সব মেলাই ভালো, এমন নয়। সব মেলা খারাপ, এমনও নয়। আসল কথা সব বিষয়ের মতো মেলারও আছে ভালো দিক। আছে মন্দ দিক। আমাদের উচিত ভালোটি গ্রহণ করা। মন্দটি ত্যাগ করা। যারা ভালোটা গ্রহণ করে তারা উন্নত মানুষ। যারা মন্দ ত্যাগ করে তারা সত্যিকার মানুষ। মেলায় যাওয়া খারাপ নয়। কিন্তু মেলার খারাপ দিকগুলো গ্রহণ করাই খারাপ। কথা কয়টি বলে নিলাম কারণ কেউ কেউ আছেন মেলা মানেই খারাপ কিছু ভাবেন। ভাবেন মেলায় গেলেই বুঝি ভালো হারিয়ে গেলো।
না মেলায় গেলেই ভালো হারিয়ে যায় না। বরং ভালো গ্রহণ করার সুযোগও সৃষ্টি হয়। জীবনের রূপ দেখা যায় মেলায়। মানুষ কত রকম আনন্দ করে। কত রকমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে এবং কতভাবে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তার সবই দেখা যায় মেলায়।

সবুজ বাংলাদেশ বলি আমরা। সবুজ তো বটে। এদেশের বৃক্ষ সবুজ। বন-বনানী সবুজ। ফসলের মাঠ সবুজ। লতা-পাতা ও ঘাস সবুজ। চারিদিকে সবুজের ছড়াছড়ি। রঙ আছে আরও আরও। কিন্তু সব রঙ ছাপিয়ে বিস্তার লাভ করেছে সবুজের সমারোহ। সবুজ দেশ তাই বাংলাদেশ। এ দেশের মানুষের মনও সবুজ। সহজ সরল জীবনের অধিকারী মানুষগুলো সত্য ও সুন্দরকে ধারণ করতে চায়। করেও। সবুজ প্রকৃতি বলে মানুষেরা নরম মনের। সরল মনের। মন থেকে তারা মিশতে পছন্দ করে একজন আরেকজনের সাথে। মেশার আনন্দ থেকে মানুষেরা আয়োজন করে নানান অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান থেকে মেলা। অথবা মেলা থেকে অনুষ্ঠান। বারো মাসই কোনো না কোনো মেলার আয়োজন থাকে এখানে। বসন্তমেলা। চৈত্রমেলা। বৃষ্টি উৎসব। হেমন্তমেলা। নবান্ন উৎসব। শীত উৎসব। বাণিজ্য মেলা। বইমেলা। নববর্ষ মেলা। বৈশাখী মেলা। এর মধ্যে বৈশাখে মেলা বসে সব চেয়ে বেশি। বৈশাখী উৎসব। বৈশাখী পার্বণ। বৈশাখী আনন্দমেলা, এমন করে নানান নামে অনুষ্ঠিত হয় মেলা। বৈশাখে উপজাতিদের একটি উৎসব হয়। এটিকে বলা হয় বৈসাবি। এটি এদের সবচেয়ে বড় উৎসব।

