বিজ্ঞানী হিসেবে যারা বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের নামকে উজ্জ্বল করেছেন, তাদের অন্যতম জামাল নজরুল ইসলাম। তার গবেষণা অনেকটা কাব্যিক গবেষণার মতো ছিল। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে মৌলিক বিজ্ঞানে তার মতো অবদান আর কারও নেই। তেমনি বিশ্ব বিজ্ঞানের সমাজে তার মতো সমাদর ও খ্যাতিও কারও ছিল না।
মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে! মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি কী! তা নিয়ে জামাল নজরুল ইসলাম করেছেন বিশ্বমানের গবেষণা। বর্তমানে অনেকেই মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষণা করছেন কিন্তু তিনি যে সময়ে করেছেন, তখন খুব বেশি কেউ এই ক্ষেত্র নিয়ে গবেষণা করেননি।

জামাল নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে। জন্মস্থান ঝিনাইদহ হলেও তার শিকড়ের ঠিকানা চট্টগ্রামে। চাকরি সূত্রে বাবা ঝিনাইদহ অবস্থান করছিলেন বলে জন্মস্থান হয়েছে সেখানে। বংশগত দিক থেকে ছিলেন অভিজাত পরিবারের সন্তান। তখন ঢাকার নবাব বাড়ির পাশাপাশি যোগাযোগ ছিল জর্ডানের বাদশার পরিবারের সাথে। তবে বংশ হিসেবে অভিজাত হলেও ছিল না আভিজাত্যেও কোনো অহঙ্কার।
তাদের বাসায় যাতায়াতও ছিল অনেক উঁচু দরের মানুষের। তাদের কলকাতার বাসায় কবি কাজী নজরুল ইসলামও যাতায়াত করতেন। কবির নামের সাথে মিল রেখেই তার বাবা-মা তার নাম রেখেছিলেন ‘জামাল নজরুল ইসলাম’।
জামাল নজরুল ইসলামের স্কুলজীবন শুরু হয় কলকাতায়, সেখান থেকে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন, শেষে পাকিস্তানের লরেন্স কলেজ থেকে সিনিয়র ক্যামব্রিজ পাস করেন।

বিএসসি সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে। এরপর বৃত্তি নিয়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে ট্রাইপজে তিন বছরের কোর্স দুই বছরে শেষ করেন। ১৯৬০ সালে ক্যামব্রিজ থেকেই মাস্টার্স। ১৯৬৪ সালে এখান থেকেই প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ড. ইসলাম অত্যন্ত দুর্লভ ও সম্মানজনক ডক্টর অব সায়েন্স বা ডিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। ছাত্রজীবনে তাঁর সমসাময়িক ও আজীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বিস্ময়কর বিজ্ঞান-প্রতিভা স্টিফেন হকিং।

একাধারে পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ ও অর্থনীতিবিদ জামাল নজরুল ইসলাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে হকিং বলেছিলেন, ‘জেএন ইসলাম আমার রুমমেট, বন্ধু এবং আমরা ছিলাম পরস্পর পরস্পরের শিক্ষক।’ জামাল ইসলাম জে এন নামে বিশ্বে পরিচিত ছিলেন।
সারা বিশ্বে বিজ্ঞানী মহলে জেএন ইসলাম জিনিয়াস ইসলাম নামেও পরিচিত ছিলেন। জাপানি প্রফেসর মাসাহিতো বলেছেন, ‘ভারতের বিখ্যাত জ্যোতিপদার্থ বিজ্ঞানী জয়ন্ত নারলিকা জেএন ইসলামের সহপাঠী ছিলেন। ফ্রেডরিক হয়েল, নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ব্রায়ান জোসেফসন, স্টিফেন হকিং, প্রফেসর আব্দুস সালাম, রিচার্ড ফাইনমেন, অমর্ত্য সেন প্রমুখ ছিলেন জামাল নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাদের মুখে আমি অনেকবার জেএন ইসলামের কথা শুনেছি।

জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল ফেলো ছিলেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ক্যামব্রিজ ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে গবেষণা করেছেন। ১৯৭১-৭২ দুই বছর ক্যালটেক বা ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভিজিটিং অধ্যাপক ছিলেন।
তিনি ১৯৭৩-৭৪ সালে লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের শিক্ষক, ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্স রিসার্চ ফেলো এবং ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মনে সিটি ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেছেন।

এর মধ্যে জামাল নজরুল ইসলামের অনেক গবেষণা- নিবন্ধ বিখ্যাত সব বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। জামাল নজরুল ইসলাম বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে উল্লেখযোগ্য বই লিখেছেন ৬টি। এর মধ্যে ৩টি বই বিশ্ববিখ্যাত। ক্যামব্রিজ ও হার্ভার্ডসহ বেশ কয়েকটি নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বইপাঠ্য হিসেবে পড়ানো হয়।
১৯৮৩ সালে তাঁর গবেষণাগ্রন্থ দ্য আল্টিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বের কসমোলজিস্টদের মধ্যে হইচই পড়ে যায়।

তার লেখা বইটি ফরাসি, জাপানি, পর্তুগিজ, ইতালিয়ানসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলাতেও এই বইটির অনুবাদ কাজ চলছে। যদিও অনেক আগেই এই কাজ সম্পন্ন হওয়া উচিত ছিল।
শিক্ষা ও মননশীল প্রকাশনা জগতে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস অনেক বিখ্যাত। মানের দিক থেকে উন্নত বলে তাদের গ্রহণযোগ্যতাও বিশ্ববিদিত। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত এই বইটি জামাল নজরুলকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা এনে দেয়।
বইটির বিষয়বস্তু মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ তথা মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি। বইটি প্রকাশের আগে ‘স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ’ নামে একটি বিখ্যাত ম্যাগাজিনে মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি নিয়ে তিনি একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেন। মূলত সম্পূর্ণ বইটির সারমর্ম নিহিত আছে এই প্রবন্ধে।

১৯৮৫ সালে এটি ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য প্রসিডিংসয়ে প্রকাশিত তার এই গুরুত্বপূর্ণ ও উচু মানের গবেষণার জন্য ১৯৮২ সালে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি তাকে অত্যন্ত সম্মানজনক ডিগ্রি ডক্টর অব সায়েন্স প্রদান করে। মহাবিশ্ব নিয়ে স্টিফেন হকিংও বেশ কিছু কাজ করেছেন। কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নামে বই লিখে দুনিয়াজুড়ে বিখ্যাতও হয়েছেন। তবে জামাল নজরুল ইসলাম মহাবিশ্বের উচ্চমার্গীয় বিষয় নিয়ে বই প্রকাশ করেছেন তারও আগে।
অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি জামাল নজরুলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বই। আন্তর্জাতিক পরিম-লে বইটির গ্রহণযোগ্যতা ও চাহিদা ব্যাপক।

এরপর বাংলায় উল্লেখযোগ্য বই লিখেছেন ‘কৃষ্ণ বিবর’, ‘মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ’ এবং ‘শিল্প সাহিত্য ও সমাজ।’ তার লেখা ‘ভাষা শহীদ গ্রন্থমালা’ নামে চমৎকার একটি সিরিজ প্রকাশ করেছিল বাংলা একাডেমি।
জামাল নজরুল ইসলামের কৃষ্ণ বিবরও এই সিরিজেরই একটি বই। আশি পৃষ্ঠার মতো পরিধির এই বইটিতে কৃষ্ণ বিবর তথা ইষধপশ ঐড়ষব সম্পর্কে অনেক কিছু উঠে এসেছে, আকারে সংক্ষিপ্ত কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি বই। তার চেয়েও বড় কথা, ১৯৮৫ সালের সময়ে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের এমন উচ্চমার্গীয় বিষয়ে আস্ত একটি বই উপহার দিয়েছেন তিনি। তখনকার সময়ে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার অবস্থা খুবই বেহাল ছিল। এমন পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষায় এমন একটি বই পাওয়া আসলেই আবেগের ও আনন্দের।

