দানিয়াল পাঁচবছরের ঘরে পা দিয়েছে। দানিয়াল ছোটো হলেও চতুর ও শান্ত প্রকৃতির ছেলে। কিন্তু অনেকটাই জেদি। মা-বাবার একমাত্র ছেলে তো! তবে, মা-বাবার বাধ্য ছেলে। মা-বাবা একটু চোখ লাল করে তাকালেই দানিয়াল নিভে যায়। সদর থেকে একটু দূরে আদরপুর গাঁয়ে বেড়ে উঠছে দানিয়াল। পাড়ার স্কুলে পড়ে দানিয়াল। নিয়ম অনুযায়ী আজও স্কুলে গেলো ও।

আজ হলো কী, স্কুলে বাংলা স্যার, ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে রাত দুপুরে অই, ট্রেন চলেছে ট্রেন চলেছে ট্রেনের বাড়ি কই? ট্রেন কবিতার এ পর্যন্ত পড়া দিয়েছেন। দানিয়ালের এতো ভালো লাগলো কবিতার এ ক’লাইন যে, স্কুল ছুটি হবার পর থেকে আওড়াতে আওড়াতে বাড়ি ফিরলো সে। এর আগে অনেক বিষয়ে দানিয়ালের মন কেড়েছে। কিন্তু ট্রেন কবিতার এ ক’লাইন পড়ে ট্রেনের প্রতি একরাশ ভালোলাগা আঁকড়ে ধরে দানিয়ালকে। তার কৌতূহল বেড়ে যায় ট্রেনকে ঘিরে। বইয়ে কবিতার পাশে ট্রেনের আঁকা ছবি দেখে তার এখন একটাই হবি ট্রেন দেখা। ট্রেনে ওঠা। বাড়ি এসে দানিয়াল ট্রেন দেখার রোখ চাপিয়ে দেয় তার বাবার ওপর। পিছন দিক থেকে বাবার গলা ধরে দানিয়াল ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে রাত দুপুরে অই, ট্রেন চলেছে ট্রেন চলেছে ট্রেনের বাড়ি কই? এতোটুকু পড়ে বায়না করে বলে বসলো, আমি ট্রেন দেখবো বাবা। আচ্ছা বাবা, ট্রেন দেখতে কত্ত বড়ো! দানিয়াল কৌতূহল ও উৎসাহ চেপে রাখতে না পেরে পেছন থেকে এবার বাবার সামনে এসে বললো, বাবা, ট্রেনের বাড়ি কোথায়! বাবা ছেলের কৌতূহল দেখে ফিক করে হেসে দিয়ে বললেন, ট্রেন অনেক লম্বা। তার দশবারোটা বগি আছে। তবে, ট্রেনের কোনো বাড়ি নেই। বাড়ি নেই তা বললে অবশ্য ভুল হবে। কারণ, তার শেষ গন্তব্য তো রেলস্টেশন। শেষ স্টেশনই তার বাড়ি। সে কিছুদূর পরপর থেমে থেমে মানুষদের তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। দানিয়াল উৎকর্ণ হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বাবার মুখে ট্রেনের বিবরণ শুনে মুগ্ধ হয় দানিয়াল। তার ট্রেন দেখার আগ্রহ আরো জোরালো হলো। এবার শান্ত ছেলের মতো দানিয়াল বাবাকে বলে উঠলো, বাবা, আগামীকাল তো শুক্রবার আমাকে ট্রেন দেখাতে নিয়ে যাবে! ছেলের এমন আনন্দময়-মায়াভরা বায়না শুনে বাবা বলে দিলেন, ঠিক আছে। আগামীকাল তোমাকে ট্রেন দেখাতে নিয়ে যাবো সদরে। বাবার সম্মতি পেয়ে বেজায় খুশি দানিয়াল।

ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে রাত দুপুরে অই, ট্রেন চলেছে ট্রেন চলেছে ট্রেনের বাড়ি কই বলতে বলতে দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে পুরো বাড়ি ঘুরতে লাগলো দানিয়াল। কখনো রান্নাঘরে মায়ের কানে, কখনো বাড়ির উঠোনে কিবা বাঁশ বাগানে। বারবার আওড়িয়ে তার বন্ধুদেরও বলতে লাগলো আগামীকাল ট্রেন দেখতে যাবার কথা।
রাতে ঘুম হয় না দানিয়ালের ট্রেন দেখতে যাবে বলে। বারবার বিছানা থেকে উঠে বাংলা বই মেলে ট্রেনের ছবি দেখে আর মিনমিন করে বলতে থাকে,ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে রাত দুপুরে অই, ট্রেন চলেছে ট্রেন চলেছে ট্রেনের বাড়ি কই। খানিকটা পর দানিয়ালের চোখে ঘুম বসে পড়ায়, ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে ট্রেনের বাড়ি কই উল্টাপাল্টা বলতে বলতেই ঘুমিয়ে পড়ে সে।

সকালের নাশতা সেরে কিছুক্ষণ পায়ে হেঁটে বউবাজারে উঠে দানিয়ালের বাবা দানিয়ালসহ রিকশায় চেপে বসেন। রিকশা থেকে এবার অটোতে। অটো চলছে সদরের রেলস্টেশনের দিকে। আর দানিয়াল মনের আনন্দে বারবার আওড়াচ্ছে, ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে রাত দুপুরে অই, ট্রেন চলেছে ট্রেন চলেছে ট্রেনের বাড়ি কই।
দুতিন ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে দানিয়াল পৌঁছালো তার স্বপ্নের সেই রেলস্টেশনে। বাবা দানিয়ালকে হাতের ইশারায় বললেন, লোহার পাতের সমান্তরাল দীর্ঘ এ পথ দিয়েই ট্রেন চলাচল করে। দানিয়াল চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় লোহার তৈরি ট্রেনের রাস্তার দিকে। এতো চিকন রাস্তায় ট্রেন চলে কীভাবে, কীভাবে-ই বা দাঁড়িয়ে তাকে ট্রেন এ সরু রাস্তায়! দানিয়াল ভেবে পায় না। আঁকাবাঁকা লম্বা সরু ট্রেনের পথ দেখে আনন্দে নেচে ওঠে। আনন্দের ঢেউ খেলে যায় তার পুরো শরীরে। হঠাৎ দানিয়াল থেমে যেয়ে বলে উঠে বাবাকে, বাবা ট্রেন কোথায়! বাবা দানিয়ালকে সান্ত¡নার বাণী শোনান, আসবে। একটু পরই আসবে। দানিয়াল আবারো নেচে ওঠে।

অনেকক্ষণ দানিয়াল ট্রেনের প্রতীক্ষায় রেলস্টেশনের সেই লম্বা সরু পথ চেয়ে থাকে। কিন্তু কোথায় ট্রেন! দানিয়ালের যেনো ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। এখনো কেনো আসছে ট্রেন। দানিয়াল এবার ধৈর্যচ্যুত হয়ে বাবাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে, বাবা কখন আসবে ট্রেন! ছেলের এমন ছটফটানি দেখে বাবা কাউন্টারে ট্রেন কখন আসবে জিজ্ঞেস করলে তারা জবাব করে, ট্রেন আসবে দুপুর দু’টায়। এমন সংবাদ বাবা ছেলেকে জানানোর সাথে সাথে দানিয়ালের মুখাবয়বে কালমেঘের এক দমকা বাতাস বয়ে গেলো নিরবে। আর তখনি জুমার আজান ভেসে আসে।