এই তো এলো বৈশাখ। এলো বাংলা নববর্ষের নতুন মাস। নতুন বছরের প্রথম মাস। প্রথম মাসে নতুন আনন্দে জেগে ওঠে বাংলাদেশ। সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বসে বৈশাখী মেলা। হাটে ঘাটে মাঠে ময়দানে স্কুল আঙিনায় উদ্যান ও বাগানে বসে মেলা। নদীর পাড়ে এবং খোলা চরেও মেলার পসরা বসে। প্রতিটি মহানগরীর নানা জায়গায় আয়োজন হয় মেলার। জেলা শহরগুলোতে, উপজেলায় এমনকি কোনো কোনো গ্রামেও জমে ওঠে মেলার আয়োজন।
তিন দিন পাঁচ দিন সাত দিন পনেরো দিন কোথাও কোথাও মাসব্যাপী চলে মেলার দীর্ঘতা। এসব মেলায় স্থানীয় জিনিসপত্র থাকে বেশ। যে এলাকায় যে জিনিস প্রসিদ্ধ সে এলাকার মেলায় সেসব জিনিসগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। খাওয়ার জিনিস থাকে নানরকম, বৈচিত্র্যময় পরার জিনিস থাকে। থাকে ঘরদোর সাজানোর জিনিস। হাতে তৈরি শিল্প থাকে বেশ। বাংলাদেশের লোক ঐতিহ্যের নানান আঞ্চলিক বিষয় থাকে জমজমাট। প্রাচীন ঐতিহ্যের এবং ইতিহাসের অনেক বিষয় প্রদর্শিত হয় মেলায়।
ছেলে-বুড়ো যুবক-যুবতী তরুণ-তরুণী ছোট-বড় সকলেই আসে মেলায়। কেউ ঘুরতে আসে। কেউ দেখতে আসে। আবার কেউ আসে কেনাকাটা করতে। যার যেটি পছন্দ তিনি তাই করেন। তাই কেনেন। বড়দের জন্য যেমন তেমনই ছোটদের জন্যও চলে কেনাকাটার আয়োজন।
হস্তশিল্প থেকে শুরু করে সব রকমের শিল্প থাকে মেলায়। পিঠাপুলি, চটপটি, ফুচকা, অঙ্গুলি, জিলাপি, বাতাসা এবং মুখরোচক খাবারের দারুণ আয়োজন। মেলায় কেনাকাটা তো চলেই। এর বাইরে ঘুরতে অথবা বেড়াতেও যায় সকলেই। বিশেষ করে ছোট ছেলে মেয়েরা বেশ মজা পায় মেলার আয়োজনে।

তারা পিতা মাতা, বড় ভাই বোনকে সঙ্গে নিয়ে বিপুল উৎসাহের সাথে অংশ নেয় মেলায়। পছন্দের খাবার এবং খেলনা কিনতে একদম ভুল করে না। এসব কেনার জন্য বায়না ধরে খুব। কিনতেই হবে। কিনে দিতেই হবে এমনই ওদের চাহিদা। ছোটরা বেশি মজা পায়। কিন্তু বড়রাও কম যায় না। তারাও তাদের প্রয়োজন পূরণ করতে পারেন।
মেলার অংশগ্রহণ করা আনন্দের! কিন্তু এর জন্য বাবা মা থেকে অতিরিক্ত টাকা পয়সা দাবি করা ঠিক নয়। প্রয়োজনের বেশি খরচ করাও ঠিক নয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করা অপচয়। আর অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আমরা কেউ শয়তানের ভাই হতে চাই না। হবো না। সুতরাং আমাদের যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুই করবো। এর বাইরে খরচ করবো না। হোক না মেলা। হোক মেলার বাইরে। এ বিষয়টি মনে রাখতে হবে আমাদের। যদি আমরা জীবনের সব কাজে অপচয় বন্ধ করতে পারি তবে আমরা নিশ্চয় ভালো কিছু করতে পারবো।
বাংলাদেশ মেলার দেশ। বাংলাদেশ খেলার দেশ। বাংলাদেশ আনন্দের দেশ। বাংলাদেশ ওলি-আউলিয়ার দেশ এবং পীর-দরবেশের দেশ। মেলার এ আনন্দ অন্যরকম। এর আয়োজনও আলাদা। আমাদের দেশকে ভালোবাসি আমরা। ভালোবাসি হৃদয়ের গভীর থেকে। এদেশের মানুষকেও ভালোবাসি। ভালোবাসি মানুষের চমৎকার সব কাজকেও। মেলায় মানুষের জীবন দেখার সুযোগ ঘটে। আমরা দেখি। দেখতে দেখতে সত্যি মনে হয় বাংলাদেশ আমাদের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার দেশ। সাধারণ জীবনের দেশ। মেলায় এ সাধারণ জীবনের সমাহার দেখি আমরা। এমন মেলা বসে বাংলাদেশের সর্বত্র। তাই বলি মেলার দেশ বাংলাদেশ।

Share.

মন্তব্য করুন