অধ্যাপক ইসলাম আরো দুটি বই লিখেছিলেন। ১. অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল ইকনোমিক্স ও ২. কনফাইনমেন্ট অ্যান্ড শ্রোডিংগার ইকুয়েশন ফর গাউস থিওরিস। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেগুলো তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে বইগুলো প্রকাশের প্রক্রিয়া চলছে।
বিজ্ঞানের বাইরেও ছিল তার সরব পদচারণা। বলা হয়, আধুনিক বিশ্বের সাতজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর নাম নিলেও জামাল নজরুল ইসলামের নাম চলে আসবে।
প্রফেসর ইসলাম তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন। পশ্চিমের উন্নত দেশে ৩০ বছরের অভ্যস্ত জীবন, সম্মানজনক পদ, গবেষণার অনুকূল পরিবেশ, বিশ্বমানের গুণীজন সাহচর্য এবং আর্থিকভাবে লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। এলেন একেবারে নিজ জেলা চট্টগ্রামে। লন্ডনের লাখ টাকা বেতনের চাকরি এবং উন্নত সুযোগ-সুবিধা ছেড়ে মাত্র তিন হাজার টাকা বেতনের চাকরি নিয়ে তিনি চলে আসেন মাতৃভূমি বাংলাদেশে।
বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষা এবং বিজ্ঞান গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তিনি। বাংলার সন্তানদেরকে বিজ্ঞান শিক্ষা এবং গবেষণায় উজ্জীবিত করার মাধ্যমে দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন জামাল নজরুল ইসলাম। তার কর্মকা- ও চিন্তাধারায় বিভিন্ন দিক থেকে উপকৃত হয়েছে বাংলাদেশ।

বিদেশের মাটিতে লেখাপড়া ও গবেষণা করেছেন ঠিকই, উন্নত সুযোগ সুবিধাও পেয়েছেন, কিন্তু তার স্থায়ীভাবে বিদেশে থেকে যাবার ইচ্ছে ছিল না কখনোই। তারপরেও জামাল নজরুল ইসলামের দেশে প্রত্যাবর্তন এতটা সহজ ছিল না। তাকেও নিজের দেশের মাটিতে অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
১৯৮১ সালের দিকে দেশে ফিরে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে যোগদেন। এ সময় তার বেতন ছিল আটাশ শ’ টাকা। এখানে এক বছর অধ্যাপনা করার পর গবেষণার কাজে এবং পারিবারিক প্রয়োজনে আবার লন্ডনে ফিরে যাবার প্রয়োজন দেখা দেয় তার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গবেষণার জন্য বাইরে গেলে কর্তৃপক্ষ ছুটি প্রদান করে এবং ফিরে আসা পর্যন্ত চাকরি বলবৎ থাকে। এর জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ছুটির আবেদন করেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। উপায় না দেখে চাকরি ছেড়ে চলে যান তিনি। দুই বছরে সেখানে তার গবেষণা সম্পন্ন করেন।

এরপর ১৯৮৪ সালে তিনি সেখানকার বাড়িঘর বিক্রি করে স্থায়ীভাবে দেশে চলে আসেন। এরপর অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বেতন বাড়িয়ে তিন হাজার টাকায় উন্নীত করে আর মাঝখানের সময়টিকে শিক্ষা ছুটি হিসেবে গ্রহণ করে।
দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার জন্য উন্নত মানের একটি গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এর অধীনে অনেক শিক্ষার্থী মাস্টার্স ও পিএইচ.ডি. করেছে এবং তাদের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই।
দেশের জন্য, দেশের বিজ্ঞানচর্চার জন্য তিনি যে পরিমাণ আন্তরিকতা দেখিয়েছেন, তা সত্যিই অনন্য। নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ এই গুণী বিজ্ঞানী ২০১৩ সালে ৭৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
বিশ্বের ইতিহাসে দেশপ্রেমের এমন দৃষ্টান্ন বিরল। তিনি বাংলাদেশের গর্ব।

Share.

মন্তব্য করুন