রঙ, তুলি, কাগজ, পেন্সিল- এমন কতগুলি বিষয়ের নাম, যেগুলো হাতে পেলেই ছোটদের কিছু একটা আঁকতে ইচ্ছে করে। এটা শিশুদের কিংবা বলা যায়, ছোটদের স্বভাব। একেবারেই ইচ্ছে করে। এটা শিশুদের কিংবা বলা যায়, ছোটদের স্বভাব। একেবারেই যারা ছোট ছবি আঁকা বিষয়ে যাদের কোন ধারণাই নেই, কিংবা ছবি কি তাও জানে না, তাদেরও আঁকতে ইচ্ছে করে। এজন্য, এই ইচ্ছের কারণেই অনেকে নানা ধরনের হিজিবিজি রেখা টেনে কাগজ পূর্ণ করে। এই যে রেখা টানা বা রেখা আঁকা এটা কিন্তু কেউ শিখিয়ে দেয় না। শিশুরা নিজের মনেই এগুলো করে। এগুলো করে আনন্দও পায়। বাবা মাকেও দেখায়। শিশুর সৃষ্টিশীল এই রেখার সমষ্টি দেখে বাবা মা আনন্দ পান। আনন্দ পান এ জন্য নয় যে, তাদের ছেলে কিংবা মেয়ে খুব সুন্দর কিছু এঁকেছে। আনন্দ পান এ জন্য যে, তাদের সন্তানেরা নিজে নিজে ভাবতে এবং কিছু করতে শিখছে। শিশুর মেধা বিকাশের শুরু এভাবেই।
এরপর শিশু যখন বড় হতে থাকে, কিছু কিছু বিষয়ে বুঝতে শেখে, তখন বুঝে আঁকতেও চেষ্টা করে। তার ইচ্ছেমত বিভিন্ন বিষয়ের আকার দেয়। যেমন- ফুল, পাতা, মুখ, পাখি ইত্যাদি। আমাদের দেশে শিশুরা কিভাবে ছবি আঁকবে সে বিষয়ে নানা ধরনের ছবি আঁকার সবই পাওয়া যায়। এসব বইতে ছবি আঁকার নানা পদ্ধতির কথা বর্ণনা করা থাকে। যেমন- একটি ডিমের আকৃতি এঁকে তার এক দিকে পাখির মাথা ও ঠোঁট সংযোজন এবং অন্য দিকে লেজ দিয়ে নিচে দু’টো পা দিলেই পাখি হয়ে যায়।
শিশুরা সেই ডিমের ছবি দেখে আঁকতে শেখে। এভাবে আঁকতে শেখার পাশাপাশি নিজেরাও আঁকার পদ্ধতি উদ্ভাবন করে। যেমন- খাতার কাগজের উপর হাত রেখে আঙ্গুলগুলোর পাশ দিয়ে পেন্সিলের রেখা টেনে সুন্দর হাতের ছবি আঁকেন। এর পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে আঁকার পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার সন্ধান পেলে তারা নিজেরাই আঁকার বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করে।
যেমন- আমরা তরবারীর জন্য যে ঢেঁরস ব্যবহার করি সেই ঢেঁরস মাঝ বরাবর কেটে কালি বা রঙে চুবিয়ে ছাপ দিলে সুন্দর ফুলের আকৃতি তৈরি হয়। এসব প্রক্রিয়া শিশুদেরকে সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে অনেক বেশি উৎসাহিত করে।
বড় করে ‘দ’ লিখে সেটাকে যে পাখিতে রুপান্তর করা যায় সে বিষয়টি তাদের জানালে দেখা যাবে তারা সেই ‘দ’ এর সাহায্যে পাখি আঁকা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। নানাভাবে ‘দ’ এর রূপ দিয়ে পাখি এঁকে খাতা পূর্ণ করে ফেলবে। কী দিয়ে কী হয়, কী দিয়ে কী আঁকা যায়- এসব বিষয়ে শিশুদেরকে অবহিত করলে তারা নিজেরাই সৃষ্টির নেশায় যেতে উঠবে। একের পর এক আঁকতে থাকবে তাদের পরিকল্পিত বিষয়গুলো।

