সবাই জানে বনের রাজা সিংহ। তার মানে কি রাজার কাজ হলো দুর্বল প্রজাদের ওপর আক্রমণ করা? নাকি তাদের মেরে মেরে পেটের ক্ষুধা মেটানো? কেন তাহলে তাকে সবাই রাজা বলে? তার ওপর কারো ক্ষমতা নেই বলে! কিন্তু তাও তো সত্য নয়। সিংহ কিন্তু হাতির চেয়ে আকারে ছোটো, শক্তিতেও কম।
তবে সিংহ নিজেকে হাতির চেয়ে দুর্বল ভাবতে রাজি নয়। সে তাই মাঝে মাঝেই হাতির সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজের বীরত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার চেষ্টা চালায়। এরকমই একদিন হাতির সঙ্গে ভীষণ যুদ্ধ করে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে যায় সিংহ। কোনো রকমে সে নিজের আবাসে ফিরে যায়। ভীষণরকম ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিল সিংহ। এতো বেশি ক্ষুধার্ত যে, শিকার করার মতো শক্তিও তার ছিল না। আশপাশে থাকা অন্যান্য জন্তুরা সিংহের এই অবস্থা দেখে মর্মাহত হলো। একটি শেয়াল তার কাছে গেল।

সিংহ একটা উপায় চিন্তা করলো। সে শেয়ালকে বললো শিকারে তাকে যেন সে সাহায্য করে। তাকে সে বনের পার্শ্ববর্তী তৃণবহুল বনে পাঠালো।
সিংহ শেয়ালকে বললো: গরু বা গাধা যাকেই পাও মিষ্টিভাষায় মুগ্ধ করে বনের ভেতর আমার কাছে নিয়ে এসো, যাও!
রাজার আদেশ। না মেনে উপায় কী! শেয়াল রাজি হয়ে গেল এবং পার্বত্য জঙ্গল ছেড়ে ঝর্ণাসিক্ত, তৃণবহুল সবুজ একটি চারণভূমির মতো স্থানের দিকে চললো। পথিমধ্যে গাছপালাহীন কঙ্করময় একটা স্থানে গিয়ে পৌঁছলো। সেখানে যাবার পর শেয়াল বৃদ্ধ এবং শীর্ণকায় একটি গাধার দেখা পেল। শেয়ালের পছন্দ হলো না। বার্ধক্য এবং অক্ষমতার কারণে শেয়াল তাকে বাদ দিতে চাইলো।
কিন্তু গাধা বললো:
যদিও থাকি শুকনো মরুভূমিতে
কিংবা থাকি বেহেশতের বাগানে
খোদার শোকর করছি আদায় এজন্য যে তিনি আমার ভাগ্যে এমনটা রেখেছেন।
শেয়াল গাধাকে তার ভাগ্যের ব্যাপারে ব্যাপক সন্তুষ্ট দেখে ভাবলো: এই সন্তুষ্টির কারণে তাকে প্রতারিত করা কঠিন হবে। তাই সে ভিন্ন দিকে কথা ঘুরিয়ে নিলো।
শেয়াল বললো: হ্যাঁ, আল্লাহ আমাদের জন্য যে হালাল রুজির সংস্থান করেছেন, তার ওপর সন্তুষ্ট থাকা উচিত। তবে মনে রাখতে হবে এই রিজিক ও রুজি চেষ্টা-প্রচেষ্টা ছাড়া আসে না। রুটি রুজির পেছনে শ্রম দিতে হয়, চেষ্টা প্রচেষ্টা চালাতে হয়।

গাধা বললো: এই যে চেষ্টা-প্রচেষ্টার শঙ্কা নিয়ে তুমি এতো বেশি ভাবছো, তার পেছনে কারণটা হলো আল্লাহর ওপর তোমার কোনো তাওয়াক্কুল বা নির্ভরতা নেই। আল্লাহর প্রতি যে তাওয়াক্কুল করে তার রিজিক, তার খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থা আল্লাহই করে দেন, তবে সে জন্য প্রয়োজন অপেক্ষা করা, ধৈর্য ধরা।
শেয়াল বললো: এ কী কথা বলছো তুমি। তাওয়াক্কুল বা নির্ভর করা তো সবার কাজ নয়। খুব কম পশুই আছে যারা তাওয়াক্কুলের ব্যাপারে অভিজ্ঞ বা দক্ষ অর্থাৎ তাওয়াক্কুল করার মতো যোগ্যতা রাখে।
গাধা শেয়ালকে বললো: তুমি ভুল বুঝেছো। উচ্চাভিলাষই আসলে যতোসব সমস্যার কারণ। অল্পে তুষ্টির কারণে না কেউ মারা যায়, আর না কেউ লোভের কারণে বাদশাহী পেয়ে যায়।

