চারদিকে করোনা কাল। তারপর কাজের চাপ, সব মিলিয়ে নাভিশ্বাস অবস্থা। মিলাতে পারছিলাম না কবে একটু শীতের ছুটিতে বাড়ি যাবো। অবশেষে দিনক্ষণ ঠিক হলো। আমরা ২৬-১২-২০২০ তারিখে রোজ শনিবার ভোরে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে যাত্রা করি সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া থানার বহুড়া গ্রামের উদ্দেশে। প্রথম সিএনজিযোগে মোহাম্মদপুর। তারপর এসপি গোল্ডেন লাইন কাউন্টার শ্যামলী। সাড়ে চারটায় গাড়ি স্টার্ট হলো। কনকনে শীত। চারিদিকে কুয়াশা। প্রকৃতিতে শুষ্কতা; গাছ-গাছালি তরুলতা সজীবতা ফিরে পায়নি। ঢাকা থেকে আমাদের গাড়ি সাতক্ষীরা ছুটে চলল গন্তব্যের উদ্দেশে। আমার সাথে আমার স্ত্রী লুৎফুন্নাহারও ছিল। গাড়ি ৩৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ছুটে চলল সাতক্ষীরার উদ্দেশে।
বহুড়া গ্রামে অবশেষে পৌঁছালাম সন্ধ্যার একটু আগে। আব্বা বাড়িটা বানিয়েছেন ভালো। টাইলসের বাড়ি। চারিদিকে রং করা। এমন বাড়ি গ্রামে সচরাচর মিলবে না। বাড়ি যেয়ে দেখি আম্মার শরীরটা অত ভালো নেই। আব্বাও বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। তবুও তারা ভালো আছেন। আমাদের গ্রামটা একদিকে খাল অন্য দিকে বিল দ্বারা পরিবেষ্টিত। গ্রামবাসীর অনেকে ইসলাম, ফকিরিমত ও ইহজাগতিকতায় বিশ্বাসী। তাদের মনে মগজে আছে শান্তির বারতা।

গ্রামের মাঠে ঘাটে আছে ফুল, ফল, পুকুরের মাছ আর শিমুল গাছে আছে অতিথি পাখির ঝাঁক। রাত হলে ধু-ধু পাখির ভয়ঙ্কর শব্দ। গা ছমছম করে। আমার মমতাময়ী মাতা জাহানারা খাতুন। তিনি পাখি ভালোবাসেন। প্রতিদিন শ্যামা, টিয়া, দোয়েল, ঘুঘু, শালিক খাবার খেতে আসে আমার মায়ের কাছে। আম্মা জানালেন, ঝড়ে আমগাছ, পেয়ারা গাছ এবং পেঁপে গাছ ভেঙে গেছে। পাখিরা কী খাবে? তারা কী করে বাঁচবে? তাদের খাবার কী? তাদের একটু খাবার না দিলে আমাদের খাওয়াও ভালো হবে না। মাকে দেখলেই মনে হবে, তিনি প্রাণী অথবা পাখির প্রতি দরদি মানুষ। জগৎ পরিপূর্ণতা লাভ করেছে বৃক্ষরাজি, গাছপালা, পশু-পাখি দিয়ে। আর মানুষকে বানানো হয়েছে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হিসেবে, কিন্তু মানুষ যদি তাদের দায়দায়িত্ব থেকে দূরে থাকে তাহলে শ্রেষ্ঠ প্রাণীর দাবিদার হবে কেমন করে!

