শিশুর মুখে আধফোটা বুলি শুনতে বেশ লাগে। ওই সময়টা তার শেখার, জানার আর অনুকরণ করার। তাই তাদের বুলিকে আমরা আদরের সাথে নিই। আনন্দ পাই তাদের কথায়। কিন্তু সেটা তো তার ভাষা শেখার ক্লাশ নয়। সে-সময়টা তাদের পারিবারিক ক্লাশের। আর পরিবারই তো শিশুর প্রথম ও প্রকৃত শিক্ষক। তারাই তাদের শেখায়।
মূলত পরিবার থেকেই তার শেখার শুরু। মা প্রথম শেখায় হাঁটতে, কথা বলতে। তারপর শেখায় বর্ণ বা অক্ষর, সেটা বাংলা বর্ণ ও ইংরেজি বর্ণ। নগর ও গ্রামের ছেলেমেয়েদের আরবি বর্ণমালাও শেখানো হয়- তা যেমন আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি, আমরাও শিখেছি, আজকের শিশুরাও শেখে। এই শিক্ষাকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশে দুই ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা চলছে। আসলে চলছে তিনটি শিক্ষা ধারা। সরকারি স্কুলগুলোতে শিক্ষা বোর্ডের বাংলা কারিকুলাম, মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডে বাংলা শিক্ষা ও আরবি কারিকুলাম আর তৃতীয়ধারাটি আসলে ইংরেজি মাধ্যম। এই তিনধারার মধ্যে তেমন কোনো মিল নেই। ফলে শিশুরা তিনধারায় শিখছে। ‘সমন্বিত’ কোনো কারিকুলাম আছে বলে শুনিনি বা জানি না। এর পাশে আবার কওমি মাদরাসাগুলোতে কি শেখানো হয়, তা জানে না সাধারণ মানুষ। এতে করে সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে শিক্ষা নিয়ে একটি ধোঁয়াশা ধারণার সৃষ্টি হয়। তারা অসহায়বোধ করলেও, সেদিকে মন দেবার বা তা নিয়ে চিন্তা করার আমাদের সরকারের বা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রজ্ঞাবানদের সময় কই? ফলে যা কোনো ফল দেয় না। বরং জনগণের মধ্যে একটা মিশ্র-উদ্বেগ আমরা লক্ষ্য করি।
আসলে শিশুদের জন্য কি ‘সমন্বিত শিক্ষা’ কারিকুলাম রচনা করা উচিত- সে বিষয়ে সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কি কোনো উদ্যোগ-আয়োজন আছে? বা নেয়া হয়েছে বা হবে? আমরা জানি না।

২.
সেই পাঠসূচিতে অন্তর্ভুক্ত বিষয়ের রচনার ‘ভাষা’ কেমন হওয়া উচিত? এ-নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কি কোনো উদ্যোগ আছে? তারা কি এ-নিয়ে ভাবিত? তারা কি শিশু মনের বিষয়ে ওয়াকিবহাল। একটি শিশুর শারীরিক-মানসিক শক্তির বিষয়ে কতোটা সচেতন আমাদের শিক্ষার অভিভাবকগণ? এ-নিয়ে কি তারা প্রতিনিয়তই গবেষণা করেন? গবেষণার ভেতর দিয়েই কেবল বেরিয়ে আসতে পারে শিশুরা যে সব কারিকুলামে পড়াশোনা করবে, যে সব বই-পুস্তক রচিত হবে, সেগুলোর ভাষা কেমন হওয়া উচিত। সেই ভাষিক স্টাইলই প্রমাণ করবে শিশুর মানসিক গঠনের সাথে সাথে শারীরিক-মানবিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা পর্যায়ক্রমে গড়ে উঠবে। শিশুরা কোন শ্রেণিতে কি কি বিষয় পাঠ করবে। পর্যায়ক্রমে ওপরের দিকের শ্রেণিতে যে সব বই পাঠতালিকায় রাখা হবে, সেগুলো ভাষিক স্ট্যান্ডার্ড কিভাবে বাড়াতে হবে। অর্থাৎ জাতির মেরুদণ্ড বলে শিশুকে আমরা চিহ্নিত করি বটে, কিন্তু তাদের গড়ে তোলার জন্য কি কি পদক্ষেপ বা কোন কোন পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত, সে সম্পর্কে কি চলমান আছে গবেষণা? একমাত্র এ-বিষয়ে গবেষণার মাধ্যমেই শিশুর সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ চেতনা গড়ে তোলা যাবে, যা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। আমাদের দেশের শিশুর জন্য কোনো সাংস্কৃতিক পরিচর্যা নেই বললেই চলে। সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষার যে প্রয়োজন আছে, তা কি তারা অনুধাবন করেন না? শিশুর সেই সব গুণাবলী বিকাশের জন্যই শিক্ষাকে ব্যবহার করা দরকার।