বয়সে যারা অপেক্ষাকৃত বড়, স্কুলে পড়–য়া, যাদের ধ্যান-ধারণা ছোটদের চেয়ে কিছুটা স্পষ্ট, তারা ক্রমান্বয়ে তার চারপাশের বিষয়বস্তু নিয়ে ছবি আঁকতে চেষ্টা করে। যেমন- মানুষ, মা-বাবার মুখ কিংবা নানা ধরনের জীবজন্তু। যদিও এগুলো তার দেখা বিষয়ের হুবহু রূপ নয়। যেমন- মানুষের মুখ। একটি বড় করে গোলাকৃতি ফর্ম এঁকে তাতে চোখ, মুখ, নাক, কান বসিয়ে দেয়া। জীবজন্তুর চেহারাও তারা এভাবেই কল্পনায় আঁকে। কিন্তু এটা কী, কিসের ছবি, সে কথা সে হয়তো স্পষ্ট করে বলতে পারে না।
আমাদের দেশে শিশু চিত্রাঙ্কন শেখানোর জন্য বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সপ্তাহে দুই দিন শিশুদের ছবি আঁকা শেখানো হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক যারা তারা কোমলমতি শিশুদের আঁকা শেখান। অনেককে এমনভাবে তৈরি করেন যে, তাদের চিত্র দেখে মনে করা কঠিন, সেগুলো শিশুদের আঁকা কিনা! অভিভাবকেরাও চান তার সন্তানকে যেন শিক্ষকরা ছবি আঁকার পণ্ডিত বানিয়ে দেন। শিক্ষকরাও বাধ্য হয়ে তাই করেন। কাউকে কাউকে এমনভাবে আঁকা শেখান যে, সেগুলো দেখে মনে হয় শিশুকে ছবি আঁকা মুখস্ত করিয়েছেন। লক্ষ করেছি, এ সকল শিশুরা শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় সব সময়ই পুরস্কার পায়। অথচ যারা নিজের মেধা খাটিয়ে খাটিয়ে নিজের চিন্তায় ছবি আঁকে তারা পুরস্কার থেকে হয় বঞ্চিত।
যে সকল শিশু শিক্ষকের শেখানো একই পদ্ধতি অনুসরণ করে একই ছবি প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভের আশায় আঁকে তারা মূলত মুক্তচিন্তা ও সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনা থেকে দূরে সরে যায়। এটা শিশুর মেধা বিকাশের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু তার পরেও এরূপ ঘটনা অহরহই ঘটে চলেছে।
আমরা ছোট ছোট শিশুদের ছবি আঁকা শিক্ষা দিতে চাই। কিন্তু এটা তাদের বয়স এবং মানসিকতার জন্য সঠিক নয় বরং ক্ষতিকর। কারণ উপরে উল্লেখ করেছি। ছবি আঁকা শিক্ষার বিষয়টি বড়দের জন্য। যারা শিল্পী হতে চায় তাদের জন্য। তাদের নানা ধরনের নিয়মকানুন মেনে ছবি আঁকতে দেখা যায়। যেমন- পারস্পেকটিভ, লাইট শেভ, অনুপাত প্রভৃতি। কিন্তু ছোট ছোট শিশুদের জন্য এগুলো একান্তই অপ্রয়োজনীয় ও অর্থহীন। শিশুরা এত নিয়ম-কানুনের বেড়জালে আটকে গেলে আর স্বতস্ফূর্ততা থাকে না তাদের কাজে। সেজন্য তাদেরকে রঙ তুলি ব্যবহারের পদ্ধতি এবং প্রয়োগের বিষয়গুলো জানালে তারাই সেসব রঙ দিয়ে কী আঁকবে তা নিজেরাই নির্ধারণ করে নেবে। তাতে করে তাদের ছবিতে বিষয়ের বৈচিত্র সহজেই ধরা পড়বে। তাদের ছবি হবে সুন্দর, শিশুসুলভ।

Share.

মন্তব্য করুন