমাইয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম, বাকি সবাই কোথায়?
– জানি না ওদের সাজতে সাজতে দিন শেষ হয়ে যাবে। আমি ঝটপট করে সেজে এসে পড়েছি।
– বোন আমিও তো এসে পড়েছি। মাত্র মর্নিংয়ের গান শেষ হলো হেড স্যারও আসেননি আর আমি এসে পড়লাম।
অতঃপর, দেখলাম আমার দলের একজন এতই ঝটপট করেছে যে সাজতে ভুলে গেছে সে হচ্ছে সিনথিয়া। আমি আর সামিয়া আপু প্রায় একরকম সেজেছি। সামিয়া আপু বলল, তুমি দেখি আমার মত করে সেজেছো, হা-হা-হা।
তারপরে, আমার দলের সবাই এলো। অয়মি আপু একদম শেষে এলো। একদিন প্র্যাকটিসের সময় আমি ঠাট্টা করে বলেছিলাম, আপু, মাইকটা আমার হাতে দিয়ে দিও।
জীবনে প্রথমবার কবিতা আবৃত্তি করব আর মাইকটা আমার হাতে দিয়েছে।
আমি নাবিলার কাছে দাঁড়ানো ছিলাম। সে একেবারে নির্ভীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নুসরাত ও আদিবার হাতেও মাইক দেয়া হয়েছিল তারা তো খুশিতেই শেষ। কিন্তু আমি ভয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি। ঘোষণা করা হলো, অয়মির দল স্টেজে চলে এসো। সবাই উঠলাম স্টেজে। শুরু হবে গান ও কবিতা, কবিতা আবৃত্তি আগে হলো। অয়মি আপুর সঙ্গে আমি ও অনন্যা দাঁড়িয়ে আছি। কবিতা শুরু হলো আমি আবৃত্তি করবো এর মধ্যে আস্তে করে অনন্যা আমাকে বলে, এই মাইকটা আমাকে দাও। আমি বললাম, না, দুইজন মিলেই মাইক ধরবো। অনন্যা ও আমি শক্ত করে মাইক ধরে আছি ও আবৃত্তি করছি। আবৃত্তি শেষ হলো এবার শুরু হলো গান, চলে গেল আমার ভয়। গানের সময়েও আমি স্টেজে দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু মাইকটা তখন নীলিমা আপু ও সামিয়া আপু ধরেছিল। আমি দু’চোখ দিয়ে বাবা-মাকে খুঁজি এবং সবার সাথে গান গাই। খুঁজে পেলাম না বাবা মাকে।
শেষ হলো গান ও কবিতার পর্ব। স্টেজ থেকে নামলাম এবং দেখলাম বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছে। আমরা হলরুম থেকে বের হয়ে মোবাইল দিয়ে ছবি উঠালাম। হঠাৎ দেখলাম ফারিহাকে, সে বলল, কবিতা আবৃত্তি করে ফেলেছ? আমি বললাম, হ্যাঁ, আমিতো আবৃত্তি করে ফেলেছি। ফারিহা বলল, কাউকে কিন্তু বলবে না, গতকাল আমার বাবা আমাকে নিয়ে মার্কেটে গিয়েছিল।
তিনি বললেন, তোমায় শাড়ি কিনে দেই?
– তা আগে বলতে পারতে, এই শাড়ির জন্যই তো আমি কবিতা থেকে নাম কেটে দিয়েছিলাম তুমি তো মানা করেছিলে শাড়ি পরতে।
এই কথা শুনে আমি হাসতে হাসতে শেষ।
অতঃপর, আমি আমার বাবা-মার সাথে বাসায় ফিরে এলাম।
এ দিনটি আমার সবসময় মনে থাকবে। এই বাংলা নববর্ষে আমি প্রথমবার স্টেজে গিয়ে কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম। এই দিনটিকে আমি আমার মনের স্মৃতিতে আঁকড়ে রাখবো।

Share.

মন্তব্য করুন