গ্রামের সরিষার ক্ষেতে চোখ ধাঁধানো হলুদের সমারোহ। চারিদিকে আলু, কপি, কুল, ওল, কচুর ক্ষেত। মাঠ ভরা ফসল, ঘুঘুর ডাক, ফিঙের নাচন আর নারিকেল গাছের মাথায় ডাবের সমারোহ। প্রকৃতি তার দায়িত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে। এবং প্রকৃতিকে ধ্বংসের কারণে সে নিজেও এখন ধ্বংস প্রতিশোধপরায়ন হয়ে উঠছে। আমরা প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই। নয়তো তার আচরণ আমাদের সাথে শোভনীয় হবে না।
আমাদের জমিতে ফসল ও খামারে মাছ চাষ করার জন্য লোক নিযুক্ত করা আছে। মাছের ঘেরটা কাটা হচ্ছে শক্তিশালী এস কে বেটার মেশিন দ্বারা। সারা দিন এবং সারা রাত মেশিনের কোন বিরাম নেই। গভীর রাতেরও মেশিনের শব্দ শোনা যায়। মাটি কাটা হচ্ছে আর আট-দশটা ট্রাক নিয়ে যাচ্ছে দূরের ইটের ভাটার জন্য। শুধু কাজ আর কাজ। ঘের যিনি লিজ নিয়েছেন তিনি জানান আমরা প্রথমে কৈ মাছের বাচ্চা ফুটাবো তারপর মৎস্য চাষ শুরু হবে। মাছ চাষ আজ লাভজনক ব্যবসা। কিন্তু এ ব্যবসায় লাভবান হতে হলে শ্রম ও শক্তি ব্যয় করতে হয়। সাতক্ষীরার আম, কচু, কুল, ওল, তাল, নারিকেল ইত্যাদি সারা দেশখ্যাত। আমরা বলতে পারি, মাটি ও প্রকৃতি, রূপ ও রস ভালো হলে মনও ভালো হতে থাকবে। কিন্তু আমরা যদি আচরণ সংযত না করে তার সাথে বিরুপ আচরণ করি তাহলে ফলাফল ভালো হবে না। আমরা সরল সহজ প্রকৃতিকে মহান সৃষ্টিকর্তার দান হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। আর সৌন্দর্য নিহিত রয়েছে এই প্রকৃতির মধ্যেই।

শীতে আড়ষ্ট প্রকৃতি যেন একটু তাপ পাওয়ার অপেক্ষা করছিল। কিন্তু সূর্যের তেজ নিস্তেজ হতে চলেছে। পানি গরম করে গোসল করার পালা। আম্মা অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও পিঠা না খেয়ে আসতে দেননি। আমরা খোলামুচি পিঠা এবং খেজুরের রস না খেয়ে পারলাম না। কী স্বাদ আছে সেই রসে, তা যারা খেয়েছে তারাই জানে। খেজুরের গাছটায় দেহটা খাঁজকাটা খাঁজকাটা আর মাথার উপরের অংশটা শুধু কাঁটা আর কাঁটা। কিভাবে মাথার অংশটি কাটলে রস মিষ্টি স্বাদ হয় তা একমাত্র ¯্রষ্টাই বলতে পারেন। কিন্তু প্রকৃতি থেকে খেজুর গাছ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এটা আবহমান বাংলার সংস্কৃতি ও লোকজ উপাদানের অংশ। যার কারণে শীতকাল এলে পত্রপত্রিকার শালিকের রস খাওয়ার ছবি না ছেপে পারে না। এটা আমাদের প্রকৃতির সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলে।

আমরা পল্লীর প্রান্তরে হেঁটে হেঁটে দেখি প্রকৃতি কত সরস, মাটি কত মিষ্টি এবং জগৎ ও জাতি কত ¯িœগ্ধ। সুতরাং শহরের যান্ত্রিক কোলাহল থেকে ক্ষণিকের জন্য পল্লী ভ্রমণ আমাদের পরিচয়কে ফুটিয়ে তুলতে পারে। আমরা আমাদের পরিচয় যদি পাই, তাহলে আমরা আমাদের দায় দায়িত্ব থেকে এড়িয়ে চলতে পারি না। পল্লীর মানুষের কাজ দেখলে আমরা কবির ভাষায় বলি- ‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা/ দেশ মাতারই মুক্তিকামী দেশের সে যে আশা।/দধিচী কি তার চেয়ে সাধক ছিল বড়/পুন্য অতো হবে না’ক সব করিলেও জড়ো!’ দধিচী বলতে কবি একজন সাধককে বুঝিয়েছিলেন। গ্রামের মানুষের হাড়ভাঙা শ্রম আর কাজ ফাঁকি দেয়া নীতি পরিহার করে তারা প্রমাণ দিয়েছেন যে, আমরা আমাদের কার্য পালন করবো শহরের ইট পাথরের দেয়ালের মধ্য এবং এসি/ডিসির ভেতর থেকে অশুভ নীতি পরিহার করার মাধ্যমে। তবেই জাতির ধীরে ধীরে উন্নতি হবে। পল্লীর পথ-প্রান্তর এই শিক্ষাই দেয় যে, আমরা যেন কর্মে বিশ্বাসী হই। আমাদের কাজকে ভালোবাসতে হবে। মানুষ, মাটি ও প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে। প্রকৃতির সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তবেই জাতির উন্নতি হবে।

Share.

মন্তব্য করুন