শেয়াল গাধার এই কথা শুনে পুনরায় বললো: এসব কী বলছো তুমি? শোনো, চেষ্টা তদবির করো, কাজ করো। তৎপর হও। সক্রিয় হও! আল্লাহ যেসব সামর্থ্য তোমাকে দিয়েছেন সেগুলোকে কাজে লাগাও।
এভাবে তাওয়াক্কুল এবং চেষ্টা-প্রচেষ্টা নিয়ে গাধা আর শেয়ালের মাঝে দীর্ঘ সময় ধরে তর্ক-বিতর্ক হলো। বিতর্ক করতে করতে প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে গাধা এবং শেয়াল উভয়েই ক্লান্ত হয়ে গেল। শেয়াল তাই ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করলো। গাধাকে সে বললো: ওঠো! চলো এই প্রস্তরময় এলাকা ছেড়ে তৃণময় সবুজ লনের দিকে যাই।
শেয়াল তৃণময় লনের কথা বলে এবং বিভিন্নভাবে গাধাকে অনুপ্রাণিত করে আস্থা অর্জন করলো এবং প্রতারণা করে সিংহের আস্তানায় নিয়ে গেল। শেয়াল এবং গাধা উভয়েই সিংহের কাছে গিয়ে পৌঁছলো। সিংহ চাচ্ছিলো দূর থেকে হামলা করতে, কিন্তু গাধা দূর থেকে তাকে দেখতে পেয়ে পালিয়ে গেল। সে বুঝতে পারলো আসলে প্রতারক শেয়াল এবং সিংহ তাকে মেরে ফেলে নিজেদের ক্ষুধা নিবারণ করতে চায়। গাধা পালিয়ে যাওয়ায় শেয়ালের সকল শ্রমই বিফলে গেল।

শেয়াল সিংহের ওপর রেগে গিয়ে বললো: কেন গাধা তোমার কাছে আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করলে না? তুমি কি জানো না তড়িঘড়ি করা শয়তানের কাজ! আর আল্লাহর দয়া এবং রহমত থাকে ধৈর্য ধারণ করার মধ্যে?
শেয়াল ভীষণভাবে রাগ ঝাড়লো সিংহের ওপর।
ক্লান্তির কারণে দুর্বল সিংহ তার ভুল স্বীকার করে বললো: ভেবেছিলাম এখনও আগের মতোই শক্তিশালী আছি। তা ছাড়া এতো বেশি ক্ষুধার্ত ছিলাম যে ধৈর্য ধারণ করার মতো অবস্থা ছিল না।
সিংহ আবারো শেয়ালকে বললো: ঐ গাধাটিকে আবারও নিয়ে আসো।
এ কাজের জন্য সিংহ শেয়ালকে ভালো কিছু শিকারের প্রতিশ্রুতি দেয়। শেয়াল অনীহা সত্ত্বেও সিংহের কথা মেনে নিলো এবং পুনরায় গাধার কাছে গেল।

গাধা খুব রেগেমেগে শেয়ালকে বললো: আমি এমন কী অন্যায় করেছি যে তুমি আমাকে সিংহের কাছে নিয়ে গেছো? শেয়াল নতুন বুদ্ধি আঁটলো এবং গাধাকে বললো: আরে ওখানে তো সিংহ ছিল না। ওটা ছিল একটা তেলেসমাতি মানে যাদুমন্ত্র! তাই দেখে তুমি ভেবেছো সিংহ? অথচ আমি চেয়েছিলাম এই যাদু তোমাকেও শেখাবো, কিন্তু সেই সুযোগ আর পেলাম কই!
গাধা বললো: হে ধূর্ত শেয়াল! তুমি এখান থেকে ভাগো। আমি তোমার ফাঁদে আর পা দেবো না। নিশ্চয়ই সিংহ তোমাকে পুনরায় আমাকে ফাঁদে ফেলার জন্য পাঠিয়েছে। আর তুমি বন্ধুর মতো আচরণ করে আমার সাথে শত্রুতা করছো। একজন খারাপ বন্ধু বিষাক্ত সাপের চেয়েও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।
শেয়াল বললো: বন্ধুর ব্যাপারে তোমার এই অমূলক ধারণা হলো কেন?
গাধা চেষ্টা করছিলো শেয়ালকে দূর করতে যাতে আবারও তার ষড়যন্ত্রের শিকার হতে না হয়। কিন্তু তৃণময় লনের লোভ ক্ষুধার্ত গাধাকে পুনরায় শেয়ালের ফাঁদে ফেলে দিলো।
অবশেষে প্রতারণার ফাঁদে আটকে ফেলে ধূর্ত শেয়াল ঐ গাধাটিকে আবারও সিংহের কাছে নিয়ে গেল। সিংহ এবার আর গাধাকে পালাবার সুযোগ না দিয়ে আক্রমণ করলো এবং গাধার তরতাজা মাংস খেয়ে সিংহ তার ক্ষুধা মেটালো। এরপর সিংহ পানির পিপাসা মেটাবার জন্য ঝরনার কাছে গেল। এই ফাঁকে শেয়াল গাধার হৃদয় এবং কলিজা বের করে এনে খেয়ে ফেললো। সিংহ ফিরে এসে গাধার মৃতদেহকে আরো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করলো। কিন্তু গাধার হৃদয় এবং কলিজা দেখতে পেল না। না দেখতে পেয়ে সিংহ ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে গেল।
সিংহ শেয়ালকে বললো: আচ্ছা! কোনো প্রাণী কি হৃদয় এবং কলিজাহীন হয়?
শেয়াল বললো: হৃদয় এবং কলিজাহীন প্রাণী! তা কী করে হয়?
সিংহ বললো: তাহলে এই গাধাটির হৃদয় এবং কলিজা কোথায় গেল?
শেয়ালের মুখে কোনো কথা নেই। সে নিরুত্তর।
সবল হাতির সঙ্গে না পেরে দুর্বল গাধার ওপর বীরত্ব ও শক্তি প্রয়োগ করে সিংহ বনের রাজা। আর সেই রাজারই ধূর্ত প্রজা শেয়াল রাজার প্রিয় কলিজা আর হৃদয় খেয়ে যায় সব সময়। জালালুদ্দিন রুমি বলেন: নূরবিহীন হৃদয় কাদা ছাড়া আর কিছু নয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন হৃদয়ের মানুষেরাই পার্থিব জগতের মোহে বন্দী হয়ে পড়ে।

Share.

মন্তব্য করুন