এখন আসা যাক শিশুর ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে। বাংলা ভাষায় শিশুদের জন্য লিখিত বইগুলোর ভাষা কেমন হবে? বা হতে পারে? প্রমিত বাংলায় যে সে-সব রচনা রচিত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ ওই প্রমিত বাংলাকেই আমরা জাতীয় স্তরের প্রধান ভাষিক স্ট্যান্ডার্ড বলে মনে করি। এই প্রমিত বাংলা ভাষার অধিকারী শ্রেণি মূলত বাস করেন নগরে ও মহানগরে। গ্রামাঞ্চলের বসবাসকারী শিশুদের মুখের ভাষা কথ্য বাংলা, বা মুখের ভাষা বা মুখের বুলি। এই ভাষায় বই লিখলে বা ওই ভাষায় লিখিত বই দেশের সব এলাকার শিশুরা বুঝতে পারবে না। কারণ সেই আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত বই অন্য অঞ্চলের শিশু বুঝতে পারবে না। এটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতাকে মেনে নিয়েই সৃজিত হয়েছে প্রমিত ভাষার বা কলোক্যাল স্ট্যান্ডার্ড।
ভাষার শক্তি কতোটা তা আমরা বুঝি যখন দেখি ইংরেজির দাপট। উপনিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমেই তারা তাদের ভাষিক উপনিবেশও সৃজন করেছে। তারা বুঝতে পেরেছিলো যে দেশ দখল করে রাখা যাবে না, কিন্তু ভাষা আর ধর্ম দিয়ে জয় করা যাবে এবং তাদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য সুদীর্ঘকাল বজায় রাখা যাবে। ওই বুদ্ধি আর বিবেচনাটাই তাদের সাংস্কৃতিক চেতনাজাত। আজ আমাদের শিশুদের ওই ভাষা শেখাতে হবে। কারণ ওই ভাষা আন্তর্জাতিক গণযোগাযোগের মাধ্যম। বাংলার পর ইংরেজি, আরবি, স্প্যানিশ, চৈনিক, জাপানিজ, ফ্রেন্স ভাষাও শেখাতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কোন শ্রেণিতে কতোটা শেখাবো। ইংরেজি বাদে বাকি ভাষাগুলো শিশু-কিশোরদের পছন্দের ওপর বা বেছে নেবার মাধ্যমে একটিকে শেখানো উচিত। এবং সেগুলোকে এসএসসি’র পর যে সাবজেক্টই নেয় না কেনো শিক্ষার্থীকে শিখতে হবে। শিশু ক্লাশে নয়, কোরানিক ভাষা শিখতে হবে বয়োসন্ধিকালে। তাহলে ভাষা শেখা ও তার ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে জ্ঞানও পাকা বা পোক্ত হবে। একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল জাতির শিশু-কিশোরদের গড়ে তোলা যাবে।

খেয়াল রাখতে হবে যে, রচনার বাক্যগুলো যেন ছোটো ও সহজবোধ্য হয়। কম্যুনিকেটিং বা সহজবোধ্য হতে হলে, আমাদের শিক্ষা সংক্রান্ত কারিকুলাম রচয়িতাদের সে-ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে বা সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। এটাই আমাদের ধারণা। কারণ শিশুকে যতো সহজ ভাষায় বোঝানো যাবে, ততই তারা ভালোভাবে তা শিখতে পারবে। মূল লক্ষ্য তো শেখানো। আর শেখানো মানে গলধকরণ নয়। শিশুকে কিভাবে ইনোভেটিভ [উদ্ভাবনী] করে তোলা যায়, সেই বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। এটাও আমাদের ধারণা। এ-বিষয়ে, শিক্ষা বিষয়ে গবেষকদের ধ্যান ও ধারণা অনেকটাই পোক্ত। আমরা চাই কেবল সেই সব শিশুদের যেন ক্রিয়েটিভ চেতনার মানুষ করে গড়ে তোলা যায়, সেই চেষ্টা যেন তারা করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমেই শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে বিদ্যমান শিক্ষকদের। পাঠ উপকরণ দিয়েই কেবল নয়, ব্যক্তি শিক্ষকের সাংস্কৃতিক আচরণ দিয়ে, তার নৈতিক সৌন্দর্য দিয়ে শিক্ষা কাজ চালাতে হবে। এই ‘হবে’ যতদিন পর্যন্ত না ‘হচ্ছে’-তে না আসবে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের সেই চেষ্টা করে যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

Share.

মন্তব্য করুন