বাবা দানিয়ালকে নিয়ে রেলস্টেশন ঘেঁষা মাসজিদে জুমা আদায় করবার জন্যে রওনা হন। দানিয়াল মন খারাপ করে বাবার সঙ্গে অজু বানিয়ে মাসজিদে ঢোকে। বয়ান শেষে খুৎবা হলো। নামাজ শেষে দানিয়াল রেলস্টেশনে এসে দেখলো এখনো প্লাটফর্ম খালি পড়ে আছে। দানিয়ালের মন আবার খারাপ হলো। মুখে এখন আর আওড়ায় না, ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে রাত দুপুরে অই, ট্রেন চলেছে ট্রেন চলেছে ট্রেনের বাড়ি কই। মন খারাপ করেই বাবার সঙ্গে বসে আছে। খানিক বাদে দানিয়াল ট্রেন আসার সংবাদ পেলো প্লাটফর্মে মাইক থেকে। তবু দানিয়ালের মন ভালো হলো না। হঠাৎ হুইসেল বেজে উঠলো। কিন্তু দানিয়ালের মধ্যে এখনো কোনো পরিবর্তন এলো না। কারণ, সে জানতো না এই শব্দ ট্রেন আসার অগ্রীম বার্তা। তবে, বাবা যেই হাত উঠিয়ে বলে উঠলেন, দানিয়াল ওই যে ট্রেন আসছে। ওমনি দানিয়ালের চোখে ভেসে উঠলো তার স্বপ্নের ট্রেন। তার দিকেই আসছে। দানিয়ালের মুখাবয়বে এবার আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো। আরে, সত্যি সত্যিই তো ট্রেন! যে ট্রেন তার বাংলা বইয়ে দেখেছে। যে ট্রেনের ছবি তার মনের দর্পণে এঁকেছে। সেই ট্রেনই তো আসছে। ট্রেন আবারো হুইসেল দিলো। দানিয়াল হুইসেলের শব্দে নেচে উঠলো। তার অজান্তেই মুখ থেকে বের হতে লাগলো, ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে রাত দুপুরে অই, ট্রেন চলেছে ট্রেন চলেছে ট্রেনের বাড়ি কই।

ট্রেন এবার দানিয়ালের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। দানিয়াল লক্ষ করলো তার মতো আরো অনেক ছোটো ছেলেমেয়েরা ট্রেনের জানালা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দানিয়াল নেচে-নেচেই হাত নাড়ালো। ট্রেন দাঁড়ালো। আবারো হুইসেল দিলো। দানিয়াল তো বেজায় খুশি। হুইসেলের শব্দের মধ্যেই দানিয়াল বলে উঠলো, ট্রেন তোমার বাড়ি কোথায়! কিন্তু ট্রেন জবাব করলো না। তাতে দানিয়ালের আনন্দে কোনো ভাটা পড়লো না।
মানুষদের উঠানামা যখন কমে এলো দানিয়ালের বাবা দানিয়ালকে নিয়ে ট্রেনে উঠলেন। এবার তো দানিয়ালের খুশির অন্ত নেই। সে এতো খুশি রাখে কোথায়! কখনো এ জানাল দিয়ে মুখ বের করে কখনো ও জানালা দিয় মুখ বের করে। আর চিৎকার করে দানিয়াল বলে উঠে, ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে রাত দুপুরে অই, ট্রেন চলেছে ট্রেন চলেছে ট্রেনের বাড়ি কই। দানিয়ালের বাবা ছেলেকে কখনো এতো খুশি হতে দেখেননি এর আগে। তাই তিনি জুড়ানো নয়নে ছেলের আনন্দ-উল্লাস দেখছেন। আর প্রশান্তির পলক নামাচ্ছেন।
আবার হুইসেল দিলো ট্রেন। দানিয়ালও হুইসেলের সুরে সুর মেলালো। এমন সময় দানিয়ালকে ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে এলেন বাবা। আবারো হুইসেল বেজে উঠলো। দানিয়াল পোঁ…পোঁ… শব্দ করলো আনন্দে। ট্রেনের চাকা সচল হলো। দানিয়াল হাত নাড়াতে নাড়াতে বলতে লাগলো, ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে রাত দুপুরে অই, ট্রেন চলেছে ট্রেন চলেছে ট্রেনের বাড়ি কই।

Share.

মন্তব্য করুন